ঢাকা: রাজধানীর ব্যাংকপাড়া হিসেবে খ্যাত মতিঝিল। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত কর্মব্যস্ততায় মুখর থাকে এই এলাকা।
বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ভোরে ঘুম থেকে উঠে কমলাপুর থেকে ট্রেনে চড়ে তারা নারায়ণগঞ্জে চলে যান। সেখান থেকে চলে যান মুন্সিগঞ্জের বিভিন্ন গ্রাম ও মহল্লায়। সেখানে দুপুর পর্যন্ত শাক ও লতা-পাতা কুড়িয়ে দুপুরের পর আবার রওনার দেন মতিঝিলের উদ্দেশ্যে। কেউ কেউ রাজধানীর মানিকদি থেকেও শাক ও লতা-পাতা সংগ্রহ করেন।
গ্রামীণ জনপদের জনপ্রিয় এসব শাক-লতাপাতার মধ্যে আছে কলমি শাক, পুদিনা, নিমপাতা, সজনে পাতা, কলার ভাদাল ও মোচা, কচুর পাতা, লতি, কচুরমুখি, হলুদ, আলু, তেলাকুচা, বতুয়া শাক, দুধলী শাক, ন্যাটাপেটা শাক, কানাই শাক, হেলেঞ্চা, চিনতন পাতা, পুঁইশাক, মিষ্টি কুমড়ার ডগা, চাল কুমড়ার ডগা, লাউ ডগা, ঢেঁকি শাক, পিপুল শাক, নটে শাক, নুনিয়া শাক, গন্ধভাদালী, শুশনী শাক, মুনসি শাক, হরি শাক, হাগড়া শাক, বকফুল, হাতিসুর। একেক জনের কাছে এসব শাকের ২০০ গ্রাম থেকে সর্বোচ্চ দুই কেজি পর্যন্ত দেখা যায়। একেকজনের বিক্রি ৩০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৭০০ টাকা পর্যন্ত হয়। এই আয়েই চলে তাদের ঝুপড়িঘরের সংসার।
শেরপুর, রংপুর ও মুন্সিগঞ্জের বাসিন্দা এ বিক্রেতাদের প্রায় ৯০ শতাংশের বর্তমান বসবাস রাজধানীর মানিকদি ও মান্দা এলাকায়। তাদের একজন মুন্সিগঞ্জের জহুরা খাতুন। বয়স ৫৫ বছরের মতো। বার্ধক্যে পৌঁছানোর আগেই যেন বুড়িয়ে গেছেন। খাবার জোটে দুবেলা। যত্নহীন বিপর্যস্ত শরীর। পরনে ময়লা জীর্ণ-শীর্ণ শাড়ি। স্বামী মারা গেছেন কয়েক বছর আগে। সংসারে তিন ছেলে দুই মেয়ে। নিজের পরিশ্রমে এ সন্তানদের বড় করেছেন। জমি-জিরাত বলতে স্বামীর কিছুই ছিল না। পথের ধারে মাথার গোঁজার মতো একটি ঠাঁই তার সম্বল। এই লতা-পাতা আর শাক বিক্রি করে জীবন চলে তার। মুন্সিগঞ্জে যাতায়াতে একশ থেকে দেড়শ টাকা খরচ হয়ে যায়। এরপর যা বাঁচে তাতে কোনোমতে চালিয়ে নেন সংসার।
জহুরা জানান, তিন ছেলের বিয়ের পর তারা আলাদা সংসার পেতেছে। ছেলেদের কম আয় বলে তারা নিজের সংসার চালাতেই হিমশিম খায়। সেজন্য ছেলেদের সহায়তার আশাও করেন না। দুই মেয়ে নিয়ে জহুরা চালিয়ে যাচ্ছেন জীবন সংগ্রাম।
তিনি জানান, সকালে ঘুম থেকে উঠে মুন্সিগঞ্জে নিজের মহল্লার পতিত জমিতে বিভিন্ন ধরনের শাকসহ ওষুধি লতাপাতা সংগ্রহ করেন। দুপুর হলেই এসব শাক-সবজি নিয়ে মতিঝিলে রওনা দেন। যেভাবেই হোক, বিকেল ৪-৫টার মধ্যে পৌঁছানোর তাগাদা থাকে। কারণ এসব পণ্যের ক্রেতা অফিসফেরত বাসামুখী মানুষ। সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত তারা অফিস থেকে বের হন এবং বিক্রিও হয় তখন পর্যন্ত।
