ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

জটিল ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেশি, চাপ বাড়ছে মুগদায়

ইফফাত শরীফ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০১৯ ঘণ্টা, জুলাই ৫, ২০২৩
জটিল ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেশি, চাপ বাড়ছে মুগদায়

ঢাকা: ঢাকাসহ সারা দেশে বাড়ছে এডিস মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গুর প্রকোপ। এবার বর্ষা মৌসুমের আগে থেকেই বাড়তি ডেঙ্গুর সংক্রমণ।

প্রতিদিন হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে অনেক রোগী। সংক্রমণের মৌসুম শুরু হওয়ায় এ সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

এবার ভিন্ন লক্ষণ ও জটিলতা নিয়ে বেশি রোগী হাসপাতালে আসছে। যাদের এক বা একাধিকবার ডেঙ্গু হয়েছে তাদের অবস্থা সাধারণ ডেঙ্গু রোগীর তুলনায় অনেকটাই গুরুতর বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।

বর্তমানে দুই ধরনের ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। একটি হচ্ছে ‘ক্লাসিক ডেঙ্গু সিনড্রোম’ (যেখানে রোগীর লক্ষণ থাকে জ্বর কিংবা হাত-পা ব্যথা) এবং অপরটি হচ্ছে ‘কমপ্লিকেটেড ডেঙ্গু সিনড্রোম’ (যে রোগীর এক থেকে তিনবারের বেশি ডেঙ্গু হয়েছে)। আর হাসপাতালগুলোতে ‘কমপ্লিকেটেড ডেঙ্গু সিনড্রোম’ রোগী সংখ্যা বেশি বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।

বুধবার (৫ জুলাই) সারজমিনে রাজধানীর মুগদা হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে রোগীরা ছুটে আসছেন মুগদা হাসপাতালে। হাসপাতালে ভর্তি থাকা রোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চিকিৎসাধীন ডেঙ্গু আক্রান্ত প্রায় বেশিরভাগ রোগীই যাত্রাবাড়ী, শনিরআখরা এবং মুগদা- মান্ডা এলাকার বাসিন্দা।

 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মুগদা হাসপাতালের তৃতীয়তলায় মহিলা ডেঙ্গু ওয়ার্ড, সপ্তমতলায় শিশু ডেঙ্গু ওয়ার্ড এবং নবমতলায় প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ ডেঙ্গু ওয়ার্ড।  

রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন ৩৩১ জনেরও বেশি রোগী। তাদের মধ্যে পূর্ণবয়স্ক ২৬১ জন, শিশু ৭০ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় ১১৩ জন নতুন রোগী ভর্তি হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ১ জন এবং গত ৫ দিনে মারা গেছে ৮ জন।  

ডেঙ্গু ওয়ার্ডগুলোতে গিয়ে দেখা যায়, রোগীদের জন্য নির্ধারিত শয্যা পূর্ণ হয়ে গেছে। অনেকে মেঝেতে বিছানা পেতে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তবে ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার পরও বেশিরভাগ রোগীকে মশারি ছাড়াই থাকতে দেখা গেছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এসব রোগীদের মশারির ব্যবস্থা করে দিলেও গরমের কারণে অনেক রোগী মশারি টাঙাতে অনিচ্ছা প্রকাশ করছেন।

একটা সময় ডেঙ্গুর কিছু সাধারণ লক্ষণ থাকতো, যেমন হাত-পা ব্যথা। কিন্তু বছরখানেক ধরে ডেঙ্গুর লক্ষণ পরিবর্তন হচ্ছে। প্রাথমিক পর্যায়ে রোগী বুঝতে পারছে না যে তার ডেঙ্গু হয়েছে কি না। এই ঘন ঘন ডেঙ্গুর লক্ষণ পরিবর্তনের কারণটা কি? জানতে চাইলে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) ডা. মো. নিয়াতুজ্জামান বাংলানিউজকে বলেন, প্রথমবার কোনো রোগী ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে তিনি ক্লাসিক ডেঙ্গু সিনড্রোমে আক্রান্ত হন। তখন জ্বর এবং হাত-পা ব্যথা থাকে।

