ঢাকা, রবিবার, ১৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ট্রাভেলার্স নোটবুক

মেঘের দেশে ঝরনার গান ডোবায় গভীর মোহে

প্রশান্ত মিত্র, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৪৬ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৭, ২০১৯
মেঘের দেশে ঝরনার গান ডোবায় গভীর মোহে যতদূর দৃষ্টি যায়, ঠিক ততদূর মেঘ আর পাহাড়, থেকে থেকে আবেশে ডোবায় ঝরনার গান। ছবি: প্রশান্ত মিত্র

মেঘালয় থেকে ফিরে: ২৭ আগস্ট ভোরে ঘুম ভাঙতে দরজা খুলতেই চোখ কপালে ওঠার মতো অবস্থা। চোখের সামনে মেঘেদের ছোটাছুটি, খানিকটা দূরে পাহাড়ের বুকে ঝরনা। কে জানে, সারাদিনে আরও কী কী মুগ্ধতার পসরা সাজিয়ে রেখেছে প্রকৃতি। দ্রুত তৈরি হয়ে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম সবাই। রাতেই অর্ডার করে রাখা নাস্তা দিয়ে গেলেন বাড়ির মালিক অর্লিন। নাস্তা সেরে আবার গাড়িতে উঠে বসলাম। সারাদিনের প্ল্যান বুঝিয়ে দিতে দিতে গাড়ি এগিয়ে চলছে, আর ক্রমেই বিস্ময়কর প্রকৃতি বিস্মিত করে চলেছে।

কথা প্রসঙ্গে গাড়ি চালক রহমান জানালেন, প্রাচীন রাজাদের একেক এলাকাকে একেকটা পুঞ্জি বলা হতো। তেমনি এ এলাকার একসময়ের রাজার মেয়ের নাম ছিলো ‘সেহরা’।

মেয়ের নামানুসারে এ এলাকার নামকরণ হয় সেহরা পুঞ্জি। সে থেকেই বিবর্তন হয়ে এলাকার নাম হয়ে যায় ‘চেরাপুঞ্জি’। ‘ডেইনথেলেন ফলস’।  এর ওপরে দাঁড়ালে পানি গড়িয়ে নিচে পড়তে দেখা যায়।  ছবি: প্রশান্ত মিত্র রাস্তার দুই পাশে পাহাড়ের সারি দেখে ছোটবেলা থেকে কম্পিউটারের স্ক্রিনে উইন্ডোজের ছবিটার কথা মনে পড়লো। গাড়ি চলতে চলতে কখনো মেঘের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। গাড়ির জানালা দিয়ে মেঘের দল ছুটে আসছে, হাতে ছুঁয়ে দেখছি মেঘ। আবার কখনো আমরা মেঘের ওপরে, আমাদের খানিকটা নিচে পাথুরে পাহাড়ের বুকে মেঘের ছোটোছুটি। এ যেন যতদূর দৃষ্টি যায়, ঠিক ততদূর মেঘ আর পাহাড়।

চলতে চলতে প্রথমে এসে থামলাম ‘ডেইনথেলেন ফলসের’ কাছে। এর আগে সব ঝরনা সামনে থেকে দেখলেও এবার আমরা যেখানটায় এসেছি, ঠিক সেখান থেকে পানি গড়িয়ে নিচে পড়ে যাচ্ছে। বিশাল একটা পাথুরে মাঠ হয়ে পানি গড়িয়ে খাড়া হয়ে অনেক দূর নিচে গিয়ে পড়ছে। অর্থাৎ আমরা ঝরনার ওপরের অংশটা থেকে দেখছিলাম।

