ঢাকা, রবিবার, ১৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে

হাজারো অভিযাত্রীর পাহাড়জয়ের গাইড সাদেকের গল্প

শামীম হোসেন, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫২০ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৮, ২০১৬
হাজারো অভিযাত্রীর পাহাড়জয়ের গাইড সাদেকের গল্প ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

কেওক্রাডং-বগালেক (বান্দরবান) থেকে ফিরে: পাহাড়ি পথে ট্রেকিং করার ইচ্ছে থাকলে সঙ্গে অবশ্যই একজন গাইড নিতে হবে। গাইড ছাড়া দুর্গম উঁচু-নিচু পাহাড়ি পথে চলা অসম্ভবই বটে।

তাছাড়া, স্থানীয় প্রশাসনও গাইড় ছাড়া কোনো পর্যটককে দুর্গম পথে যাওয়ার অনুমতি দেয় না।

দেশের অন্যতম শীর্ষ পর্বত কেওক্রাডংয়ের চূড়ায় আরোহনের যাত্রায় সেজন্য শরন্নাপন্ন হতে হলো গাইডের। দেশের সবচেয়ে উঁচু স্বাদু পানির হ্রদ বগালেক হয়ে কেওক্রাডংমুখী পাঁচ সদস্যের অভিযাত্রী দলে একমাত্র অভিজ্ঞ ট্রেকার রিয়াসাদ সানভী। তিনিই আগে থেকে যোগাযোগ করে গাইড হিসেবে সাদেককে বেছে নিয়েছেন।

রুমা বাজার থেকে বগালেক হয়ে কেওক্রাডং আরোহন এবং সেখান থেকে ফিরে আসার পথটায় এই সাদেকই দিয়েছেন নির্দেশনা-পরামর্শ। প্রায় তিন দিন দুই রাত একসঙ্গে চলাফেরায় এই সাদেক বলেছেন তার জীবনের গল্প, গাইড হয়ে ওঠার গল্প।

পুরো নাম সাদেক হোসেন। বয়স ২৩-২৪ বছর হবে। ১২ বছর বয়স থেকেই পরিশ্রম আর অ্যাডভেঞ্চারের গাইড পেশা বেছে নিয়েছেন তিনি। রুমা উপজেলায় তার মতো আরও ৫০-৬০ জন গাইড রয়েছেন। তবে সেই গাইডদেরও মতে, অভিজ্ঞতা এবং জ্ঞানের দিক থেকে সাদেকই সেরা।

বিশ্বের যেকোনো দেশে ট্যুরিস্ট গাইড একটি সম্মানজনক পেশা। এ পেশা যেমন পরিশ্রমের, তেমনি অ্যাডভেঞ্চারাস, তেমনি জ্ঞান-লোককথা চর্চারও। গাইড হিসেবে একজন পর্যটকের সব জিজ্ঞাসার উত্তর গাইডের কাছে থাকতে হয়। এই যোগ্যতা আছে বলেই তো সাদেক সবার কাছে সেরা বলে স্বীকৃত।

২০০২ সাল। সাদেক তখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়েন। প্রথমবারের মতো সেনাবাহিনীর সঙ্গে বগালেক যান। সেই অ্যাডভেঞ্চারের যাত্রা থেকেই পেশায় গাইড হয়ে উঠলেন সাদেক।

সাদেকের ভাষায়, “ওই সময় খুব কম লোকই এ পথে ট্রেকিং করতে আসতো। এসে তারা একজন সহযোগী খুঁজতো। যে তাদের পথ দেখিয়ে বগালেক অথবা কেওক্রাডং নিয়ে যাবে। তখনো গাইড কী জিনিস বুঝতাম না। রোমাঞ্চকর অনুভূতি আর শখের বশে ট্যুরিস্টদের সঙ্গে যেতাম। ফিরে এসে তারা কখনো এক-দেড়শ‘ টাকা দিতেন। তবে নিজেকে তখনো গাইড হিসেবে ভাবতাম না। তাদের সঙ্গ দিতে পেরে আমার বেশি ভালো লাগতো। ”

“একদল পর্যটককে পথ দেখিয়ে তাদের গন্তব্যে নিয়ে যাওয়ার অনুভূতি আমার কাছে অন্যরকম ছিল। তখন ঝিরির পথে রুমা খাল ধরে হাঁটতে হতো। রাস্তা বা গাড়ির ব্যবস্থা তেমন ছিলো না। ঝিরিপথটা অনেক সুন্দর ছিল। “

