ঢাকা, বুধবার, ১৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

সেতুমন্ত্রীর এপিএস নামধারী ছাত্রলীগ নেতা শ্রীঘরে

শেখ জাহাঙ্গীর আলম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৪৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৬, ২০২০
সেতুমন্ত্রীর এপিএস নামধারী ছাত্রলীগ নেতা শ্রীঘরে মন্ত্রীর সঙ্গে তোলা এই ছবির ক্যাপশন হলো, ‘ভালোবাসার শেষ ঠিকানা...’

ঢাকা: এমপি-মন্ত্রী-পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে সখ্য ছিল ঢাকা কলেজে পড়ার সময়ে ছাত্রলীগ করার কারণে। এরপর তো তিনি পদ পেয়েছেন ছাত্রসংগঠনটির কেন্দ্রীয় কমিটিতে।

ছিলেন সদস্য। এসময় এমপি-মন্ত্রী-পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে ছবি তুলে তা দিতেন ফেসবুকে। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে তোলা একটি গ্রুপ ছবি ‘ভালোবাসার শেষ ঠিকানা...’ ক্যাপশনে একাধিকবার ফেসবুকে পোস্টও করেছেন সাবেক এই ছাত্রলীগ নেতা। সরকারি বিভিন্ন দফতরে গিয়ে নিজেকে পরিচয় দিতেন সেতুমন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) হিসেবে। আর এসবের মধ্যেই চলছিল তার তদবির বাণিজ্য ও টেন্ডারবাজি। যার মাধ্যমে মোজাম্মেল হক ইয়াছিন (৩৩) হাতিয়ে নিয়েছেন মোটা অংকের টাকা।

সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের এপিএস পরিচয় দিয়ে তার (মন্ত্রীর) সিল ও সই জালিয়াতির ঘটনায় গোয়েন্দা পুলিশের হাতে ধরা পড়েন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক এ সদস্য। এখন শ্রীঘর-ই মোজাম্মেলের ঠিকানা।

বুধবার (২৩ ডিসেম্বর) দুপুরে রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরের জাউলহাটী চৌরাস্তা এলাকার ৭৭৩ নম্বর বাসায় অভিযান চালিয়ে প্রতারক মোজাম্মেল হক ইয়াছিনকে (৩৩) গ্রেফতার করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা লালবাগ বিভাগের কোতয়ালী জোনাল টিম। এই ঘটনায় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) উচ্চমান সহকারী (প্রশাসন শাখা) এস এম আবুল কালাম বাদী হয়ে রাজধানীর শেরে বাংলানগর থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। প্রতারক মোজাম্মেল নেত্রকোনার মদন উপজেলার বনতিয়শ্রী গ্রামের আ. রশিদের ছেলে।

গত ১৭ নভেম্বর স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) সহকারী প্রধান প্রকৌশলী মাহবুব ইমাম মোরশেদ এর কাছে অধিদপ্তরের অস্থায়ী কার্য-সহকারী পদে মো. মাঈন উদ্দিন নামে এক ব্যক্তির জন্য চাকরির সুপারিশ নিয়ে যায় প্রতারক মোজাম্মেল হক। এক পৃষ্ঠার ওই আবেদনপত্রের উপরে সবুজ কালি দিয়ে লেখা ছিল ‘সদয় বিবেচনা করিয়া অস্থায়ী কার্য-সহকারী পদে চাকরি দেওয়া জন্য জোর সুপারিশ করছি। ’ সেখানে সেতুমন্ত্রীর সই এবং মন্ত্রীর নাম সম্বলিত সিল দেওয়া ছিল। যদিও এই সিল ও সই দুটোই জাল (ভুয়া) ছিল।  

সেতুমন্ত্রীর সুপারিশ দেখেই এলজিইডি অধিদপ্তরের প্রকৌশলী মাহবুব ইমাম মোরশেদ দ্রুতই আবেদনপত্রটি ফরওয়ার্ড করে দিয়েছিলেন। কিছুদিন পরে প্রতারক প্রকৌশলীকে সেতুমন্ত্রীর এপিএস পরিচয় দিয়ে ফোন করেন। এরপর সন্দেহ জাগলে সেতুমন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করেন মাহবুব ইমাম। এরপর তিনি বুঝতে পারেন, মোজাম্মেল হক একজন প্রতারক।

এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) সহকারী প্রধান প্রকৌশলী মাহবুব ইমাম মোরশেদ বাংলানিউজকে বলেন, মাসখানেক আগে মোজাম্মেল হক সেতুমন্ত্রীর এপিএস পরিচয় দিয়ে আমার দফতরেই এসেছিলেন। সেতুমন্ত্রীর সুপারিশ করা একটি চাকরির আবেদনপত্র দিয়ে বলেছিলেন, মন্ত্রীমহোদয় এই কাজটি করে দিতে বলেছেন। তার কিছুদিন পর সে মোবাইল ফোনেও এপিএস পরিচয় দিয়ে তদবির করেন। তার চালচলন ও কথাবার্তায় সন্দেহ হলে, সংশ্লিষ্ট দফতরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি এই নামে সেতুমন্ত্রীর কোনো এপিএস নেই। তিনি একজন প্রতারক। পরে তাকে বুঝতে না দিয়ে বিষয়টি ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশকে জানাই। এরপর তদন্ত করে তারা প্রতারক মোজাম্মেল হককে গ্রেফতার করেছে।

গোয়েন্দা পুলিশের তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রতারক মোজাম্মেল নিজেকে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ঢাকা কলেজ শাখার সাধারণ সম্পাদক বলে পরিচয় দিতেন। এছাড়াও ছাত্রলীগের সোহাগ-জাকিরের কমিটিতে তিনি কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সদস্য হিসেবে স্থান পান বলেও সবার কাছে বলে বেড়াতেন। ২০১৪ সালে মাস্টার্স শেষ করেন তিনি। ঢাকা কলেজে পড়লেও মানুষের কাছে বলতেন সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও ছাত্রলীগের রাজনীতি করতেন। ফেসবুকে সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে ছবি পোস্ট দিয়ে সবার কাছে নিজেকে ক্ষমতাধর হিসেবে প্রচার শুরু করেন। এরপর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের দাওয়াত কার্ডের ছবি তুলে সেটিও ফেসবুকে দিয়েছিলেন। এছাড়াও বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা, পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে ছবি তুলে তা ফেসবুকে দিতেন এই প্রতারক। এসবের উদ্দেশ্য ছিল ছবিগুলো বিভিন্ন মানুষকে দেখিয়ে তদবির করা। কাজ হওয়ার আগেই মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিতেন প্রতারক মোজাম্মেল। এভাবে তদবির বাণিজ্য করে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন তিনি। এছাড়াও প্রতারণার মাধ্যমে তদবির করে হাতিয়ে নেওয়া বিপুল অর্থে কামরাঙ্গীরচরে একটি বাড়ির নির্মাণ করছেন।

গোয়েন্দা পুলিশ জানায়, প্রতারক মোজাম্মেল হক নিজেকে ছাত্রলীগের নেতা পরিচয় দিয়ে আসছিলেন। এ বিষয়ে ছাত্রলীগের সাবেক নেতা সোহাগ-জাকিরের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় গ্রেফতার মোজাম্মেল হক কোনো কমিটিতেই ছিলেন না। তারা আসামি মোজাম্মেল হককে দেখে চিনতেও পারেন নি।

এবিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা লালবাগ বিভাগের কোতোয়ালি জোনের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) মো. সাইফুর রহমান আজাদ বাংলানিউজকে বলেন, সেতুমন্ত্রীর সিল ও সই জালিয়াতির ঘটনায় এলজিইডি অধিদপ্তর থেকে পাওয়া একটি অভিযোগের ভিত্তিতে আমরা অভিযান চালিয়ে কামরাঙ্গীরচর এলাকার বাসা থেকে মোজাম্মেলকে গ্রেফতার করি। সে সরকারি বিভিন্ন দফতরে গিয়ে নিজেকে সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের এপিএস পরিচয় দিতেন। চাকরির সুপারিশ, বদলিসহ বিভিন্ন তদবির করতেন। সর্বশেষ এলজিইডি অধিদপ্তরে এক প্রকৌশলীর কাছে এপিএস পরিচয় দিয়ে চাকরির সুপারিশ করেছিলেন এই প্রতারক। এমনকি ওই সুপারিশের মধ্যে থাকা সেতুমন্ত্রীর সিল ও সইও তারই করা জালিয়াতি ছিল বলে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তিনি স্বীকার করেছেন।

সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর একান্ত সচিব গৌতম চন্দ্র পাল বাংলানিউজকে বলেন, বুধবার ডিবি পুলিশের একজন কর্মকর্তার কাছ থেকে বিষয়টি জানতে পেরেছি। মোজাম্মেল হক ইয়াছিন নামে স্যারের (সেতুমন্ত্রী) কোনো এপিএস নেই। তাদের মাধ্যমেই জেনেছি, ওবায়দুল কাদের স্যারের সিল ও সই জালিয়াতি করেছে এই লোক। যদি তিনি অপরাধ করে থাকেন তবে আইন অনুযায়ী তার সঠিক বিচার হোক এটাই আমরা গোয়েন্দা পুলিশকে বলে দিয়েছি।

বাংলাদেশ সময়: ১৭৪৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৬, ২০২০
এসজেএ/এইচএডি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।