এরপর ‘ওয়াহ কাবা ফলস’ এবং ‘নেহাকালাইকাই ফলস’ দেখতে গেলাম, কিন্তু প্রকৃতি আমাদের পক্ষে ছিল না। দীর্ঘ সময় বৃষ্টি না হওয়ায় পাহাড়ের ওই ফাঁকা অংশটাতে এত পরিমাণ মেঘ জমেছিল, ঝরনা আর দেখা যাচ্ছিল না। অপেক্ষা না করে ‘সেভেন সিস্টার্স ফলস’র দিকে পা বাড়ালাম। সেখানে গিয়েও মেঘের বিপত্তি, তবে এবার আমরা কিছুটা অপেক্ষা করার পক্ষে। পাশেই ছোট একটা ঝরনাতে ঘোরাঘুরি করতেই শোনা গেল ‘সেভেন সিস্টার্স’র মেঘ সরে যাচ্ছে। দৌঁড়ে গিয়ে মেঘের ফাঁকে ফাঁকেই বিখ্যাত ‘সেভেন সিস্টার্স ফলস’ দেখতে থাকলাম। নংরিয়েত গ্রামে ‘ডাবল ডেকার লিভিং রুট ব্রিজ’।  ছবি: প্রশান্ত মিত্রএবার মাওসমাই ইকো পার্ক হয়ে ‘সেভেন সিস্টার্স’র গোড়ার দিকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হলো। কিন্তু কাছে গিয়ে এবার মেঘ আরেকটু বেশি মনে হলো। কাছ থেকে সেভেন সিস্টার্স দেখা হলো না। বেলা ৩টা নাগাদ ইকোপার্কের ভেতরেই একটা রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ সেরে রওনা দিলাম ‘মাওসমাই কেভ’র দিকে। বলা যায়, মেঘের মধ্যে বসে লাঞ্চ করলাম।  দেশে মশাল হাতে আলুটিলা গুহা পাড়ি দেওয়ার অভিজ্ঞতা ছিল, সে হিসেবে গুহা বড় বিবেচনায় একটু বাড়তি প্রস্তুতি আমাদের। কিন্তু এই গুহা বড় হলেও গা ছমছমে ব্যাপার নেই। ভেতরে লাইট দিয়ে পুরোটাই আলোকিত করে রাখা। মাঝখানে পথ কিছুটা সরু থাকলেও পার হতে বেগ পেতে হয়নি।

আজকের প্ল্যানের সবকিছুই ঘোরা হলো, মাঝখানে দুইটা ফলস দেখা হয়নি শুধু। দিনের এখনো ঘণ্টাদুই বাকি থাকায় এবং চেরাপুঞ্জির কাছে হওয়ায় ‘ওয়াহ কাবা ফলস’র দিকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হলো। দ্বিতীয় চেষ্টায় এবার ওয়াহ কাবার দেখা পেলাম। ফলসের ভিউ পয়েন্ট থেকে বিকেলটা বেশ লাগছিলো। সূর্য বিদায় বিদায় বলছিল, ঠাণ্ডা নামছিল কিছুটা। আকাশটা গাঢ় নীল। মেঘের নাচনের সঙ্গে ঝরনার ‍গুঞ্জন। আসলে সময়-কাল ভেদে সুন্দরেরও রকমফের আছে মনে হলো এখানে।

সন্ধ্যার পর ঘরে ফিরে বাড়ির মালিক অর্লিনের কথায় ড্রাইভারের ওপর বেশ রাগ হলো। তিনি সকালে বের হওয়ার সময় তিন স্টেপের ‘উইসডং ফলসে’ যাওয়ার কথা বলেছিলেন। কিন্তু ড্রাইভার আমাদের নিয়ে যাননি। যাই হোক, পরেরদিন আমাদের ডাবল ডেকার রুট ব্রিজ প্ল্যান থাকলেও সকালেই উইসডং ফলস হয়ে সেখানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।

