ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে

নদীপথে সুন্দরবন স্মৃতি হয়ে থাক

ভাস্কর সরদার, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২৩৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৮, ২০১৬
নদীপথে সুন্দরবন স্মৃতি হয়ে থাক সুন্দরবন / ছবি: আবু বকর

ছোটবেলায় পরিবারের সঙ্গে গিয়েছিলাম সুন্দরবন। অবশ্যই পশ্চিমবঙ্গের অংশে। সেবারও ছিলো শীতকাল। মনে আছে, আমার দাদী নৌকায় উঠে চোখ আর নাক বাদে গোটা শরীর ঢেকে দিয়েছিলেন।

ছোটবেলায় পরিবারের সঙ্গে গিয়েছিলাম সুন্দরবন। অবশ্যই পশ্চিমবঙ্গের অংশে।

সেবারও ছিলো শীতকাল। মনে আছে, আমার দাদী নৌকায় উঠে চোখ আর নাক বাদে গোটা শরীর ঢেকে দিয়েছিলেন। কাঁধব্যাগ থেকে এককোয়া গোটা রসুন আর এক চামচ মধু খাওয়ানোর জন্য জোর করে বলছিলেন, ঠাণ্ডা লাগবে না। আর ঠাণ্ডা না লাগলে অনেকক্ষণ নৌকায় থাকতে পারবো।  

মাঝি বলে চলছিলেন নানা গল্প। এই নদীপথেই নাকি যাতায়াত করতেন বেহুলা-লখিন্দরের চাঁদ সদাগর। গভীর অরণ্যে তার তৈরি ভগ্নপ্রায় শিব মন্দিরে নাকি বাঘের মজলিস বসে।  

দাদীর কথা মেনে নিয়েছিলাম অনেকক্ষণ সুন্দরবনের কোলে থাকবো বলে আর মাঝির গল্পও মন দিয়ে শুনেছিলাম। মনে আছে, ধীরে ধীরে গরম লাগলেও শুধু মাথার কাপড়টা খুলতে পেরেছিলাম। এর কারণ, দাদীর কড়া নজর।

সুন্দরবন

দ্বিতীয়বার গিয়েছিলাম বর্ষাকালে। এক এনজিও’র সঙ্গে সাপ নিয়ে কাজ করতে। এরপর একাধিকবার সুন্দরবন গেলেও এই স্মৃতি দু’টো ভুলতে পারিনি।  

মনে আছে, নৌকায় বসে আছি। মাঝি অনেকখানি এনে বললেন ওই দেখুন, বাংলাদেশ সীমানা। আমি বলেছিলাম, বাংলাদেশ কই, ওটাও তো আমাদের মতো পানি। জেদ ধরেছিলাম আমি বাংলাদেশ দেখবো। দাদী বলেছিলেন, এখন এটা দেখ বড় হয়ে বাংলাদেশ দেখবি।  

নৌকায় উঠে উদীয়মান সূর্য দেখতে দেখতে মনে পড়ছিল সেসব কথা। কিছুটা ইচ্ছা করেই গায়ের শীত বস্ত্রটা খুলে অনুভব করার চেষ্টা করছিলাম, সেদিনের রসুন আর মধুর মিশ্রণে হয়ে ওঠা গরমটা। শুধু পাশে নেই আমার দাদী। কিছুদিন আগেই চলে গেছেন না ফেরার দেশে। মনে মনে বলছিলাম, দাদী দেখো, বড় হয়ে বাংলাদেশ দেখছি আর সেই সুন্দরবনও। শুধু তুমি পাশে নেই।

সুন্দরবন

দূর থেকে মনে হচ্ছিল, সারারাত শীতে কেঁপে সুন্দরী গাছের পাতা বেয়ে কুয়াশার ফোঁটা অশ্রুবিন্দু হয়ে ডুব দিচ্ছিল নদীতে। আর সেই কারণে নদীর পানি যেনো নোনা হয়ে উঠেছে। গঙ্গা, পদ্মা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্র এই চার নদীর বেষ্টনে সুন্দরবন। তবু পানি নোনতা।  

