ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

আন্তর্জাতিক

দ. কোরিয়ায় হঠাৎ কেন সামরিক শাসন, প্রত্যাহারই হলো কেন?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৩৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৪, ২০২৪
দ. কোরিয়ায় হঠাৎ কেন সামরিক শাসন, প্রত্যাহারই হলো কেন? দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইউন সুক ইওল

দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইউন সুক ইওল মঙ্গলবার হঠাৎই সামরিক আইন জারি করে বসেন। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আবার তা প্রত্যাহারেরও ঘোষণা দেন তিনি।

দেশটির পার্লামেন্ট সামরিক আইনের বিরুদ্ধে ভোট দেয়। এতেই প্রেসিডেন্ট তা প্রত্যাহার করে নেন। তার এ ঘোষণার পর সামরিক আইন জারির প্রতিবাদ করতে যারা রাস্তায় নেমে এসেছিলেন তারা উৎসবে মেতে ওঠেন।

দক্ষিণ কোরিয়া এশিয়ার গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে পরিচিত। গত ৫০ বছরের মধ্যে এই প্রথম মার্শাল ল বা সামরিক আইন জারি হলে তাতে বিস্মিত হন দেশটির মানুষ।

মঙ্গলবার রাতে প্রেসিডেন্ট ইউন সুক ইওল এক টিভি ভাষণ দেন। তাতে ‘রাষ্ট্র বিরোধী শক্তি’ এবং উত্তর কোরিয়ার হুমকির কথা উল্লেখ করে সামরিক আইন জারির ঘোষণা দেন।

তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই সব পরিষ্কার হয়ে যায়। কোনো বিদেশি হুমকি নয়, বরং অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংকটের কারণেই তিনি এ সিদ্ধান্ত নেন। পরে জনবিক্ষোভের মুখে ভোটে হেরে তিনি পার্লামেন্টের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সামরিক আইন জারির আদেশ প্রত্যাহার করেন।

সামরিক আইন জারির পরপর যা হয়েছিল

প্রেসিডেন্টের প্রথম আদেশ সাময়িকভাবে সামরিক বাহিনীকে দায়িত্বে নিয়ে আসে। হেলমেট পরিহিত সৈন্য ও পুলিশ মোতায়েন করা হয় পার্লামেন্ট ভবনে। সেখানে ছাদে হেলিকপ্টার নামতেও দেখা যায়।

স্থানীয় একটি সংবাদমাধ্যম মুখ ঢাকা সশস্ত্র সেনাদের ওই ভবনের ভেতরে প্রবেশের ছবি প্রকাশ করে। সেখানে দেখা যায়, কর্মকর্তারা অগ্নিনির্বাপক দিয়ে সৈন্যদের ঠেকানোর চেষ্টা করছেন।

স্থানীয় সময় মঙ্গলবার রাত ১১টার দিকে সামরিক বাহিনী সংসদ ও রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলোর কার্যক্রম এবং প্রতিবাদ-বিক্ষোভ নিষিদ্ধ করে ডিক্রি জারি করে। একইসঙ্গে তারা গণমাধ্যমকেও সরকারি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে।

সঙ্গে সঙ্গেই দেশটির রাজনীতিকেরা প্রেসিডেন্টের সামরিক আইন জারির আদেশকে অবৈধ ও অসাংবিধানিক বলে ঘোষণা দেন। তার নিজের দল দল কনজারভেটিভ পিপলস পাওয়ার পার্টিও তার সিদ্ধান্তকে ‘ভুল পদক্ষেপ’ আখ্যা দেয়।

এর মধ্যে দেশটির বৃহত্তম বিরোধী দল লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি দলীয় এমপিদের সংসদে এসে ভোটে অংশ নিয়ে সামরিক আইন জারির আদেশ প্রত্যাখ্যানের আহ্বান জানায়।

তিনি একই সঙ্গে সাধারণ মানুষকে পার্লামেন্টের সামনে প্রতিবাদে অংশ নেয়ার আহবান জানান। এরপরই বিপুল সংখ্যক মানুষ একে ‘মার্শাল ল নয়’ এবং ‘স্বৈরতন্ত্রের পতন হোক’ এমন শ্লোগান দেয়।

মার্শাল ল যেমন হয়

বেসামরিক প্রশাসন কাজ করতে না পারলে জরুরি অবস্থার সময় মার্শাল ল হলো সামরিক কর্তৃপক্ষের অস্থায়ী শাসন। ১৯৭৯ সালে সবশেষ সামরিক আইন জারি হয়েছিল দেশটিতে।  