২৮ আগস্ট সকালে যথারীতি গাড়িতে উঠেই ‘উইসডং ফলসে’ যাওয়ার কথা বললাম। যাকে বাঙালি সঙ্গী বলে প্রথমদিন আশ্বস্ত হয়েছিলাম, তার বিরক্তি প্রকাশের ভাষায় সব সাধ মিটে গেলো। খানিক বাক-বিতণ্ডার পর ড্রাইভার উইসডংয়ের দিকে রওনা দিলেন। ডেইনথেলেন ফলস পেরিয়ে ১৫ মিনিটের মতো সামনে গেলেই উইসডং ফলস। প্রধান সড়ক থেকে খাঁড়া ১০ মিনিট নিচে নামার পর যা দেখলাম, তা আসলেই অবিশ্বাস্য। এতো সুন্দর ঝরনা আসলেই জীবনে এখনো দেখা হয়নি। তিনটা ধাপে নীলাভ পানি গড়িয়ে পড়ছে। এবার আরেকটু ‍ঘুরে নিচের দিকে নেমে ঝরনার গোড়ার দিকটাতে গেলাম। দেরি না করেই নেমে পড়লাম। বেয়ে বেয়ে খানিকটা ঝুঁকি নিয়েই দ্বিতীয় স্টেপ পর্যন্ত যেতে পেরেছিলাম। ঘণ্টাখানেক উইসডংয়ে লাফালাফি শেষে উপরে উঠতে উঠতে ভাবছিলাম, যেটা দেখলাম এর চেয়ে সুন্দর ঝরনা আর দেখা সম্ভব কী?উইসডং ফলস।  ছবি: প্রশান্ত মিত্রএবার গাড়িতে উঠে নংরিয়েত গ্রামে ‘ডাবল ডেকার লিভিং রুট ব্রিজের’ উদ্দেশ্যে যাত্রা। সেখানে যেতে গাড়ির ভ্রমণের পথটা ছিল তিনদিনের সবগুলো পথের চেয়ে সেরা। প্রায় পুরোটা পথই আমরা মেঘের ভেতর দিয়ে সামনে এগিয়েছি। গাড়ির জানালা দিয়ে হাত বের করলেই মেঘ ধরার অনুভূতিও পেয়েছি সবচেয়ে ভালো। প্রায় দুই ঘণ্টার চলার পর আমাদের ট্র্যাকিং পয়েন্টে এসে নামলাম। এখান থেকে ডাবল ডেকারে যেতে সাড়ে তিন হাজার সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে হবে।

স্থানীয় গাইড ড্যানিকে নিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু। কিছুদূর নামার পর নংরিয়েত গ্রামটি দেখে বোঝা গেলো, একটি পাহাড় থেকে আমরা নামছি, মাঝখানে আরেকটি পাহাড় বেয়ে তৃতীয় পাহাড়ে সেই গ্রাম। পাহাড়ের ঢালে ঘন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে এই ‘সিঁড়িযাত্রা’ ছিল আসলেই রোমাঞ্চকর। কিছুক্ষণ পরপর পাহাড়ি ঝিরির শব্দ বাড়তি রোমাঞ্চ দেবে। তিনভাগের দুইভাগ পথ পাড়ি দেওয়ার পর সবচেয়ে লম্বা লিভিং রুট ব্রিজের দেখা মিললো।

শেষ পর্যন্ত ডাবল ডেকার রুট ব্রিজে যাওয়ার পর ভাবলাম নিচের দিকে নেমেই পা সোজা রাখা যাচ্ছে না, উঠবো কীভাবে? যাই হোক, গাছের শেকড়ের দোতলা সিঁড়ি বিস্ময় ভরে দেখে ফেরার ক্লান্তি বিবেচনায় আসেনি।  ব্রিজের সামনের ঝরনায় কিছুক্ষণ পা ডুবিয়ে এবার ফেরার পালা। খানিক পর পর বিশ্রাম নিয়ে নিয়ে উঠে এলাম খাড়া সিঁড়ি বেয়ে। কিন্তু এ যাত্রায় যা দেখেছি, তাতে ক্লান্তি কোনো বিষয়ই নয়।

