ঢাকা, রবিবার, ১৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ট্রাভেলার্স নোটবুক

মধুপূর্ণিমায় জ্যোৎস্না-স্নান টাঙ্গুয়ার হাওরে

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৩১ ঘণ্টা, আগস্ট ২৪, ২০১৯
মধুপূর্ণিমায় জ্যোৎস্না-স্নান টাঙ্গুয়ার হাওরে টাঙ্গুয়ার হাওর। ছবি: বাংলানিউজ

আমার ট্যুরভাগ্য খারাপ। যখনই কোনো ট্যুরের প্ল্যান করি তখনই অপ্রত্যাশিত নানা কারণে ভেস্তে যায়। ইউনিভার্সিটিতে থাকতে আমার এক ছোটভাই হাত দেখে বলেছিল, দাদা আপনি খুব ভ্রমণপিপাসু।

আপনার হাতে ঘোরাঘুরি ভালোই আছে। হাতের কয়েকটা রেখা দেখিয়ে এবং কিছু গ্রহ-নক্ষত্রের কথা বলে সেটা প্রমাণও করতে চেয়েছিল।

আমার বন্ধুরা তাই দেখে একজন আরেকজনের দিকে চোখ চাওয়া-চাওয়ি করে হেসে উঠেছিল। কারণ তাদের অভিযোগ: আমার কারণেই তাদের অনেক ট্যুর মাটি হয়ে গেছে!

আমি ব্যাপারটা বুঝে ওই অ্যাস্ট্রোলজার ছোটভাইকে বলেছিলাম, কিন্তু আমার জীবনে ঘোরাঘুরির রেকর্ড খুব কম। তুমি কেমনে বলো আমার ঘোরাঘুরির রেখা ভালো আবার রাহু পজিটিভ? অ্যাস্ট্রোলজার ছোটভাই বলেছিল, দাদা একটা পাথর নেন সব ঠিক হয়ে যাবে। পাথর নেইনি। কারণ পাথর, হাতদেখা কিংবা গ্রহ-নক্ষত্রতে বিশ্বাস খুবই কম। তবে এখন মাঝে মধ্যে মনে হয় পাথর না নিয়ে হয়তো ভুল করেছিলাম।

আরবিতে একটি প্রবাদ আছে, ‘ইয়োম উস সফর, নিসফ উস সফর’। এর অর্থ যাত্রার দিনই অর্ধেক সফর। বাংলাতেও নাকি এমন একটি প্রবাদ আছে– উঠোন সমুদ্র পেরোলেই আধেক মুশকিল আসান। কিন্তু আমার আটকে যায় ওই উঠোন সমুদ্রেই। সমুদ্রের কথা মনে পড়তেই বিশাল জলরাশির কথা মনে পড়লো। কতদিন উন্মুক্ত জল দেখি না! আমার জল-ভীতি আছে। তবে, শুনেছি যাদের যাতে ভীতি থাকে তারা সেটা বেশি দেখে। যেমন, যাদের ভূতের ভয় আছে তারা ভূতের ফিল্ম বেশি দেখে কিংবা ভূতের গল্প বেশি শোনে। আমারও তাই। জলভীতি আছে বলেই জল আমাকে টানে। তাই তো ‘ওয়াটার ওয়ার্ল্ড’ মুভিটা বারবার দেখি। তবে  এবার আর লোনা পানি না; আমাকে মিঠাপানি বড্ড টানছে। আর উঠোন পেরোনোর কাজ অলরেডি করে ফেলেছে আমাদের সবার প্রিয় ভ্রমণ গ্রুপ ‘বাঙ্গাল: bangal travelers’। টাঙ্গুয়ার হাওর।  ছবি: বাংলানিউজআসছে ১২ থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর মধুপূর্ণিমাতে টাঙ্গুয়ার হাওরে ট্যুর। টাঙ্গুয়ার হাওর সম্পর্কে জেনেছি আগেই। এ হাওরের আরেক নাম– ‘নয় কুড়ি কান্দার ছয় কুড়ি বিল’। এটি রামসার অঞ্চল। রামসার হলো বিশ্বব্যাপী জৈব পরিবেশ রক্ষার এক সম্মিলিত প্রয়াস। আরও পড়েছিলাম, এই হাওরে ১৪০ প্রজাতির মাছ, ১২ প্রজাতির ব্যাঙ, ১৫০ প্রজাতির সরীসৃপ পাওয়া যায়। আরও কত কী! কিন্তু দেখেন এখানেও বিসিএসের আলোচনা শুরু করে দিয়েছি। যখন কোথাও ঘুরতে যাবেন তখন মাথা থেকে সব ধরনের বৈষয়িক চিন্তা বাদ দিতে হবে। কোথাও ঘুরতে যেয়ে যদি আপনার মাথার মধ্যে থাকে এখান থেকে আপনি ইনফরমেশন কালেক্ট করবেন এবং সেটা আপনার চাকরির পরীক্ষায় কাজে লাগাবেন তাহলে আপনি ভ্রমণের স্বাদও পাবেন না আবার চাকরির প্রস্তুতিও নিতে পারবেন না।