সাদেক অনুভূতি প্রকাশ করেন, “তখন ট্যুরিস্ট কী জিনিস বুঝতাম না। এখন মানুষের ভালোবাসায় মিশে গিয়েছি। পুরোপুরি গাইড হিসেবে কাজ করছি। আনন্দ-ভালোবাসায় পড়ে যাওয়ার পর আর গাইডিং ছাড়া হয়নি। পেশাটা বেশ পরিশ্রমের। তবু এ পেশা ছাড়ার ইচ্ছে হয় না। ”

শুরুর দিকটার কথা বলেন সাদেক, “সেসময় আমরা হাতেগোনা কয়েকজন পর্যটকদের সঙ্গে কাজ করতাম। এখন রুমায় ৬০-৭০ জন জন গাইড হিসেবে কাজ করছে। আগে গাইডদের তিনটি সংগঠন ছিল, তবে এখন কোনো সংগঠন নাই। প্রশাসনের পক্ষ থেকে নাকি একটি সংগঠন করে দেবে। নামও দেবে। কিছুদিনের মধ্যে সরকার নতুন করে কার্ড দেবে। ”

তবে গাইড হিসেবে সাদেকদের পেশাটা ৪-৫ মাসের বলা যায়, যখন পর্যটনের মৌসুম থাকে, তখনই তাদের ব্যস্ত শিডিউল থাকে। বাকি সময়টায় জীবিকা নির্বাহে কিছুটা সংগ্রাম করতে হয়। তখন কেউ রাজমিস্ত্রির কাজ করেন তো, কেউ নদীতে বালু তোলার কাজ করেন, আবার কেউ গাড়িতেও কাজ করেন।

সাদেকের ভাষ্যমতে, তিনি ছাড়াও বান্দরবানের পাহাড় ট্রেকিংয়ে তৌহিদুল ইসলাম, বেলাল, আলমগীর, নুরুল ইসলাম, আলী, লিটন দাশসহ বেশ কয়েকজন গাইড সুনামের সঙ্গে কাজ করছেন।

বছরের অক্টোবর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত পর্যটনের ভর মৌসুম থাকে। এসময়টাতে প্রতিমাসে গড়ে ১০ বারও বগালেক-কেওক্রাডং আসা-যাওয়া হয় সাদেকদের। এছাড়া, অন্যতম শীর্ষ চূড়া সাকাহাফং (বিতর্কসাপেক্ষে সর্বোচ্চ), জাদিপাই, তিন্দুসহ উঁচু উঁচু পাহাড়েও যাওয়া হয় তাদের।  

সাদেক বলেন, “যখন ট্যুরিস্টদের নিয়ে লং ট্যুরে যাই তখন সাত-আট দিন ট্রেকিং করি, তখন খুব ভাল লাগে। রাস্তা থেকে কাঁচা খাবার নিয়ে বা কিনে রান্না করে খাওয়াটা খুবই দারুণ লাগে। সব মিলিয়ে পর্যটকদের সন্তুষ্ট করে বিদায় দিতে পারলেই আমার ভাল লাগে। ”

পর্যটকদের ভালো নিয়ে চিন্তা করা সাদেকদেরও ভালো নিয়ে পদক্ষেপ নিতে সরকার বা প্রশাসনের পদক্ষেপ নেওয়া দরকার বলে মনে করেন পর্যটকরা।

কয়েকজন পর্যটক বলেন, সাদেক-বেলাল-তৌহিদুলদের পেশায় ধরে রাখতে হলে তাদের পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করে দিতে হবে। অফ সিজনে তাদের বিশেষ ভাতা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়া, নিয়মিত ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে তাদের আরও দক্ষ করে তুলতে হবে। পাহাড়ে ট্রেকিংয়ের সময় কোনো পর্যটক যদি অসুস্থ হয়ে পড়ে, তাহলে প্রাথমিক চিকিৎসা কী হওয়া দরকার সে বিষয়েও গাইডদের ট্রেনিং দেওয়া প্রয়োজন। সবমিলিয়ে প্রয়োজন একটি সমন্বিত নীতিমালা।

বাংলাদেশ সময়: ১৫১১ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৮, ২০১৬
এসএইচ/এইচএ/জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে এর সর্বশেষ