যাত্রা শুরু হয়েছিল শ্যামনগর উপজেলায় খোলপেটুয়া নদীর নীলডুমুর ঘাট থেকে। জলপথে, নৌকার সওয়ারি হয়ে। অরণ্যের শীতের চেহারা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না যে, কুয়াশায় ঢাকা সবুজ জঙ্গল কিছুটা যেনো শেষ রাতের স্বপ্নের মতো। স্পষ্ট না হলেও তার প্রবল উপস্থিতি জানান দেয় প্রতি মুহূর্তে। পাহাড়ের প্রতি বাঁকে যেমন থাকে এক একটা চমক, অরণ্য ঠিক তেমন নয়। একটানা লক্ষ্য করলে বোঝা যায়, অরণ্য তার চরিত্র বদলায় খুব ধীরে ধীরে।

বিশ্বের ৭৪টি দেশের ২৬৯টি বায়োস্ফিয়ার অঞ্চলের মধ্যে বৃহত্তম বায়োস্ফিয়ার সুন্দরবন। জলপথ ধরে আমারা এগোচ্ছিলাম বৃহত্তম বায়োস্ফিয়ারের অন্দরে। ঘোলা জলে মোটরচালিত নৌকায় যেতে যেতে দেখছি দু’পাশের অরণ্য কখনও গভীর আবার কখনও কিছুটা হালকা। নদীর পাড়ে কখনও চোখে পড়ছে বাঁদর, কখনও কয়েকটা হরিণ।  

তবে জলে ‘কুমির আর ডাঙায় বাঘ’ বলে যে বাংলা প্রবাদ রয়েছে, সেটা বোধহয় সুন্দরবনের মানুষ হাড়ে হাড়ে অনুভব করেন। এমনকি বন রক্ষীরাও জানালেন, রাতে তারা বাঘের ভয়ে ভয়ে থাকেন। মাঝিদের জলেই সংসার। নৌকার মধ্যেই রান্নাবান্নার বেশ পরিপাটি ব্যবস্থা করে নিয়েছেন তারা।

সুন্দরবন

নৌকায় মাঝে মধ্যে আক্ষেপের সুর। বন্যপ্রাণীর দেখা মিলছে না কেন! আমার মতো শীতের সকালে তার কি একটু ‘লেট রাইজার’? বোধহয় নয়। ঘন অরণ্যের ভিতর দিয়ে বয়ে চলা নদী, তাতে মোটরচালিত নৌকার শব্দ, উৎসাহী পর্যটকদের উঁকিঝুঁকি, কথাবার্তার শব্দ বন্যপ্রাণীদের খুব ভালো লাগবে না সেটা অনুভব করাই যায়।  

অল্প দূরেই বঙ্গোপসাগর তাই গঙ্গা, পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা- এই চারটি নদীর পানি এখানে কিছুটা নোনা। আর পানি নোনা বলেই সুন্দরী গাছের শ্বাসমূলগুলো উপরের দিকে। শ্বাসমূল গাছের শেকড়ের একটি অংশ। ভাটার সময় উপর দিকে থাকা সুন্দরী গাছের শ্বাসমূল হা করে অক্সিজেন নেয়।  

ধীরে ধীরে কুয়াশা সরে গিয়ে পরিষ্কার হলো গভীর অরণ্য। এক গাছ থেকে অন্য গাছে বাঁদরের লম্ফঝম্প দেখে মনে হলো, শীতের সকালে তারা বেশ খোশ মেজাজেই রয়েছে। গাছে গাছে পাখিদের গল্পগুজব কানে ভেসে আসছিল।  

১০ হাজার স্কোয়ার কিলোমিটার অঞ্চল নিয়ে বিস্তৃত বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট ভারত ও বাংলাদেশে ছড়িয়ে। এখানে দেখার রয়েছে আরও অনেক কিছু, তার চেয়েও বেশি অনুভব করার। তবে যা চোখের সামনে ধরা দিলো সেটা সযত্নে থাকবে মনের মণিকোঠায়, অত্যন্ত মূল্যবান স্মৃতিগুলোর সঙ্গে।

বাংলাদেশ সময়: ০৮৩৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৮, ২০১৬
ভিএস/এসএনএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে এর সর্বশেষ