ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

কোভিডের পর যুদ্ধাবস্থা: ক্রয়ক্ষমতা ফেরেনি শ্রমজীবীদের

জাফর আহমদ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৫২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৪, ২০২২
কোভিডের পর যুদ্ধাবস্থা: ক্রয়ক্ষমতা ফেরেনি শ্রমজীবীদের

ঢাকা: কোভিড-১৯ এর আঘাত থেকে যুদ্ধাবস্থা; দাঁড়াতে পারেনি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। মানুষের খরচ করার ক্ষমতা কমে যাওয়ার প্রভাব পড়েছে আয়-রোজগার, ক্রয় ক্ষমতার চক্রে।

কোনমতে বেঁচে থাকার কাজই মানুষের প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

রাজধানীর মিরপুরের দুই নম্বর সেক্টরের সড়কের পাশে চা, পান, বিড়ি-সিগারেট ছোট্ট একটি দোকান চালান মো. খোকন মিয়া। কোভিড-১৯ এর পর থেকেই তার বিক্রির সঙ্গে কমেছে লাভও। এখন দিনে তিন থেকে চার হাজার টাকার বিক্রি হয়। এতে চারশ থেকে পাঁচশ টাকা লাভ থাকে। করোনার আগে একই জায়গায় তার ছয় সাত হাজার টাকা বিক্রি হতো। লাভ থাকতো সাতশ টাকারও বেশি।

খোকন জানান, আগে এখানে মানুষের আনাগোনা বেশি ছিল, অন্যান্য দোকানও ছিল। রিকশা-ভ্যানওয়ালারা আসতেন, চা-চা পান খেতো। এখন এসব মানুষ এলেও সংখ্যায় কম, কেনেও কম।

তিনি জানান, দাম বেশি এ জন্য মানুষ কম কেনে। আগের চেয়ে এখন সবকিছুর দাম বেড়েছে। চাপাতা, বিড়ি-সিগারেট, বিস্কুট, দুধ, চিনি-সবকিছুরই দাম বেড়েছে। ফলে খুঁচরা বিক্রিতেও দাম বাড়াতে হয়েছে।

পাঁচ মিটার দূরে বসে খোশ-গল্প করা কয়েকজনকে দেখিয়ে তিনি বলেন, এই যে দেখেন ওরা বসে আছে। তাদের জিজ্ঞাসা করেন মানুষ কেন কেনে না। ওরাই আমার কাস্টমার।

বসে থাকা এসব মানুষ বাসাবাড়ি স্থানান্তরে মালামাল বহন, গাড়ি লোড,আনলোডের কাজ করে। একজন সর্দারের নেতৃত্বে তারা কাজ করে। কাজের ফাঁকে রাস্তার ধারে এসব মানুষ চায়ের দোকান বা গাছতলাতে বিশ্রাম করে। ঘণ্টা, বেলা, পুরো দিন, এমন কি পুরো সপ্তাহও কাজ থাকে না। এসব শ্রমজীবী মানুষ বসে থাকে কাজের ডাকের আশায়, কখন আসবে কাজের ডাক। ততক্ষণ এসব দোকান থেকে চা, পান, বিড়ি সিগারেট, বিস্কুট কিনে খান।

শ্রমিকসর্দার মো. আলমগীর হোসেন ভোলা জেলা থেকে এসেছেন। তিনি জানান, মানুষ এখন কম বাসা বদলায়। একবার বাসাতে ঢোকে তো আর বের হতে চায় না। কেউ কেউ তো আবার বাসা থেকে বের হলে ঢাকা ছেড়ে একেবারে গ্রামের বাড়িতে চলে যায়। এ জন্য আয়ও কমেছে।

আলমগীর হোসেনদের আগে ঢাকাতে থাকা-খাওয়া পর মাসে ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা হাতে থাকতো। সেই টাকা বাড়িতে পাঠাতে পারতেন; কিছু সঞ্চয়ও করতেন। এখন চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা জমা রাখাই কঠিন হয়ে যায়। কোনো সঞ্চয় নেই, কোনো বাড়তি খরচ করতে হলে ধার দেনা করতে হয়।

বাড়ির মালামাল অন্যত্র নিতে এখন বেশি ভাড়া নেন না, ভাড়া বাড়াননি- জানতে চাইলে তিনি বলেন, হ্যাঁ বাড়িয়েছি। কিন্তু যে হারে খরচ বেড়েছে সে হারে তো বাড়াতে পারিনি। আবার সবাই বাড়তি খরচ দিতেও চায় না। কাজ কমে গেছে। এ জন্য চা-পান এখন কম খাই। একেবারে না হলেই না, সে রকম পান, বিড়ি-সিগারেট, বিস্কুট, খাই।