ট্যুরটা নিয়ে আমার উৎসাহের সীমা নেই। এর প্রধান কারণ টাঙ্গুয়ার হাওর বিশাল উন্মুক্ত মিঠাপানির জলাশয়। এর আয়তন প্রায় ১০০ বর্গ কিলোমিটার। একে মিঠাপানির সমুদ্র বললে অত্যুক্তি হবে না। আর দ্বিতীয় কারণ হলো মধুপূর্ণিমা। এমন মধুপূর্ণিমাতে কুলকিনারা ছাড়া বিশাল জলরাশির মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলে জীবনানন্দ দাশের ‘আমি যদি হতাম বুনোহংস, বুনোহংসী হতে যদি তুমি’ আবৃত্তি করতে করতে দেখবো, ‘নীল আকাশে খইক্ষেতের সোনালী ফুলের মতো অজস্র তারা’।

মাথার উপরে থাকবে অসীম আকাশ। অসীম নাকি বিশাল শূন্যতা? এমন অসীম আকাশের দিকে চেয়ে মনে হবে ‘শূন্যতাই হয়তো প্রকৃত ঈশ্বর’- চাণক্য'র কবিতা। প্রসঙ্গক্রমে মাথায় চলে আসবে। কিংবা আমার মগ্নতা ভেঙে দিয়ে দূরে লাফিয়ে উঠবে ব্যাঙ। চমকে যাবো আমি। ফিরে আসবো বাস্তবতায়। অসীম আকাশ থেকে চোখ চলে যাবে খুব দূরে দিগন্তের কাছাকাছি। সেখানে হিজল আর করচের শৃঙ্খলিত সারি। তার পেছনে চাঁদ উঠতে দেখে মনে হবে, ‘তোমরা যেখানে সাধ চলে যাও, আমি রয়ে যাবো এই বাংলায়’। রুপালি চাঁদের অবারিত জ্যোৎস্না কাচের মতো স্বচ্ছ জলে মরীচিকার সৃষ্টি হবে। মনে হবে কোনো দূরে বেহুলা ভেলায় করে লখিন্দরকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। হয়তো একটু মন খারাপ হবে। মনে পড়বে কোনো এক প্রেমিকার কথা। যার চোখ বলেছিল, আমাকে নিবা মাঝি লগে। কোনো এক অজানা সংকোচ বা সংশয়ে বলা হয়ে ওঠেনি, আমি তো সাত সমুদ্র তেরো নদী পার হয়ে এসেছি তোমাকেই নিতে। টাঙ্গুয়ার হাওর।  ছবি: বাংলানিউজ

টিমটিমে আলো জ্বেলে হাওরের বুকে ভেসে বেড়াবে যে মাছধরা নৌকা সেখান থেকে ভাজা মাছ খাবো। হাওরের নৌকার মাঝি তাৎক্ষণিক ভেজে দেবে মাছ। একটু বেশি উৎসাহে খেতে গিয়ে জিভ পুড়ে যাবে। তাড়াতাড়ি গালের ভিতর থেকে বের করে ফেলবো। তখন একজন পাশ থেকে হয়তো বলবে, কচি খোকা! ভাজা মাছ উল্টে খেতে জানে না। হয়তো আরও দূরে এক মাঝি গান গেয়ে যাবে, ‘মাঝি বাইয়া যায়, অকূল দরিয়ায় বুঝি কেউ নাই রে’। বা ‘ওরে সাম্পানের নাইয়া, আমারে দে দে ছাড়িয়া’। এই মাঝিদের মধ্যে হয়তো থাকবে একজন বৃদ্ধ। একা একা মাছ ধরে বেড়াবে। তার কর্মক্লিষ্ট শরীর ও চেহারায় বয়সের ছাপ দেখে মনে হবে ‘ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্যা সি’র সান্তিয়াগো নামে হতভাগ্য বৃদ্ধ ধীবরের কথা।

নৌকা নিয়ে ঘুরে ঘুরে বেড়াবো টাঙ্গুয়ার হাওরের ভাসমান ৪৬টি গ্রামে। শীতে যেখানে পানি থাকে না, স্থানীয় কৃষকরা তখন ফসল ফলায় বর্ষায় ডুবে যাওয়া সেসব স্থানে। সেখানে গিয়ে স্বচ্ছ জলে মাটির তল দেখবো। হয়তো নামতে ইচ্ছা করবে। কেউ সাবধান করে দিয়ে বলবে, এখানে অনেক পানি। তবু, এমন অমৃত জ্যোৎস্নায় হাওরের জলে স্নান করে শুদ্ধ হবো।

