ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আন্তর্জাতিক

ইসরায়েলের কারাগারে অবর্ণনীয় নির্যাতনের শিকার হওয়ার অভিযোগ মুক্ত বন্দিদের

আন্তর্জাতিক ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৫৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১, ২০২৩
ইসরায়েলের কারাগারে অবর্ণনীয় নির্যাতনের শিকার হওয়ার অভিযোগ মুক্ত বন্দিদের ইসরায়েলি কারাগার থেকে মুক্ত মোহাম্মদ নাজ্জাল

ইসরায়েলি কারাগার থেকে মুক্ত ফিলিস্তিনি কারাবন্দিরা অভিযোগ করেছেন, তারা সেখানে নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। বিবিসি এ খবর জানিয়েছে।

 

মুক্ত বন্দিরা বলছেন, ৭ অক্টোবর হামাস ইসরায়েলে হামলা চালানোর পর কারারক্ষীরা তাদের ওপর নির্যাতন চালায়। আর সেখানে শুধু ফিলিস্তিনিদের শাস্তি দেওয়া হয়েছিল।  

ফিলিস্তিনি বন্দিরা বলেন, তাদের লাঠি দিয়ে পেটানো হয়, কুকুরের মুখবন্ধনী তাদের পরানো হয় এবং তাদের জামাকাপড়, খাবার ও বিছানা-কম্বল কেড়ে নেওয়া হয়।

এক নারী বন্দি বলেন, তাকে ধর্ষণের হুমকি দেওয়া হয়েছিল। কারারক্ষীরা সেলের ভেতর দুবার টিয়ার গ্যাস চালিয়ে দিয়েছিল।

বিবিসি সব মিলিয়ে ছয়জনের সঙ্গে কথা বলেছে, যাদের সবাই বলছেন, কারাগার থেকে মুক্ত হওয়ার আগে তাদের বেদম মারধর করা হয়েছিল।

প্যালেস্টানিয়ান প্রিজনারস সোসাইটি বলছে, হাতকড়া লাগানো বন্দিদের ওপর কারারক্ষীরা প্রস্রাব করে বলে অভিযোগ রয়েছে। গেল সাত সপ্তাহে ইসরায়েলি হেফাজতে ছয় বন্দি নিহত হয়েছেন।

চলতি সপ্তাহে ইসরায়েলি নারী ও শিশুদের হামাসের হাত থেকে মুক্তি দেওয়ার বিনিময়ে ইসরায়েলও কিছু কারাবন্দিকে মুক্ত করেছে। ১৮ বছর বয়সী মোহাম্মদ নাজ্জাল তাদের একজন।  

তাকে আগস্ট মাস থেকে কোনো অভিযোগ ছাড়াই নাফহা কারাগারে বন্দি করে রাখা হয়। তার ভাষ্য, কেন তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, তা তিনি জানতেন না।

বিবিসির সংবাদদাতা লাকি উইলিয়ামসনকে নাজ্জাল তার বাড়িতে আমন্ত্রণ জানায়। তার বাড়ি অধিকৃত পশ্চিম তীরে জেনিনের কাছে কাবাতিয়া গ্রামে।  

সেখানে গিয়ে দেখা যায়, নাজ্জালের দুই হাত ব্যান্ডেজে বাঁধা। তিনি বলেন, ১০ দিন আগে ইসরায়েলি কারারক্ষীরা একটি মাইক্রোফোন ও স্পিকার হাতে তার সেলে আসে। হাততালি দিয়ে, নাম ধরে ডেকে বন্দিদের উত্তেজিত করার চেষ্টা করে কারারক্ষীরা।  

নাজ্জাল বলেন, যখন তারা দেখল, আমরা কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছিলাম না, তখন তারা আমাদের মারতে শুরু করে।  

তিনি বলেন, তারা আমাদের সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করায়। তরুণ বন্দিদের সামনে রাখা হয়, আর বয়স্কদের পেছনে। তারা আমাকে তুলে নিয়ে মারধর শুরু করে। আমি মাথাটা বাঁচাতে চাইছিলাম। তারা আমার হাত ও পা ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করে।  