নদীভাঙনে সর্বস্ব হারিয়ে, কিংবা স্বামী মারা যাওয়া বা অসুস্থ হওয়ার কারণে সন্তান-পরিজন নিয়ে বেঁচে থাকার সংগ্রামে এমন অনেক নারী এভাবে শাক ও লতাপাতা বেচাবিক্রি করেন এখানে। এমনই এক নারী অনন্যার মা। বয়স ৩০-এর কাছাকাছি। তিনি কিছুতেই নিজের নাম বলতে চাইলেন না। এই নারী বাজারে এসেছেন তার ৯-১০ বছরের মেয়েকে সঙ্গে করে। তার কাছে থানকুনি, পুদিনাসহ পুকুর পাড়ের নাম না জানা বেশ কয়েক রকমের লতা-পাতা দেখা যায়। নিজের মতো কিছু লতার নামও বললেন। শাক ও লতা-পাতার সঙ্গে ফুলও রাখা। ফুলগুলো মেয়ে অনন্যা এনেছে।
অনন্যার নামটি ভুল বললে রাগ করেন তার মা। অনিশ্চয়তার জীবন। রোদ-বৃষ্টিতে পুড়ে-ভিজে রোগে-শোকে কষ্ট করেন। তবু আত্মসম্মান হারাতে চান না। সেজন্য নাম ঠিকভাবে বলে দুঃখ প্রকাশ করলে মান ভাঙে তার।
অনন্যার মা জানান, শাক ও লতা-পাতা বিক্রি করে নিজের সংসার চালান। শাক সংগ্রহের কাজে সাহায্য করে ছোট্ট মেয়েটা। দুজন মিলে শাক কুড়ানোর কারণে তার আয়টা একটু বেশি হয়, ছয়-সাতশ টাকা। স্বামীসহ মান্দায় একটি ঝুপড়িতে তাদের বসবাস। স্বামী রিকশা চালান। অসুস্থতার কারণে অধিকাংশ সময় ঘরেই বসে থাকেন। মা যখন দোকানে শাক বিক্রি করেন, অনন্যা তখন স্টাফ বাসের দরজায় বসে বেলুন ওড়ায়।
বাবা-মায়ের অসুস্থতার কারণে সংসারের হাল ধরতে শাক সংগ্রহ ও বিক্রির করতে দুয়েকজন কিশোর-তরুণকেও দেখা যায় ব্যাংকপাড়ার এই বাজারে। এদেরই একজন নাফিজ আহমেদ সৌরভ (১৯)। বাড়ি শেরপুর। বাবা-মাকে নিয়ে রাজধানীর মান্দায় থাকেন। সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়া সৌরভ পোশাক-আশাকের ব্যাপারে সচেতন।
সৌরভ জানান, তিনি ভোরে ঘুম থেকে উঠে ট্রেনে চড়ে নারায়ণগঞ্জে যান। সেখান থেকে বাসে চলে যান মুন্সিগঞ্জ। ওখানকার প্রত্যন্ত এলাকায় দুপুর পর্যন্ত শাক ও লতাপাতা তুলে আবার ঢাকার মতিঝিলের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। তার প্রতিদিন বিক্রি হয় ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা।
গত আগস্টে শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবির আন্দোলনে ছিলেন কি না, এমন প্রশ্ন করতে চোখ দুটি যেন চিক-মিক করে উঠে সৌরভের। বলেন, ‘গিছি মানে (অবশ্যই গিয়েছি)! গেছি তো। তখন প্রায়ই মুন্সিগঞ্জে যাওয়া যেতো না। এটা-ওটা করছি আর মিছিলে গেছি। ’ কথার ফাঁকে আন্দোলনের সময়কার নিজের একটি ছবিও দেখান সৌরভ।
বাংলাদেশ সময়: ১৭১৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৩, ২০২৪
জেডএ/এইচএ/