তিনি বলেন, অন্য দিকে কোনো রোগীর যদি দ্বিতীয় এবং তৃতীয়বার ডেঙ্গু হয়, তখন তার এ সব সিনড্রোম কমই দেখা দেয়। কারণ তার ‘ইমিউন সিস্টেম’ (রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা) অতটা ভালো থাকে না। তখন এ সকল রোগীকে আমরা বলে থাকি ‘কমপ্লিকেটেড ডেঙ্গু সিনড্রোম’ বা ‘ক্রিটিক্যাল ডেঙ্গু সিনড্রোম’। এ ধরণের রোগীর ক্ষেত্রে ডেঙ্গুর লক্ষণগুলো স্বাভাবিক ডেঙ্গুর লক্ষণের সঙ্গে মিল থাকে না। এসব রোগীর ক্ষেত্রে প্রচণ্ড পেট ব্যথা থাকে। ঘন ঘন পাতলা পায়খানা হয়। বমির ভাব থাকে কিন্তু ওষুধ খেলেও কাজ হয় না অথবা কোনো কারণ ছাড়াই ব্লাড প্রেসার কমে যায়। রোগীর ব্যাকগ্রাউন্ড হিস্ট্রি দেখলে বোঝা যায়, বর্তমানে এই ধরনের রোগীর সংখ্যাই বেশি।

মুগদা হাসপাতালের শিশু ডেঙ্গু ওয়ার্ডে রেজিস্ট্রার খাতার হিসাব অনুযায়ী, চলতি মাসে এ পর্যন্ত ৮৩ শিশু ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছে। যার মধ্যে ছেলে শিশু ৪৩টি এবং মেয়ে শিশু ৪০টি। গতকাল থেকে আজ পর্যন্ত মোট ১৪টি শিশু ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছে। গেল এক মাসে মারা গেছে তিন শিশু।  

শনিরআখড়ার ২৪ ফিট এলাকা থেকে ৫ বছরের শিশু ইনসিয়াকে নিয়ে ডেঙ্গু ওয়ার্ডে আছেন তার মা সুবর্ণা। হাসপাতালে নির্ধারিত সিট না থাকায় মেঝেতে বিছানা পেতে চিকিৎসা নিচ্ছেন। কিছুদিন ধরে শিশু ইনসিয়ার জ্বর বমি আর ঘন ঘন পাতলা পায়খানা হওয়ায় হাসপাতালে আসেন টেস্ট করাতে। তখনই মূলত ধরা পড়ে ডেঙ্গু। কীভাবে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে জানতে চাইলে মা সুবর্ণা বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের এলাকায় প্রচুর খালি জায়গা আছে। সেখানে সাধারণত বৃষ্টির পানি জমে থাকে। তার ওপর এলাকাবাসীর সেখানে ময়লা ফেলায় মশার উৎপাত বেশি থাকে। আমাদের এলাকায় সাধারণত মশার ওষুধ খুব কম ছিটানো হয়।  

 

ঈদের ছুটিতে মা বাবার সঙ্গে কাচপুর থেকে ঢাকার মুগদায় আত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে এসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে ৯ মাস বয়সী শিশু মো ওসমান গনী। হাসপাতালে শয্যা খালি না থাকায় শিশু ওয়ার্ডের বাইরে মেঝেতে বিছানা পেতে তাকে রাখা হয়েছে। সঙ্গে তার মা- বাবা দুজই ছিল। কীভাবে ডেঙ্গু আক্রান্ত হলো জানতে চাইলে শিশুটির বাবা রমজান মিয়া বাংলানিউজকে বলেন, কারণ বলতে পারব না। তবে মুগদায় আত্মীয় বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার পর বাচ্চা অসুস্থ হয়ে পড়ে। তিন দিন ধরে জ্বর ছিল। রক্ত পরীক্ষার পর আজকে ডেঙ্গু ধরা পড়েছে।  

মান্ডা মুগদা এলাকা থেকে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ৯ বছরের শিশু শামীম, ৭ বছরের শিশু সামিরা ও আশরাফুল এবং ১০ বছর বয়সী শিশু তাহমিনা। তাদের প্রত্যেকের অভিভাবকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই দুই এলাকায় মশার উপদ্রব অনেক বেশি। দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে ডেঙ্গু মশা নিধনে জন্য তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই বলে অভিযোগ জানান এই অভিবাবকেরা।