নাজ্জালের পরিবার বিবিসির সংবাদদাতাকে এক্স-রে রিপোর্টটি দেখায়। গেল সোমবার মুক্ত হওয়ার পর রামাল্লাহয় ফিলিস্তিনি চিকিৎসকদের কাছে গিয়ে এক্স-রে করান তিনি।  

বিবিসি এক্স-রে রিপোর্টটি যুক্তরাজ্যের দুজন চিকিৎসককে দেখায়। চিকিৎসকরা নিশ্চিত করেন, তার দুই হাতে ভাঙা রয়েছে।  

নাজ্জাল বলেন, শুরুতে অনেক ব্যথা ছিল। পরে আমি জানি হাত ভেঙে গেছে। হাতের ব্যবহার কমিয়ে দিই। টয়লেটে গিয়ে শুধু হাতের ব্যবহার করতাম।  

তিনি বলেন, অন্য বন্দিরা তাকে খেতে, পানি পান করতে এবং বাথরুম ব্যবহার করতে সাহায্য করতেন। কারারক্ষীরা আবার মারধর করতে পারে, এই ভয়ে আমি আর তাদের কাছে চিকিৎসা সাহায্য চাইনি।  

তবে ইসরায়েল প্রিজন সার্ভিস মোহাম্মদের গল্পকে বিতর্কিত করেছে। তারা বলছে, কারাগার ছাড়ার আগে তাকে একজন চিকিৎসকের মাধ্যমে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছিল। তার কোনো সমস্যা ধরা পড়েনি।  

প্রিজন সার্ভিস ওই তরুণের মুক্তির আগে কারাগার ছাড়া এবং রেডক্রসে ওঠার একটি ভিডিও প্রকাশ করেছে। তারা বলছে, এতেই প্রমাণিত হয় ওই তরুণের দাবি মিথ্যা।  

ভিডিও ফুটেজে ওই তরুণের হাতে ব্যান্ডেজ পরা ছিল না, পাশে ঝুলতে দেখা যাচ্ছিল। তাকে বাসে উঠতেও দেখা যায় ভিডিওতে। তবে ভিডিও ফুটেজের অধিকাংশজুড়েই সে এর বাইরে ছিল।  

নাজ্জাল বিবিসিকে জানান, রেডক্রসের বাসে তিনি প্রথম চিকিৎসা পান।  

যেদিন তিনি বাড়ি ফিরে আসেন, সেদিন রামাল্লাহর একটি হাসপাতালের একটি মেডিকেল রিপোর্টে পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল যে, যদি তার ভাঙা হাড়গুলো নিজে থেকে সেরে না যায়, তবে একটি প্লেট লাগানো হতে পারে।

নাজ্জালের গল্প সম্পর্কে নিশ্চিত হতে বিবিসি রেডক্রসের সঙ্গে যোগাযোগ করে। রেডক্রস বিবৃতিতে জানায়, বন্দিদের চিকিৎসার বিষয়ে আমাদের কোনো উদ্বেগ থাকলে আমরা গ্রেপ্তারকারী কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সরাসরি কথা বলি। এ কারণে, আমরা একক কোনো ব্যক্তির সম্পর্কে প্রকাশ্যে কথা বলি না।

নাজ্জাল বলেন, ৭ অক্টোবর হামাস হামলা চালানোর পর কারাগারে রক্ষীদের আচরণ পাল্টে যায়। তিনি বলেন, রক্ষীরা তাদের লাথি দিত, লাঠি দিয়ে পেটাত। এমনকি মুখের ওপর পা রাখত।  

তিনি বলেন, তারা কুকুর নিয়ে আসত। তারা কুকুরকে আমাদের ওপর লেলিয়ে দিত এবং তারপর তারা আমাদের মারধর শুরু করত। তারা আমাদের বিছানা, কাপড়, বালিশ কেড়ে নিয়েছিল। মেঝেতে খাবার ছুড়ে ফেলেছিল। লোকেরা ভয়ে ছিল।  

নাজ্জাল তার পেছনের অংশে এবং কাঁধে মারধরের দাগ বিবিসির সংবাদদাতাকে দেখিয়েছেন।  

তিনি বলেন, আমাকে আক্রমণ করা কুকুরটির মুখে ধারালো কিনারাযুক্ত মুখবন্ধনী পরা ছিল। কুকুরটির মুখবন্ধনী এবং নখর আমার সারা শরীরে দাগ রেখে গেছে।  