কিংবা ধরে নেওয়া যাক হঠাৎ পূর্ণিমা চাঁদ ঢেকে গেছে কালো মেঘে। একদল পাখির ডানা ঝাপটানোর মতো করে বৃষ্টি নেমে এলো। নিকষ কালো অন্ধকারে তরল জলের উপর বৃষ্টি পতনের একটানা শব্দ প্রেমিকার নুপুরের শব্দ মনে হবে। এমন বৃষ্টিতেই হয়তো প্রেমিকগুলো জলদস্যু হয়ে যায়। আষ্টেপিষ্টে কাউকে ভালোবাসতে চায়। কিংবা এমন বৃষ্টির মধ্যেই বজরায় বসে হয়তো রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, এমন দিনে তারে বলা যায়। এমন ঘনঘোর বরিষায়।

ভ্রমণতৃষ্ণা আছে ও সবার সঙ্গে মানিয়ে চলতে পারেন এমন যে কেউ চাইলেই যোগ দিতে পারেন আমাদের সঙ্গে। ফেসবুকে ‘বাঙ্গাল: bangal travelers’ লিখলেই আমাদের প্রিয় গ্রুপটি পেয়ে যাবেন।

নিশ্চয়ই জানেন মানুষের জীবনে ভ্রমণের দরকার আছে। এটা মনকে প্রসারিত করে। বলা হয়ে থাকে মানুষের জ্ঞান অর্জনের দু’টি ভালো উপায় হলো ১) বই পড়া এবং ২) ভ্রমণ করা। বই আমরা কমবেশি সবাই পড়ি। কিন্তু ভ্রমণ করা হয়ে ওঠে না। প্রকৃতির রহস্য জানার জন্য, বোঝার জন্য, বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে যে বৈচিত্র্য রয়েছে তা আবিষ্কার করার জন্য ভ্রমণের বিকল্প নেই। ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে, ‘A rolling stone gathers no moss’। জীবনকে গতিশীল করতে হবে। এতে জীবন থেমে যাবে না। ভ্রমণের মাধ্যমেই মানুষ প্রকৃতির প্রতি, পরিবেশ-প্রতিবেশের প্রতি, অন্য প্রাণী ও স্বজাতির অন্য গোষ্ঠীর প্রতি দায়বদ্ধ হতে পারে। যা আজকের এই পরিবেশ বিপর্যয়ের যুগে খুবই জরুরি। পরিবেশের প্রতি মানুষের কমিটমেন্ট ও সচেতনতা বাড়ানোর জন্য ভ্রমণ খুব ভালো উপায়।

যাইহোক, কল্পনায় মধুপূর্ণিমায় টাঙ্গুয়ার হাওরে ছিলাম। আবার সেই টাঙ্গুয়ার হাওরে ফিরে যাই। তবে এখন আর জোৎস্নালোকে নয় আবার বৃষ্টিস্নাত অন্ধকারেও নয়; এখন আমরা কল্পনায় ভেসে যেতে চাই গোধূলিলগ্নে টাঙ্গুয়ার হাওরের রূপে। গোধূলির সময় টাঙ্গুয়ার হাওর সবচেয়ে শান্ত নীরব। কোথা থেকে গাঙচিল পানকৌড়ি উড়ে যাচ্ছে। কিংবা চোখে পড়ে ডাহুক কিংবা সারস। এই সব ক্লান্ত পাখি ঘরে ফেরে; ঘরে ফেরে কিছু নৌকাও। আর দূরে দেখা যায় ছইতোলা নৌকা। এইসব নৌকায় করে আজও কত নারী নাইয়র যায়। হিজলের বনে ঘুঘু ডাকে। তখন মনে হয়,
‘পৃথিবীর সব ঘুঘু ডাকিতেছে হিজলের বনে;
পৃথিবীর সব রূপ লেগে আছে ঘাসে;
পৃথিবীর সব প্রেম আমাদের দুজনার মনে;
আকাশ ছড়ায়ে আছে শান্তি হয়ে আকাশে আকাশে। ’

আর তখন গোধূলির রোদ লাগে মেঘালয়ের পাহাড়ের গায়ে। তার প্রতিবিম্ব পড়ে হাওরের জলে। কী স্নিগধ! কী অপরূপ তার রূপ! এই পাহাড় থেকেই নেমে এসেছে যাদুকাটা নদী। বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর নদী। এসে মিশে গেছে হাওরে। এরকম আরও কত নদী যে এসে মিশেছে তার ঠিক নেই। এই সব নদী হাওরে মিশেই হয়তো ফুরায় জীবনের সব লেনদেন।

তারপর একবুক ব্যাথা নিয়ে ফিরে আসতে হয়। পাওলো কোয়েলহ বলেছেন, পৃথিবীর সবকিছুরই একটা নিজস্ব ভাষা আছে। খুব নিবিড়ভাবে শুনলে তা বোঝা যায়। হয়ত ভাষা আছে এই জলেরও। তাই তো পেছন থেকে হাওরের জল তীরে ধাক্কা খায় আর বলে ওঠে, নবীন পথিক সময় পেলে আবার এসো।

বাংলাদেশ সময়: ১৩৩০ ঘণ্টা, আগস্ট ২৪, ২০১৯
এএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।