গাড়িতে চেরাপুঞ্জিতে ফিরতে ফিরতে ভাবছিলাম, রাত পোহালেই শিলংয়ের দিকে রওনা দেবো। চেরাপুঞ্জিতে সময় শেষ হয়ে এলো বলে। চারদিনের জন্য গাড়ি ঠিক করা হলেও সকালের ঘটনায় চেরাপুঞ্জিতে ফিরেই রহমানকে বিদায় করে দিলাম। পরের দিনের জন্য স্থানীয় একজনের গাড়ি ঠিক করা হলো। রাতে ঝুম বৃষ্টি শুরু হলো, আর ভাবলাম চেরাপুঞ্জির প্রায় সব রূপই দেখে গেলাম।

২৯ আগস্ট সকালে বাড়ির মালিক অর্লিনের সঙ্গে হিসাব চুকে শিলংয়ের পথে যাত্রা শুরু। নতুন ড্রাইভার বা-জুপের সঙ্গে ‘মাওসভা ফলস’, ‘গার্ডেন অব কেভ’, ‘মকডক ভিউ পয়েন্ট’ এবং শিলংয়ের কাছে ‘এলিফ্যান্ট ফলস’ ও ‘উমিয়াম লেক’ ঘুরে দেখলাম। দুইটা ফলস দেখেছি ঠিকই, সুন্দরও লেগেছে। কিন্তু ‘উইসাডং ফলস’ দেখার পর বিখ্যাত ‘এলিফ্যান্ট ফলস’ও বেশি কিছু মনে হয়নি। এর মধ্যে মকডক ভিউ পয়েন্ট ছিল অদ্ভুত সুন্দর। এখান থেকে বেশকিছু পাহাড়ের মাঝ বরাবর অনেকদূর পর্যন্ত দেখা যায়। সারি সারি পাহাড়ের মাঝখানে সুবিশাল ‘উমিয়াম লেক’ও ছিল বিস্ময়ে ভরা। মেঘের রাজ্য মেঘালয়।  ছবি: প্রশান্ত মিত্রসূর্যাস্তের সময়টা লেকের ধারে কাটিয়ে শিলং শহর তথা ‘অমিত-লাবণ্যর’ শহরের দিকে রওনা দিলাম। সন্ধ্যায় শিলং শহরের পুলিশ বাজারে নেমেই কাছাকাছি একটা হোটেলে থাকার জোগাড় হলো। হোটেল রুমে ব্যাগ রেখেই শহরটা ঘুরে দেখতে বেরুলাম। আমাদের দেশের অনেক উপজেলা শহরও মেঘালয়ের রাজধানী শিলংয়ের চেয়ে জমজমাট। শহরে ‘বঙ্গিয় সাহিত্য পরিষদ’ দেখে কিছুটা ভালো লাগা কাজ করছিল। আসাম-ত্রিপুরা এবং সিলেটের অনেক বাঙালির সঙ্গে কথা হলো। বেশিরভাগই ছোট-বড় ব্যবসা করছেন। পরদিন সকালেই দেশে ফেরার পালা। সে অনুযায়ী সকালে নাস্তা সেরে গাড়ি ঠিক করে ডাউকির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। তবে সময়ের অভাবে লাইটলুম এবং শ্নোনেংপেডেংয়ে না যেতে পারার সামান্য আক্ষেপ পিছু নিয়েছে ফিরতি পথে।  পাহাড়ের ভেতর দিয়ে আমাদের ফিরতি যাত্রা চলছে আর ভাবছি, এই পাহাড় এই মেঘগুলোকে রেখে গেলাম।

আবার হয়তো আসবো এই মেঘালয়ে, হয়তো শিলং-চেরাপুঞ্জির বুকে মেঘের মধ্য দিয়ে হেঁটে যাবো। আবারও হয়তো বুনো ঝরনায় মুগ্ধ হয়ে ডুবে থাকবো কয়েকটা দিন। কিন্তু এবারের মতো বিদায় বলতেই হচ্ছে। তবে প্রকৃতির কিছু সুন্দর মুহূর্ত নিয়ে ফিরছি, একবুক প্রশান্তি নিয়ে ফিরছি। ভালো থেকো মেঘালয়, ভালো থেকো শিলং-চেরাপুঞ্জি...

বাংলাদেশ সময়: ০৯৩৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৭, ২০১৯
পিএম/এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।