২০২০ সালের মার্চে কোভিড-১৯ এর কারণে লকডাউন ঘোষণা করলে এ সব শ্রমজীবী মানুষের আয় রোজগার বন্ধ হয়ে যায়। লকডাউন ও পরবর্তীতে চলাচল সীমিত হয়ে পড়লে অনেকেই গ্রামে পাড়ি জমান। তাদের অনেকে বাড়িতে থেকে গেছে, অনেকে হয়তো ফিরে এসেছে। কোটি মানুষের ঢাকা শহরে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, হকার, রিকশা-ভ্যানচালক, কারখানা শ্রমিক, দোকান কর্মচারি, গৃহকর্মী আপন জীবিকার তাগিদেই মাথা গোঁজার ঠাইয়ের চেষ্টা করছে।

রাজধানীর মিরপুর, সেগুন বাগিচা, রামপুরার কম আয়ের মানুষের বসবাসের এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কোনো নির্দিষ্ট আয়ের মানুষই ভাল নেই। তারা আগের মত রোজগার করতে পারছে না। ঠিকমতো কিনতে পারছে না প্রতিদিনের খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসার মতো নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য ও সেবা। তারপরও টিকে থাকতে লড়াই করছেন প্রতিদিন। তাদের আশা, হয়তো আগের মতো আবারও আয় রোজগার হবে। কমবে নিত্যপণ্যের দাম। ভাল থাকবেন তারা।

কোভিড-১৯ এর আগে দেশে দরিদ্র মানুষের হার ছিল ২০ দশমিক ৫ শতাংশ। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেম সে সময় জানিয়েছিল কোভিড-১৯ এর আঘাতে দারিদ্রের এ হার বেড়ে ৪২ শতাংশ হয়েছে। সবচেয়ে বেড়েছিল গ্রামে ৪৫ শতাংশ, আর শহরে ৩৫ শতাংশ। অর্থাৎ বেকারত্বের তিলক কাজের সন্ধানে শহরে ভিড় করা মানুষের কপালে যেন জলে ভাষা পদ্মে পরিণত করেছে।    

কোভিডের সময় শ্রমজীবী যে মানুষটি আশায় বুক বেঁধেছিল- করোনার পর ঢাকা আবার আগের মত হবে; সব সমস্যা দূর হবে। কলকারখানা চলবে, মার্কেট, পরিবহন চলবে, মানুষের বাড়ি বানানোর কাজে স্পন্দন ফিরবে; সবকিছু চলবে, কাজ পাবে, রোজগার করবে, চাহিদা মতো সদাই করবে। করোনা পরবর্তী সময়ে তেমনটা শুরুও হয়েছিল। কিন্তু আশার আলোর ঝিলিক মিলে যায় অভিঘাতে পদাঘাতে। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দেশের নিত্যপণ্যের বাজারের আগুনে অল্প সময়েই যেন কর্পূরের মত উবে যা আশার আলো। মূল্যস্ফীতি লাগাম ছাড়া ঘোড়াতে পরিণত হয়।

করোনায় বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো (বিএটি) থেকে চাকরি হারিয়ে রিকশাচালক হওয়া আসলাম শেখ যেন সে সাক্ষ্য বহন করে চলেছেন। তার বয়স ৪৯ বছর। চাকরি হারানোর পর এখন তিনি মিরপুর দশ নম্বরে রিকশা চালান।

আসলাম শেখ বিএটিতে যে বেতন পেতেন রিকশা চালিয়ে তার অর্ধেকেরও কম আয় করেন। পরিবার নিয়ে ঢাকায় থাকেন। আয় কমার কারণে কম ভাড়ার বাসাতে উঠেছেন। খাওয়া খরচ কমিয়েছেন। তারপরও টিকে থাকতে কষ্ট হচ্ছে। তিনি জানেন না আগামীতে কী হবে।  

