ঢাকা, বুধবার, ১৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

ব্যয় বাড়ছে ৬০৩ শতাংশ

কক্সবাজার পেরিয়ে রেলপথ যাবে মায়ানমার সীমান্তে

মফিজুল সাদিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯০৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩, ২০১৬
কক্সবাজার পেরিয়ে রেলপথ যাবে মায়ানমার সীমান্তে ফাইল ফটো

ঢাকা: ৬০৩ শতাংশ ব্যয় বৃদ্ধি! এটা শুনে অনেকের হয়তো চোখ কপালে উঠতে পারে। এত টাকা কোনো চলমান প্রকল্পে বাড়তে পারে? অবাস্তব ও অকল্পনীয় হলেও সত্য রেলপথ মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্পের ব্যয় বাড়ছে ৬০৩ শতাংশ।

ভুল পরিকল্পনার মাশুল হিসেবে রেকর্ড পরিমাণে ব্যয় বাড়ছে প্রকল্পটির।

‘দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু থেকে মায়ানমারের নিকটে গুনদুম পযর্ন্ত সিংগেল লাইন মিটারগেজ ট্রাক’ নির্মাণের লক্ষ্যে ১ হাজার ৮৫২ কোটি ৩৫ লাখ টাকা ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু এই প্রকল্পের অবিশ্বাস্যভাবে ব্যয় বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ৬০৩ শতাংশ। যা টাকার অঙ্কে হিসাব করলে দাঁড়ায় ১৩ হাজার ২৯ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। একই সঙ্গে জুন ২০২০ সাল নাগাদ প্রকল্পের সময় বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রকল্পটি ডিসেম্বর ২০১৩ সালে শেষ হওয়ার কথা ছিল।

এতে করে সংশোধিত প্রকল্পে মূল প্রকল্পের ছিটেফোঁটা পরিকল্পনাও থাকছে না। কক্সবাজার পেরিয়ে রেলপথ মায়ানমার সীমান্তে যাওয়ার লক্ষ্যে জুলাই ২০১০ থেকে ডিসেম্বর ২০১৩ মেয়াদে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য একনেক সভা অনুমোদন দিয়েছিল। কিন্তু দীর্ঘদিন পরে আবারও সময় ও ব্যয় বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে রেলপথ মন্ত্রণালয়।
 
অস্বাভাবিক ব্যয় বৃদ্ধি প্রসঙ্গে পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের এক কর্মকর্তা বাংলানিউজকে বলেন, মূল প্রকল্প থেকে সংশোধিত প্রকল্পে কাজের অনেক পরিবর্তন করা হয়েছে। মূল প্রকল্পের আওতায় মোট ১২৭ দশমিক ৬৬ কিলোমিটার রেলপথ সিংগেল লাইন হওয়ার কথা থাকলেও এখন ডুয়েল গেজ ট্রাকে নির্মাণ করা হবে। যে কারণে ৬০৩ শতাংশ ব্যয় বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। সবেমাত্র প্রকল্পটি আমাদের হাতে এসেছে। তবে সামনে মিটিং হবে! তখন দেখা যাক কতটা কম বেশি করা যায়। ’

রেলপথ মন্ত্রণালয় জানায়, পযর্টন শিল্পের উন্নয়নে বর্তমানে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের মধ্যে সড়ক পথই যোগাযোগের মাধ্যম। তবে জলপথে যোগাযোগের ব্যবস্থা রয়েছে। পযর্টক ও ব্যবসায়ীদের চাহিদার তুলনায় এই পথ যথেষ্ট নয়। বর্তমানে কক্সবাজার যাওয়ার জন্য রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা নেই। পযর্টন বৃদ্ধির জন্য কক্সবাজার পযর্ন্ত রেলওয়ে লাইন জরুরি।

রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, দোহাজারি থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পযর্ন্ত ৯৯ দশমিক ৩ কিলোমিটার এবং রামু থেকে মায়ানমারের নিকট গুনদুম পযর্ন্ত ২৮ দশমিক ৯৬ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হবে। অর্থাৎ প্রকল্পের আওতায় মোট ১২৭ দশমিক ৬৬ কিলোমিটার সিংগেল লাইনকে ডুয়েল গেজ ট্রাক নির্মাণ করা হবে। যে কারণে অবিশ্বাস্যভাবে ব্যয় বাড়ছে। এটি ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করবে। এছাড়া রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের মাধ্যমে পযর্টন নগরী কক্সবাজারে পযর্টন সুবিধা আরও বাড়বে।

