বরিশাল: নিহত স্পিড চালককে দায়ী করে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। যেখানে একই সাথে স্পিডবোট চালনা ও ভাড়া আদায়ে ব্যস্ত থাকায় চালকের নিয়ন্ত্রণের বাইরে গিয়ে এ দুর্ঘটনাটি ঘটে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
তবে ওই প্রতিবেদনে উপস্থাপিত যাত্রী সংখ্যা ও সব যাত্রীর লাইফ জ্যাকেট পরিধানের বিষয়ে দেওয়া তথ্য নিয়ে গরমিল দেখা দিয়েছে। যে ব্যক্তির বরাতে তদন্ত প্রতিবেদনে সব যাত্রীর লাইফ জ্যাকেট পরিধানের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে তিনি বুধবার (১১ ডিসেম্বর) জানিয়েছেন স্পিডবোটের সব যাত্রী লাইফ জ্যাকেট পরিহিত অবস্থায় ছিল না, ২/১ জন বাদ ছিলেন। সেই সঙ্গে বোটটিতে মোট ১০ জন যাত্রী ছিল এবং একজন চালক থাকার বিষয়টি উদ্ধার হওয়া যাত্রীরা বললেও বিআইডব্লিউটিএর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বোটটিতে একজন চালকসহ ৮ জন যাত্রী ছিল।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নিজেদের দায়িত্ব অবহেলা ঢাকতেই এমন তথ্য উপস্থাপন করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিবেদন দাখিল করেছেন বরিশালের দায়িত্বরত কর্মকর্তারা। তবে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিভাগ বরিশালের উপ পরিচালক মো. আব্দুর রাজ্জাক জানিয়েছেন, প্রাথমিক তদন্তে যেসব বিষয় সামনে এসেছে তাই নিয়ে ওই প্রতিবেদন দাখিল করেছেন এবং পরবর্তীতে আরও তদন্ত করা হবে বলেও জানান তিনি।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহণ কর্তৃপক্ষের নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিভাগ (নৌ নিট্রা) এর বরিশালের এই উপ-পরিচালক কর্তৃক পরিচালক (ঢাকা) বরাবর প্রেরিত প্রতিবেদন অনুযায়ী ঘটনার সময় চালক একইসঙ্গে স্পিডবোট চালনা ও ভাড়া আদায় ব্যস্ত ছিল। তখনই স্পিডবোটটি চালকের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় এবং দুর্ঘটনাকবলিত হয়।
আর স্পিডবোট চালকের এরূপ দায়িত্বহীনভাবে বোট পরিচালনার জন্য এ দুর্ঘটনা ঘটে বিধায় প্রাথমিকভাবে দুর্ঘটনার জন্য চালককেই দায়ী বলে প্রতীয়মান হয়েছে বলে ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
এছাড়া ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ৫ ডিসেম্বর বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে কীর্তনখোলা নদীতে ভোলার ভেদুরিয়া লঞ্চঘাট থেকে বরিশালের উদ্দেশ্যে আসা নামহীন যাত্রীবাহী স্পিডবোটের সঙ্গে মালবাহী স্টিলবডি ট্রলারের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে স্পিডবোটটি সম্পূর্ণভাবে নদীতে নিমজ্জিত হয়। আর ওই সময় বোটে একজন চালকসহ ৮ জন যাত্রী ছিল। এর মধ্যে চারজন যাত্রী নিখোঁজ হয় এবং বাকি পাঁচজন সাঁতরে ও স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় তীরে উঠতে সক্ষম হয়। উদ্ধার হওয়া ৫ জনের মধ্যে ২ জন যাত্রীকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় শের ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য পাঠালে চিকিৎসক ডালিম মাহমুদ (৩৫) নামে পিরোজপুরের দুর্গাপুরের একজনকে মৃত ঘোষণা করেন। এছাড়া ৮ ডিসেম্বর নদী থেকে ভাসমান অবস্থায় ভোলা সদরের বাসিন্দা ও স্পিডবোট চালক মো. আল আমিন, যাত্রী ভোলা সদরের মো. ইমরান হোসেন ইমন ও পটুয়াখালীর কলাপাড়ার বাসিন্দা রাসেল আনির (২৪) মরদেহ নৌ পুলিশ উদ্ধার করে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে দুর্ঘটনার সংবাদ পাওয়া মাত্র বরিশালস্থ নৌ-নিট্রা দপ্তরে পরিদর্শকরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন এবং পরিদর্শনকালে দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া যাত্রী ভোলার মনপুরা উপজেলার হাজিরহাটের সোনাকচর এলাকার মো. শাহিন এর সাথে তাদের কথা হয়। যেখান থেকে তারা জানতে পারেন স্পিডবোটে থাকা সব যাত্রীই লাইফ জ্যাকেট পরিহিত ছিল।