মূল্যস্ফীতির ঝাঁকুনিতে নিম্নমধ্য বিত্ত, মধ্যবিত্তসহ সৌখিন মানুষকেও খরচ কাটঝাট করতে হয়েছে। মিরপুরের রাশেদ গার্ডেন নার্সারির সত্ত্বাধিকারী মো. রাশেদ মিয়া বলেন, গাছ বিক্রি কমে গেছে। আগে দিনে দশ থেকে বারো হাজার টাকার গাছ ও টব বিক্রি হতো। এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে তিন থেকে চার হাজার টাকায়।

তিনি বলেন, গত ছয় মাসে বীজ, গাছ, মাটি, সার ও প্লাস্টিকের টবের দাম বেড়েছে। ফলে গাছের খুচরা দামও বাড়াতে হয়েছে। অনেক মানুষই আসে, গাছের দাম জিজ্ঞাসা করে চলে যায়। আগে এমনটা হতো না। দাম বাড়ার কারণে এমন হয়েছে বলে মনে করেন এই ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী।

কোভিড-১৯ এ মানুষের আয় কমেছে। আয় কমার কারণে ক্ষয়ক্রমতাও কমেছে। ক্রয় ক্ষমতা কমায় এসব নিম্ন, নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষ নির্ভর ব্যবসা-বাণিজ্য ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না বলে মনে করেন বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন।  

তিনি বাংলানিউজকে বলেন, চায়ের দোকানদার, চটপটি বিক্রেতা, মুদি দোকানদার, গামছা-লুঙ্গি বিক্রেতার বাজার হলো নিম্নবিত্ত, নিম্ম মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষ। এর সঙ্গে মজুরি বৃদ্ধি-কমার একটি সম্পর্ক আছে। আগে অদক্ষ শ্রমিকের মজুরি মূল্যস্ফীতির কাছাকাছি থাকতো। এখন সেটা আর সেভাবে নেই। এখন মূল্যস্ফীতি যেখানে ৯ এর কাছাকাছি, সার্বিক মজুরি সূচক সেখানে ৬ এর উপরে না। এখানে কিন্তু চিত্রটা পরিষ্কার হয়েছে। মূল্যস্ফীতি যে হারে বেড়েছে, মজুরি তার চেয়ে তিন থেকে চার শতাংশ কম হারে বেড়েছে। তার মানে প্রকৃত মজুরি কমে গেছে। আবার কর্মসংস্থানের দৃশ্যমান কোনো প্রবৃদ্ধি নেই। তাহলে তো শ্রম আয় কমে যাওয়ার কথা।

 তিনি বলেন, আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষের আয়ই শ্রম নির্ভরশীল। সেখানে ‘মধ্য ক্ষুদ্র’  বাজারটা সংকুচিত হয়ে গেছে। ফলে এসব মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমেছে। তার প্রভাব পড়েছে ছোট্ট ব্যবসায়ও।    

করোনার অভিঘাত মোকাবিলায় প্রণোদন-ঋণ স্কিম চালু করা হয়েছিল। সেখানে বড় ঋণগুলো অল্প সময়ের মধ্যে বিতরণ হয়ে গেলেও ক্ষুদ্র ও এসএমই খাতের ঋণগুলো বিতরণ হয়নি। ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থার বিতরণ ব্যবস্থা এবং মানুষের ঋণ নেওয়ার সক্ষমতা হারানোর কারণে ক্ষুদ্র ঋণ অবিতরণই থেকে গেছে। যার প্রভাব পড়েছে ক্ষুদ্র ব্যবসা নির্ভর জীবন নির্বাহে। এখনো রয়ে গেছে অভিঘাতের করাঘাতের নিগড়ে।

জাহিদ হোসেন বলেন, অতি সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকে ২৫ হাজার কোটি টাকার কম সুদে একটি প্রণোদনা স্কিম দিয়েছে। এখানে চাহিদা যদি না থাকে, ওই ঋণ তো সমস্যার সমাধান করতে পারবে না। বিক্রির যদি সুযোগ না থাকে তাহলে ওই ঋণ কে নেবে! ওই ঋণ  ভুলপথ নির্দেশিত হয়ে যাবে।

পরামর্শ দিয়ে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, যেসব মানুষের আয় কমেছে, সরকার তাদের এখন সামাজিক সুরক্ষা দেওয়ার মতো নীতি সহায়তা করতে পারে। তারা এমনিতেই কষ্টে আছে। তাদের যদি নগদ সহায়তা দেওয়া হয় তাহলে বাজারটি আরও চাঙ্গা হয়।

বাংলাদেশ সময়: ১১৫১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৪, ২০২২
জেডএ/এমএমজেড

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।