ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ট্রাভেলার্স নোটবুক

হাঁটু সমান বরফ বাধ সাধলো সামিটে

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১০৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৪, ২০১৭
হাঁটু সমান বরফ বাধ সাধলো সামিটে তাঁবু

পুরো টিম ক্র্যাম্প্রন পয়েন্ট থেকে তৈরি হয়ে কিছুদূর উঠতেই ঠিক গতকালের মতো চারপাশ থেকে মেঘ ঘনিয়ে এলো। শুরু হয়ে গেছে বাতাস। এর মধ্যেও দূরে কালো বিন্দুর মতো আরোহীদের চলাফেরা বোঝা যাচ্ছে। ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছে হাইক্যাম্পের দিকে। তাঁবুর বাইরে থাকা সম্ভব হলো না। আশঙ্কার মেঘ জমছে মনেও। বেসক্যাম্পে এখন শুধু আমি আর একজন পোর্টার।

আজ লারকে পাসের দিকে যাওয়া ট্রেকার নেই বললেই চলে। সকালের দিকে কিছু মালবাহী খচ্চর আর তাদের চালকদের চলাফেরা ছিল।

এখন আর কেউ নেই লারকে পাসের পথে। তাঁবু থেকে মুখ বের করে দেখলাম। আমাদের টিমেরও কাউকে দেখা যাচ্ছে না। কোলের দেয়ালের আড়ালে হারিয়ে গেছে তারা। এক সময় স্নো ফল শুরু হয়ে গেলো। তাঁবুর গায়ে পরে বৃষ্টির মতো ঝিরিঝিরি শব্দ হচ্ছে। সঙ্গে নিয়ে আসা ভ্রমণ বিষয়ক একটা ম্যাগাজিন পড়ায় মন দিলাম। কিন্তু মনে পড়ে রয়েছে বাকি সবার সঙ্গে হাইক্যাম্পের পথে।

ঠাণ্ডা ধীরে ধীরে বাড়ছে। লেয়ারিং করে কাপড় পরতে হচ্ছে। নিচে সিনথেটিকের হাফ স্লিভ টি শার্ট তার উপরে একটি ফুল স্লিভ সুতির টি শার্ট। ফ্লিচের জ্যাকেটের উপরে আছে ডাউন জ্যাকেট। সবার উপর উইন্ড প্রুভ। হাতেও তিন লেয়ারের গ্লাভস পরতে হলো। একা এ ধরনের ধু ধু বরফ প্রান্তরে আগে কখনো থাকা হয়নি। ভয় লাগছে না মোটেই, কিন্তু এক ধরনের শূন্যতা ঠিক রয়েছে। কখনো পড়ায় মন দিচ্ছি, কখনো তাঁবুর বাইরে উঁকি দিয়ে কাটছে সময়। মুহূর্তের দৈর্ঘ্য এখানে অনন্ত। এক সময় সন্ধ্যা নেমে এলো। তারপর রাত। ...চোখে ঘুম আর আসে না। পরিকল্পনা অনুযায়ী রাত দশটা থেকে এগারোটার মধ্যে হাইক্যাম্পে থাকা টিম লারকের সামিট পুশে বেরিয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু আবহাওয়ার যে অবস্থা তাতে কি সামিট পুশে বের হওয়া সম্ভব? সমানে স্নো ফল হচ্ছে। সঙ্গে তীব্র বাতাসের সাথে ঠাণ্ডা। আশঙ্কাগুলো এক সময় চোখে ঘুম হয়ে নেমে এলো।

