ঢাকা, রবিবার, ১৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

দিল্লি, কলকাতা, আগরতলা

চলে গেলেন গাইবান্ধার দাস বেকারির বড় মেয়ে

ভাস্কর সরদার, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৩৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ১১, ২০১৬
চলে গেলেন গাইবান্ধার দাস বেকারির বড় মেয়ে ফাইল ফটো

কলকাতা: সময়টা ষাটের দশক, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আজকের বাংলাদেশ। অস্থির সময়ে আতঙ্কে দিন কাটছে বাংলাদেশিদের।

ভবিষ্যত কী? এমনই প্রশ্ন ছিলো সাড়ে সাত কোটি মানুষের মনে!

ওই সময়টাতে আমার দিদা, অর্থাৎ আমার মায়ের মা তখন বাংলাদেশের গাইবান্ধা জেলার বাসিন্দা। মাটির চুলায় বিস্কুট আর পাউরুটি তৈরি হতো সে সময়। কালের পরিক্রমায় আধুনিক যন্ত্রের ধাক্কায় বেকারির সেই জৌলুস আজ আর নেই। তাতে কী? আজও গাইবান্ধায় ‘দাস বেকারি’ নামটা জ্বলজ্বল করে রাস্তার সাইনবোর্ড গুলোতে।

প্রথমবার বাংলাদেশ সফরের আগে দিদা বলেছিলেন- ‘গাইবান্ধা শহরে নেমে রিকশায় উঠে শুধু বলবি, দাস বেকারি যাবো। আর কিচ্ছু বলতে হবে না। রিকশাই ঠিক পৌঁছে দেবে। ’

গাইবান্ধায় গিয়ে তার কথা মতো, রিকশায় উঠতেই চলতে চলতে রিকশাওয়ালা বললেন-‘মামা দাস বেকারির কই যাবেন?’ 

বললাম, আমাকে দাস বেকারিটা ঠিক যেখানে, ওখানেই নামিয়ে দেবেন। জানালাম, ওঠা আমার দাদুদের তৈরি। আমি ওই বাড়িতেই যাবো। চলতি অবস্থায় একবার পেছন দিকে তাকিয়ে রিকশাওয়ালা বললো ‘আগে তো কইবেন?’ 

বেশ, আর কিছু বলতে হয়নি তাকে। চলতে চলতে দেখালেন- এই রাস্তাটার নাম দাস বেকারি।  

‘আপনা গো দাদা নানার বেকারির নামে এই রাস্তা। চলেন মামা একেবারে বেকারির সামনে নামাবো। ’

রিকশায় দুলে দুলে যাচ্ছি আর দেখছি। রাস্তার দু-ধারে রাস্তার বাড়ি, দোকান! তাদের ঠিকানায় জ্বলজ্বল করছে দাস বেকারি নামটা।  

রাস্তাটার উপর একটা সিনেমা হলও চোখে পড়ে।  ঠিক জায়গায় নামিয়ে দিয়ে শান্ত হননি  রিকশাওয়ালা। দোকানে কর্মচারী ভর্তি। তাই ততক্ষণ অপেক্ষা করেছিলেন, যতক্ষণ না সঠিক লোকের হাতে পড়ি।  

আমার মামাদের বাড়ি থেকে ডেকে তাদের হাতে তুলে তবেই বিদায় নিয়েছিলেন তিনি। সেবার আমার প্রথম গাইবান্ধা যাওয়া।  

শোনা কথায়, বেকারির সেই জৌলুস আজ অার নেই। কারণ মামা ভাইরা আধুনিক হলেও অনেকটা ইচ্ছা করেই নাকি বেকারিটা আধুনিক করেননি। তাতে নাকি অনেক বিস্কুট ও রুটির স্বাদ বদলে যাবে। আজও এমন কিছু বিস্কুট তৈরি হয় সেখানে, যা সারা বাংলাদেশে হয় না।  

মাত্র ১২ বছর বয়সেই বিয়ের পিড়িতে বসতে হয়েছিলো দিদাকে। দাদু বিক্রমপুরের মানুষ। দিদা আমাদের প্রায়ই বলতেন, মুক্তিযোদ্ধাদের বিনা পয়সায় বিস্কুট দেওয়ার দায়ে তাদের অত্যাচার করতো খান সেনারা।  

তারা শর্ত দিয়ে যায়, এখন থেকে খান সেনাদের বিস্কুট পাঠাতে হবে।  

‘বেকারি ভাঙবে এতো সাহস ছিলো না। কারণ ওই স্বাদের বিস্কুট কই পাবে,’ স্মৃতি ঝাঁপি খুলে বলে যেতেন দিদা। এ গল্প গাইবান্ধায় মামাদের কাছে অনেক শুনেছি। তবে দাদু নাকি বলেছিলেন, ‘বিনা পয়সায় বিস্কুট দেওয়া যাবে না। আপনা গো খাইতে হলে ট্যাকা দিতে হবে। ’  