তখন অভ্যুত্থানে দেশটির দীর্ঘসময়কার সামরিক স্বৈরশাসক পার্ক চুং হি অভ্যুত্থানে নিহত হন। পরে ১৯৮৭ সালে দেশটি সংসদীয় গণতন্ত্র চালু হয়।

মার্শাল ল’র অধীনে সামরিক বাহিনীকে অতিরিক্ত ক্ষমতা দেওয়া হয়। এতে প্রায়শই মৌলিক অধিকার, নাগরিক সুরক্ষা এবং আইনের শাসনের মান খর্ব হয়।

আদেশে রাজনৈতিক দল, গণমাধ্যম ও রাজনীতিকদের কার্যক্রমে বিধিনিষেধ দিলেও তারা সেটি অগ্রাহ্য করে। গণমাধ্যমের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ারও লক্ষণও দেখা যায়নি। সরকারি গণমাধ্যমও মিডিয়াগুলো স্বাভাবিক সংবাদ পরিবেশন করে।

প্রেসিডেন্ট কি চাপে ছিলেন?

কট্টরপন্থী রক্ষণশীল প্রেসিডেন্ট ইউন ২০২২ সালের মে মাসে দায়িত্ব নেওয়ার পর সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হয় বিরোধীরা। ফলে তার সরকার ইচ্ছামতো বিল পাস করতে পারছিল না।

ধীরে ধীরে তার জনপ্রিয়তাও কমে আসছিল। চলতি বছর অনিয়মের ঘটনায়ও তার নাম জড়ায়। এর মধ্যে একটি হলো ফার্স্ট লেডিকে নিয়ে আরেকটি হলো শেয়ার বাজার ঘিরে।

তাকে বাধ্য হয়ে বলতে হয়েছিল যে ফার্স্ট লেডির কার্যক্রম তদারকির জন্য একটি অফিস প্রতিষ্ঠা করা হবে। তবে এ নিয়ে বিরোধীদের বড় ধরনের তদন্তের দাবি তিনি প্রত্যাখ্যান করেন।

ফার্স্ট লেডির বিষয়ে তদন্তে ব্যর্থতার জন্য বিরোধীরা মন্ত্রিসভার সদস্য ও সরকারি অডিট সংস্থার প্রধানসহ শীর্ষ প্রসিকিউটরদের অভিশংসনের উদ্যোগ নেয়।

সামনে কী হবে? 

প্রেসিডেন্টের আদেশের পর সড়কে সৈন্য ও পুলিশের ব্যাপক উপস্থিতি ছিল। মনে হচ্ছিল সামরিক বাহিনী ক্ষমতা হয়তো নিয়েছে। কিন্তু তা আর হয়নি।  

দক্ষিণ কোরিয়ার আইন অনুযায়ী, সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে মার্শাল ল প্রত্যাহার চাওয়া হলে সরকার তাতে বাধ্য। একই আইন অনুযায়ী মার্শাল ল কর্তৃপক্ষ আইন প্রণেতাদের আটক করতে পারে না।

তবে এটি এখনো পরিষ্কার নয় যে সামনে কী হবে এবং প্রেসিডেন্ট ইউনের পরিণতি কী হবে। বিক্ষোভকারীরা তার গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছেন।

বিদ্যমান পরিস্থিতিকে কয়েক দশকের মধ্যে দেশটির গণতন্ত্রের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করা হচ্ছে।

বিশ্লেষকদের অনেকে বলছেন, এ ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাপিটল হিলের চেয়েও বেশি ভাবমূর্তি সংকটে ফেলেছে দক্ষিণ কোরিয়াকে।

ইউনের ঘোষণাকে একইসঙ্গে আইন উপেক্ষা ও রাজনৈতিকভাবে ভুল হিসাব মনে করছেন সিউলের এক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক লেইফ এরিক এসলে। তিনি বলেন, এ পরিস্থিতি দেশটির অর্থনীতি ও নিরাপত্তাকে অপ্রয়োজনীয়ভাবে ঝুঁকিতে ফেলেছে।

এ শিক্ষক বলেন, মনে হচ্ছে তিনি হয়তো অবরুদ্ধ হয়ে ছিলেন। কেলেঙ্কারি, প্রাতিষ্ঠানিক বাধা ও অভিশংসনের ক্রমবর্ধমান চেষ্টার বিরুদ্ধে এটি ছিল তার একটি মরিয়া পদক্ষেপ। সম্ভবত এসব এখন আরও জোরালো হবে।

দেশটির স্পিকারও বুধবার পার্লামেন্টে বলেন, জনগণকে সঙ্গে নিয়ে একসঙ্গেই আমরা গণতন্ত্রকে রক্ষা করব।

বিবিসি অবলম্বনে

বাংলাদেশ সময়: ১৭২৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৪, ২০২৪
আরএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।