মুগদা হাসপাতালের মহিলা ডেঙ্গু ওয়ার্ডে রেজিস্ট্রার খাতার হিসাব অনুযায়ী, চলতি মাসে এ পর্যন্ত ১০৭ জন মহিলা ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছে। যার মধ্যে গতকাল থেকে আজ পর্যন্ত ৪৪ জন মহিলা ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছে। এর মধ্যে ৮ থেকে ৯ জনের অবস্থা ক্রিটিকাল।

মহিলা ডেঙ্গু ওয়ার্ডেরও শয্যা খালি নেই। অনেক রোগী ওয়ার্ডের সামনে মেঝেতে বিছানা পেতে আছেন। ওয়ার্ডের গেটের সামনে ৩৪ নম্বর বিছানায় ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে গেল রাতে ভর্তি হয়েছে রহিমা বেগম (৪০)। বমি বমি ভাব, শরীর ব্যথা এবং জ্বরের উপসর্গ থাকায় প্রথমে স্থানীয় হাসপাতালে ডেঙ্গু পরীক্ষা করানো হয়, তখন প্লাটিলেট ছিল এক লক্ষ ৫৮ হাজার। তখন তিনি বাসায় চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। পরে অবস্থার অবনতি হলে হাসপাতালে আসেন।  

মুগদা হাসপাতালের পুরুষ ডেঙ্গু ওয়ার্ডের রেজিস্ট্রার খাতার হিসাব অনুযায়ী, চলতি মাসে এ পর্যন্ত ১৪৭ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছে। গতকাল থেকে আজ পর্যন্ত মোট ৩০ জন পুরুষ ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছে। আর গেল একমাসে মারা গেছে ৩ জন।  

এ সময় ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ার কারণ হিসেবে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) ডা. মো. নিয়াতুজ্জামান বাংলানিউজকে বলেন, ডেঙ্গু সব সময়ই হয়। যেহেতু এখন বৃষ্টি বেশি হচ্ছে তাই ডেঙ্গুর বিস্তৃতি বেশি। পাশাপাশি হয়তোবা আমরা ডেঙ্গুর প্রকোপ কমাতে পারছি না। একই সঙ্গে অনেকের ভেতর সচেতনতার অভাব আছে। বাড়ির আশপাশ পরিষ্কার না রাখা, জমে থাকা পানি সরিয়ে ফেলার ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। ঈদের সময় ঢাকা থেকে অনেক লোক গ্রামে চলে গিয়েছিল। তারপরও ডেঙ্গু বেড়েছে। তাহলে বুঝতে হবে কোথাও না কোথাও ডেঙ্গুর জীবাণুটা তৈরি হচ্ছে। তাই এখানে সিটি কর্পোরেশনসহ ব্যক্তি পর্যায়ে সবাইকে সমানভাবে কাজ করতে হবে।

তিনি বলেন, যেহেতু ডেঙ্গু মশা দিনের বেলা কামড়ায়। তাই দিনের বেলা ঘুমানোর সময় অবশ্যই মশারি টাঙিয়ে ঘুমাতে হবে। বাসায় যদি কোনো ডেঙ্গু রোগী থাকে তাহলে তাকে অবশ্যই মশারির ভেতর থাকতে হবে।  

তিনি জানান, যাত্রাবাড়ী, শনিআখড়া এবং মুগদা মান্ডা এলাকা থেকে ডেঙ্গু রোগী বেশি ভর্তি হচ্ছে। অন্য এলাকার রোগী কম।  

নিয়াতুজ্জামান বলেন, গত ২৪ ঘণ্টায় মুগদা হাসপাতালে নতুন ডেঙ্গু রোগী এসেছে ১১৩ জন। আমাদের ধারণক্ষমতার বেশি রোগী ভর্তি হয়েছে। ফলে আরও একটি ওয়ার্ড প্রস্তুত করা হচ্ছে।  

বাংলাদেশ সময়: ২০১২ ঘণ্টা, জুলাই ০৫, ২০২৩
ইএসএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।