ওই ব্যক্তি আরও জানায়, কীর্তনখোলা নদীর মোহাম্মদপুর নামক স্থানে এলে চলমান অবস্থাতেই চালক যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়া উত্তোলনে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। চালক বিপরীত দিক থেকে আসা মালবাহী স্টিল বডি ট্রলারটি লক্ষ্য করতে না পেরে সেটির ওপর উঠিয়ে দেয়। তাৎক্ষণিক স্পিডবোটটি দুমড়ে-মুচড়ে যায় এবং সব যাত্রী নিয়ে সেটি নদীতে নিমজ্জিত হয়।
৯ ডিসেম্বর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে দাখিলকৃত এ প্রতিবেদন হাতে আসার পর প্রতিবেদনের বুধবার (১১ ডিসেম্বর) সকালে পৌনে ১০টায় বেঁচে যাওয়া যাত্রী শাহিন বাংলানিউজকে মোবাইলফোনে জানান, মনপুরা থেকে নোয়াখালীর লাইনটি তিনি যাত্রী পরিবহনের দায়িত্ব পরিচালনা করেন। মেশিন কেনার জন্য ওইদিন বরিশালে এসেছিলেন। বোটটিতে ১০ জন যাত্রী ও একজন চালক ছিল। আর যাত্রীদের মধ্যে ২/১জন লাইফ জ্যাকেট পরিহিত ছিল না। আবার হাসপাতালে ভর্তি হওয়া বেঁচে যাওয়া যাত্রী ও পুলিশ সদস্য মানসুরও বিভিন্ন গণমাধ্যমে বোটটিতে ১০ জন যাত্রী থাকার কথা স্পষ্ট জানিয়েছেন। যদিও নৌ-নিট্রার প্রতিবেদন অনুযায়ী একজায়গাতে চালকসহ ৯ জন আরেক জায়গাতে নিখোঁজ ৪ যাত্রীসহ ৯ জন যাত্রীর কথা বলা হয়েছে। ৯ যাত্রীর স্থলে চালকের কথা উল্লেখ করা নেই।
অপরদিকে সবাই লাইফ জ্যাকেট পরিহিত ছিল বলে নৌ-নিট্রার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হলেও শহিন বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। সেইসাথে উদ্ধার হওয়া কোনো মরদেহের সাথেই লাইফ জ্যাকেটের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। আর স্বজনরা জানিয়েছেন, লাইফ জ্যাকেট থাকলে মৃত যাত্রীরা তাৎক্ষণিক ভেসে উঠতো।
আবার দুর্ঘটনাস্থল মোহাম্মদপুর বলা হলেও বিষয়টি ছিল নদীর অপর প্রান্তে বরিশাল সদর উপজেলার চরমোনাই ও চরকাউয়া ইউনিয়ন অংশে। এসব তথ্যে গরমিল দিয়ে কি বোঝাতে চেয়েছেন, বা কোনো ত্রুটি এড়িয়ে যেতে চাইছেন কি না তা জানতে চাইলে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিভাগ বরিশালের উপ পরিচালক মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, যে ব্যক্তির বরাতে তথ্যটি তুলে ধরা হয়েছে তিনি তখন যা বলেছেন আমরা তাই তুলে ধরেছি। এখন কেন ভিন্ন ধরনের তথ্য দিচ্ছে তা বলতে পারছি না। আর এ তদন্তটি প্রাথমিকভাবে যা পাওয়া গেছে তাই তুলে ধরে প্রতিবেদনটি দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনে অধিকতর তদন্ত করা হবে।
এ সময় তিনি কোস্টগার্ডও তদন্ত করেছে সেটি খতিয়ে দেখার কথা বলেন। তবে চালকের দায়িত্বহীনতার বাহিরে বোটটিতে অতিরিক্ত যাত্রী বহন হয়েছে কি না কিংবা নিরাপত্তা সরঞ্জাম যথাযথ ছিল কি না সে বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বিষয়টি ভোলার সাথে যোগাযোগ করার কথা বলে এড়িয়ে যান।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৪৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১২, ২০২৪
এমএস/এএটি