এক পর্যায়ে খান সেনাদের অত্যাচারে রীতিমতো বাধ্য হয়েই জন্মভূমি ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে চলে আসতে হয় দিদা-দাদুদের।  

দিদাদের ওই সময়ের দিনগুলো আজ শুধুই ইতিহাস। তবে রাস্তার নাম দাস বেকারি দেখে বুঝতে পারি তখনকার ঐতিহ্যের কথা! 

স্বাধীনতার পর দিদার আর গাইবান্ধায় ফেরা হয়নি। কিছুটা অভিমানে বা কোনো অজ্ঞাত কারণে কলকাতাকে ভালোবেসে ফেলেছিলেন! প্রশ্ন করলেও সে উত্তর কোনোদিন দেননি।  

বাংলাদেশ থেকে সরাসরি উঠেছিলেন কলকাতার ভবানিপুরে। অামার দিদার বাড়ি মমতা ব্যানার্জির বাড়ি থেকে পায়ে হেঁটে মিনিট তিনেকের।  

তাতে কী, চিরকালই আমার দিদা রয়ে গেলেন ডান বিরোধী। বলতেন, তোরা নকশাল আন্দোলন দেখিসনি! আন্দোলোনের কী বুঝবি! অল্প শিক্ষিত মানুষটি বামপন্থাকে তার নিজের মতো করে বিশ্লেষণ করতেন।

মনে আছে দিদাকে মজা করে রাগানোর জন্য আমার মা-মাসিরা বলতেন, বাংলাদেশে কী আছে? কলকাতায় দেখো কতো সুবিধে! তর্কে যখন পেরে উঠতেন না দিদা, হাউ মাউ করে কেঁদে উঠতেন। অনেক সময় গোপনেও চোখের পানি মুছতে দেখা গেছে তাকে।  

বলতেন, জন্মভূমির কথা মনে পড়ে। অসম্ভব ভালবাসতেন বাংলাদেশকে। সেখানে বেড়াতে যাওয়ার কথাও বলতেন।  

পরবর্তীতে কৈশোরে ২১ ফেব্রুয়ারি  বা একাত্তরের আন্দোলনের কথা শুনেছি দিদারই মুখ থেকেই। দেশটাকে ভালোবাসতে শিখিয়ে ছিলেন তিনি।  

ভারত-বাংলাদেশের ক্রিকেট ম্যাচ খেলা হলে দিদা সমর্থন করতেন বাংলাদেশকে। আবার ভারত-পাকিস্তান খেলা হলে, মনে হতো আজ পাকিস্তানকে না হারিয়ে উঠবেন না।  

মুখস্থ ছিলো বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত। কিংবা  ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ অথবা ‘শোনো একটি মুজিবরের কথা’। স্কুল জীবন তার কাছ থেকেই শুনেছি এসব গানগুলো।  

কংগ্রেস বলতে শুধু ইন্দিরা গান্ধীকেই ভালোবাসতেন তিনি। আবার ভক্ত ছিলেন জ্যোতি বসুরও। তবে মানুষকে ভালোবাসতেন খুব। খেতে ও খাওয়াতেও পছন্দ করতেন তিনি। রান্নাটাও পারতেন খুব ভালো।

কলকাতায় আসার পরের সময়টায় একটি সরকারি অফিসের ক্যান্টিনও চালাতেন দিদা। তার কাছেই শোনা তখন সরাসরি গাইবান্ধা থেকে শিয়ালদহ ট্রেন চলাচল করতো। কলকাতায় বাজার-সওদা করে ফের ট্রেনে বাড়ি ফিরতেন অনেকেই।  

তার কাছে বাংলাদেশের কথা-গল্প শুনতে শুনতে কোথায় যেনো শস্য-শ্যামলা দেশটির সঙ্গে শেকড় জুড়ে গেলো আমারও। একটা অদ্ভূত টান দেশটার প্রতি।  

আজ দিদা আমাদের মাঝে নেই। ক’দিন আগে অর্থাৎ ৮ অক্টোবর চলে গেলেন না ফেরার দেশে। তার আর জন্মভূমি গাইবান্ধায় যাওয়া হয়নি। রয়ে গেলো সেই ইচ্ছেটা...! 

বাংলাদেশ সময়: ১৫৩৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ১১, ২০১৬
ভিএস/এমএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।