নানা কারণে প্রকল্পের ব্যয় বেড়েছে বলে জানায় রেলপথ মন্ত্রণালয়। ব্যয় বৃদ্ধি ও প্রকল্প সংশোধনের কারণে কাজের ব্যাপ্তি ও নকশার মানসমূহের আমূল পরিবর্তন হয়েছে। কাজের ব্যাপ্তি ও নকশার পরিবর্তনের ফলে মূল প্রকল্প থেকে সংশোধিত প্রকল্পে ১১ হাজার ১৭৭ কোটি ৩৩ লাখ টাকা বৃদ্ধি করা হয়েছে। যার মধ্যে অন্যতম সিঙ্গেল থেকে ডুয়েল গেজ, প্রাইস এডজাস্টমেন্ট ও ফিজিক্যাল কন্টিজেন্সি খাতে ১ হাজার ৬৬৯ কোটি, ভ্যাট খাতে ৭১৬ কোটি ও ভূমি অধিগ্রহণ খাতে ১ হাজার ১১০ কোটি টাকা অতিরিক্ত বৃদ্ধি। এতে করে মূল উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা(ডিপিপি) থেকে সংশোধিত প্রকল্পে ব্যয় ৬০৩ শতাংশ বাড়তি।

এছাড়া মূল ডিপিপি থেকে ভূমি অধিগ্রহণ বাবদ ৬০ দশমিক ৪৭ শতাংশ ব্যয় বেড়েছে।
 
প্রকল্পের পরিকল্পনা বৃটিশ আমলের। নানা কারণে বাধাগ্রস্ত হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পটি।

১৮৯০ সালে মায়ানমার রেলওয়ের মাধ্যমে চট্টগ্রাম থেকে রামু ও কক্সবাজার হয়ে মায়ানমার পযর্ন্ত রেলওয়ে লাইন নির্মাণের জন্য সার্ভে করা হয়েছিল। সে প্রেক্ষিতে ১৯০৮ থেকে ১৯০৯ সালে মায়ানমার রেলওয়ে সার্ভে করে। চট্টগ্রামের সঙ্গে আকিয়াবের(মায়ানমার) রেল যোগাযোগ স্থাপনের লক্ষ্যে দোহাজারী থেকে রামু হয়ে আকিয়াব পযর্ন্ত ১৯১৭ থেকে ১৯১৯ সালে পুনরায় সার্ভে করা হয়।

সে মোতাবেক চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারী পযর্ন্ত মিটার গেজ রেলপথ নির্মাণ করা হয়। কিন্তু ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে কক্সবাজারের রামু পযর্ন্ত রেলপথ নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি। ১৯৫৮ সালে তদানীন্তন পূর্ব বাংলা রেলওয়ে চট্টগ্রামের দক্ষিণ দিক থেকে কক্সবাজার পযর্ন্ত রেলপথ সম্প্রসারণের জন্য সার্ভে করা হয়েছিল। যার উদ্দেশ্য ছিল কক্সবাজার পযর্ন্ত রেলপথ নির্মাণ করা।

পরবর্তীতে জাপান রেলওয়ে টেকনিক্যাল সার্ভিস(জেআরটিএস) ১৯৭১ সালে রেলওয়ে লাইনটির ট্রাফিক সম্ভাবনা যাচাইয়ের জন্য সমীক্ষা করে। বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধে জেআরটিএস ১৯৭৬-৭৭ সালে ডাটা সংগ্রহের কাজ সম্পন্ন করে। পরে ১৯৯২ ও ১৯৯৫ সালে দেশী ও বিদেশি পরামর্শক এই রেলপথ নিয়ে নানা ধরণের স্টাডি করে। কিন্তু আলোর মুখ দেখেনি রেলপথটি।

অবশেষে প্রকল্পের পরিকল্পনা করা হলেও সেটা হয় ভুলে ভরা। যে কারণে ব্যয় বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ৬০৩ শতাংশ।

৬০৩ শতাংশ ব্যয় বৃদ্ধি প্রসঙ্গে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. ফিরোজ সালাহ্ উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, বাংলাদেশে দুই ধরণের রেলপথ রয়েছে। যেমন চট্টগ্রাম অঞ্চলে মিটারগেজ অন্যদিকে উত্তরবঙ্গে রয়েছে ব্রডগেজ। এতে করে রাজশাহী অঞ্চলের কোনো পযর্টক যদি কক্সবাজার যেতে চায় তবে ট্রেন পরিবর্তন করতে হবে। রাজশাহীসহ সারা বাংলাদেশের যাত্রীরা যেন কোনো ট্রেন পরিবর্তন না করে কক্সবাজারে ভ্রমণ করতে পারেন সেই ব্যবস্থা করতে যাচ্ছি। ‘দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু থেকে মায়ানমারের নিকটে গুনদুম পযর্ন্ত সিংগেল লাইন মিটারগেজ ট্রাককে ডুয়েল গেজে রূপান্তর করবো। এতে করে মিটার গেজ ও ব্রডগেজ সব ধরণের ট্রেন চলাচল করতে পারবে। ’

‘প্রকল্পের আওতায় মোট ১২৭ দশমিক ৬৬ কিলোমিটার সিংগেল লাইন রেলপথকে ডুয়েল গেজ ট্রাক নির্মাণ করার ফলে ব্যয় কয়েকগুণ বাড়ছে। এর ফলে ভূমি অধিগ্রহণসহ অন্যান্য সরঞ্জাম কেনার ব্যয়ও বাড়বে। ’

বাংলাদেশ সময় : ০৯০৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৩, ২০১৬
এমআইএস/আরআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।