তিনি বলেন, মেগিদ্দো কারাগারে এ ধরনের মারধরের ঘটনা দুবার ঘটেছিল। আর নাফহা কারাগারে তার চেয়েও বেশি বার ঘটে।

অন্যান্য ফিলিস্তিনি বন্দির সঙ্গে বিবিসি কথা বলেছে। তারা হামাসের হামলার পর ইসরায়েলের কারাগারের অভ্যন্তরে একই ধরনের পরিবর্তনের বর্ণনা দিয়েছেন এবং বলেছেন, তাদের কাছে এসব পরিবর্তনকে হামাসের কর্মকাণ্ডের জন্য বন্দিদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ হিসেবে মনে হয়েছে।  

প্যালেস্টানিয়ান প্রিজনারস সোসাইটি আবদুল্লাহ আল-জাঘারি বিবিসিকে বলেন, অনেক বন্দি তাদের কারাসঙ্গীদের মুখ ও শরীরে ইসরায়েলি রক্ষীদের হিংস্রভাবে প্রহার করতে দেখেছেন। তিনি রক্ষীদের হাতকড়া পরা বন্দিদের ওপর প্রস্রাব করার অভিযোগ সম্পর্কেও শুনেছেন।

এসব অভিযোগের বিষয়ে বিবিসি ইসরায়েল প্রিজন সার্ভিসের কাছে জানতে চায়। জবাবে তারা বলে, আইন অনুযায়ী বন্দিদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তাদের প্রয়োজনীয় সব মৌলিক অধিকার সংরক্ষিত।

এক বিবৃতিতে প্রিজন সার্ভিস বলেছে, যেসব অভিযোগের কথা বলা হচ্ছে, সে বিষয়ে আমরা অবগত নই। এরপরও বন্দি ও আটকদের  অভিযোগ দায়ের করার অধিকার রয়েছে, যা সরকারি কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সম্পূর্ণভাবে পরীক্ষা করা হবে।

চলতি সপ্তাহের শুরুতে লামা খাতের নামে এক ফিলিস্তিনি নারী ইসরায়েলি কারাগার থেকে মুক্তি পান। তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি ভিডিওতে অভিযোগ করেন, অক্টোবরের শেষে গ্রেপ্তারের পর একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা তাকে স্পষ্টত ধর্ষণের হুমকি দিয়েছিল।  

সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী তিনি ভিডিওতে বলেন, আমার হাতে হাতকড়া পরানো ছিল, চোখ বেঁধে রাখা হয়েছিল। তারা আমাকে ধর্ষণের হুমকি দিয়েছিল... এটা স্পষ্ট যে, আমাকে ভয় দেখানোর লক্ষ্য ছিল।  

ইসরায়েল বলেছে, এসব অভিযোগ তার আইনজীবীর মাধ্যমে করা হয়েছিল। তবে বন্দি নিজেই এসব অস্বীকার করেছিলেন। উসকানির জন্য প্রিজন সার্ভিস একটি অভিযোগ দায়ের করেছে।

কিন্তু লামা খাতের টেলিফোনে বিবিসিকে বলেন, তিনিসহ অন্য নারীদের ধর্ষণের হুমকি দেওয়া হয়েছিল। দামোন কারাগারে তাদের ডরমিটরিতে টিয়ার গ্যাসও ব্যবহার করা হয়েছিল।  

প্যালেস্টানিয়ান প্রিজনারস সোসাইটি বলছে, ৭ অক্টোবরের পর কারাগারে ফিলিস্তিনি বন্দি মৃত্যুর ঘটনা স্পষ্টত বেড়েছে। ওই তারিখ থেকে ছয় বন্দি মারা গেছেন।  

ইসরায়েল বিবিসির এ সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তর সরাসরি না দিলেও বলেছে, গেল কয়েক সপ্তাহে চারটি ভিন্ন তারিখে মারা গেছেন। তাদের মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে প্রিজন সার্ভিস অবগত নয়।  

বাংলাদেশ সময়: ১৫৫১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১, ২০২৩
আরএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।