বেসক্যাম্পের মেঘলা সকাল। স্নো ফল থেমে গেছে। বাতাসও নেই। কিন্তু প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। চারপাশে গোঁড়ালি সমান বরফ আজও। হাইক্যাম্পের না জানি কি অবস্থা। দূরে পাহাড় চূড়ায় মেঘ খণ্ডগুলোর লুকোচুরি ক্যামেরাবন্দি করছিলাম। এমন সময় দেখা গেলো আরেকটি টিম লারকে হাই ক্যাম্পের দিকে উঠছে। তাদের কথা অবশ্য আগেই শুনেছিলাম। তারা সানো লারকে সামিটের উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছে। মূলত লারকের দুটো শিখর। ছোটটির নাম সানো এবং মূল শিখরটি ঠুলো লারকে নামে পরিচিত। আমরা এসেছি মূল শিখরটি আরোহণ করতে যার উচ্চতা ৬ হাজার ২৪৯ মিটার। ...নিচ থেকে উঠতে থাকা টিমটির গতিবিধি নজর রাখতে না রাখতেই চোখে পড়লো উপর থেকে আমাদের টিম নেমে আসছে। আশঙ্কায় বুক কেঁপে উঠলো। তাদের তো বিকেলের দিকে নামার কথা। সেখানেই বসে বসে তাদের নেমে আসা দেখছিলাম। নিশ্চয়ই সবাই অনেক ক্লান্ত। দলের সবার জন্য পানি আর চকলেট নিয়ে এগিয়ে গেলাম। ছোট বড় সব আলগা বোল্ডারে ঠাসা বিপদজ্জনক পথ। এই পথে অনেক নিচে নেমে গিয়ে তারপর উপরের দিকে ওঠা। এক সময় কথা বলার দূরত্বে চলে এলাম আমরা। আমাকে আর নামতে নিষেধ করা হলো। নিমা আর মাল্লা এলো সবার আগে। তাদের কাছে শুনলাম সামিট পুশে বের হওয়াই সম্ভব হয়নি। একে একে সবাই এলো।

পানি চকোলেট খেয়ে একটু জিরিয়ে নেওয়ার পর জানা গেলো কারণগুলো। গত দু’দিনের তীব্র স্নো ফলের কারণে হাইক্যাম্পে উপরের রাস্তা দারুণ বিপদজ্জনক হয়ে পড়ে। হাঁটু সমান বরফ জমে যায়। সামিটে যেতে হলো এর মাঝ দিয়ে প্রায় আট দশ ঘণ্টা ক্লাইম্ব করতে হতো। তার উপর তীব্র বাতাসের কারণে গতকাল তাঁবু থেকেই বের হওয়া যায়নি। আর হাইক্যাম্পও এমন একটি জায়গায় যেখানে প্রতি মুহূর্তে পাথর গড়িয়ে পড়ার ভয়। ...মুহিত ভাই সকালে এজেন্সির প্রধান দাওয়া শেরপার সঙ্গে কথা বলেন স্যাটেলাইট ফোনে। কিন্তু খারাপ আবহাওয়ার পূর্বাভাস সামনে আরও তিন দিনের আছে। রাতেও বেশ কয়েক দফা গাইডদের সঙ্গে পুরো টিমের মিটিং হয়। ফলে সার্বিক দিক বিবেচনায় বেসক্যাম্পে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেওয়া। সেই আপ্তবাক্য জপতে লাগলাম সবাই। পাহাড় পাহাড়ের জায়গায়ই থাকবে, বেঁচে থাকলে ফিরে আসা যাবে আবার।

** সামিটের প্রস্তুতির রাতে শুরু হলো বরফ পড়া

** ১৫৪১৯ ফুট উচ্চতায় নীলাভ পানির ছোট্ট বিস্ময় লেক!

** আঁধার ঠেলে উঁকি দিলো আগুনরঙা মানাসলু

** হাতের নাগালে বরফ পাহাড়, বীরেন্দ্র লেকে মুগ্ধতা

** সুন্দরতম গ্রাম লোহ, সামনে চোখ ধাঁধানো মানাসলু

** ১১ ঘণ্টা চড়াই-উৎরাই বেয়ে ৮৬৫০ ফুট উচ্চতার নামরুংয়ে

** বুড়িগন্ধাকীর সাসপেনশন ব্রিজ পেরিয়ে ফিলিম

** পাহাড়ের গায়ে ঝোলা নেপালের একমাত্র ক্লিপ ব্রিজ

** কখনও সরু ফিতা কখনও এবড়ো-থেবড়ো পথে যাত্রা

** চারিদিকে বান্দরবান বান্দরবান গন্ধ, সামনে আরক্ষেত

** ধুলোবালি গিলতে গিলতে ট্রেকিং শুরুর আরুঘাট (পর্ব-৩)

** হিমালয়ের মানাসলু ট্রেকিংয়ের অদম্য নেশায় যাত্রা (পর্ব-১)

বাংলাদেশ সময়: ০৬৫৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৪, ২০১৭
এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।