ঢাকা, বুধবার, ১৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ট্রাভেলার্স নোটবুক

গেন্টিংয়ের পাহাড় চূড়ায়

জাকারিয়া মন্ডল, সিনিয়র আউটপুট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮১৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১১, ২০১৭
গেন্টিংয়ের পাহাড় চূড়ায় গেন্টিং হাইল্যান্ডে উঠছে ক্যাবল কার। ছবি: জাকারিয়া মন্ডল

কুয়ালালামপুর ঘুরে: থিম পার্ক ছাড়া আর কি আছে গেন্টিংয়ে? বেমক্কা এই প্রশ্নে চোখ চড়কগাছে উঠলো নিরাপত্তা কর্মীর। হালের ক্রেজ গেন্টিংয়ে বেড়াতে আসা মুগ্ধ মানুষের ভিড়ে ভারতীয় বাংলাভাষী তীর্থঙ্করের প্রশ্নটা তাকে লা জবাব করে দিয়েছে বটে।

জবাব না পেয়ে স্কাইওয়ে স্টেশনটা কোন দিকে জানতে চাইলেন তীর্থঙ্কর। বছর ৮ বয়সের ছেলে অনিরুদ্ধ’র হাত ধরে টানলেন চলে যাওয়ার জন্য।

কিন্তু ছেলের তখন বাবার কথায় মন নেই। তার চোখ সেঁটে আছে ভয়ংকর রাইড স্পেসশটে।

১৮৫ ফুট ওপর থেকে ঘণ্টায় প্রায় ৭০ কিলোমিটার বেগে নিচে ফেলে দেওয়া হচ্ছে মানুষ সমেত খাঁচাটা। অনেক ওপরে তোলে বলে এ রাইডে চড়ে চারপাশের পাহাড়ি সৌন্দর্য দেখা যায় বটে, কিন্তু আতঙ্কে তো হার্ট ফেল করার দশা। তবু বাবার কাছে ওই রাইডেই চড়ার বায়না ধরলো অনিমেষ। অগত্য গোমড়া মুখেই ছেলের আবদারে সায় জানালেন তীর্থঙ্কর। বিড়বিড় করে বলতে থাকলেন, শুধু শুধু পয়সার শ্রাদ্ধ।

কিন্তু পিতা যতোই গজগজ করুন না কেনো, দস্যি এই ছেলে যে এরপর একাধিক ৩৬০ ডিগ্রি টার্নের রোলার কোস্টার কর্ক স্ক্রুতে চড়ার বায়না ধরবে তা নিশ্চিত। তারপর স্পিনার, ফ্লাইং কোস্টার আর পাইরেট শিপও হয়তো বাদ পড়বে ‍না তার আবদারের তালিকা থেকে।

কার্যত থিম পার্ক, রিসোর্ট আর ক্যাসিনোরই শহর গেন্টিং। এর অবস্থান গুনুঙ উলু কালি পাহাড়ের চূড়ায়। ভূমি থেকে ৬ হাজার ফুট উঁচুতে। কুয়ালালামপুর থেকে এ পাহাড়ের দূরত্ব ৩৫ কিলোমিটার মাত্র। পাহাঙ আর সেলানগরের সীমান্তে এটাই সবচেয়ে উঁচু পাহাড়। গেন্টিং এর পাহাড়ে মেঘের খেলা।  ছবি: জাকারিয়া মন্ডল

কুয়ালালামপুরের যে কোনো স্থান থেকে এই পাহাড়ের ঘাড়ে গড়া গুহটঙ জায়া উপশহরে পৌঁছুতে সময় লাগবে বড় জোর পৌনে ১ ঘণ্টা। সেখান থেকে কেবল কারে প্রায় সাড়ে ৩ কিলোমিটার পথ শূন্যে ভেসে গেন্টিং স্কাইওয়ে স্টেশনে পৌঁছুতে সময় লাগবে প্রায় ৪০ মিনিট।

কেবল কারের পুরো সময়টাই হয়ে উঠবে অবিস্মরণীয় এক ভ্রমণের উপাখ্যান। পায়ের অনেক নিচে সরতে থাকবে রেইন ফরেস্টের সবুজ সবুজ গাছ। নানা আকার আর আয়তনের পাহাড়গুলোকে মনে হবে বাড়ির পাশের ঢিবি।

পেছনে পাহাঙ পাহাড় শ্রেণীর ভাঁজে ভাঁজে অলস সময় কাটানো মেঘদলের ওপরে প্রতিফলিত হয়ে চোখ ধাঁধিয়ে দেবে সূর্যালোক। আর এক ঋতুর এই দেশে বৃষ্টির বাগড়ায় পড়লে তো মেঘ ফুঁড়েই এগুতে হবে কেবল কারের খাঁচাগুলোকে। মেঘমাখা যাত্রায় শরীর জুড়িয়ে দেবে শীতল বাতাসের হিমেল আদর।  

তবে ১৯৭১ সাল থেকে এই গেন্টিংয়েই যে মালয়েশিয়ার একমাত্র বৈধ জুয়ার আড্ডা চলে আসছে তা বেশ ভালোভাবেই বোঝা যাবে স্কাইওয়ে স্টেশন ছেড়ে একটু সামনে বাড়লেই। এতো বিশাল বিস্তৃতি নিয়ে যে জুয়ার আড্ডা জমতে পারে তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। এ যেনো মিনি লাসভেগাস। হাজার হাজার বর্গমিটার আয়তনের বিস্তৃত ফ্লোরগুলোতে নানা আইটেমের জুয়ার ব্যবস্থা। ফ্রি কফির ব্যবস্থা আছে জুয়াড়িদের জন্য। গেন্টিং হাইল্যান্ডসে ইনডোর থিম পার্ক।  ছবি: জাকারিয়া মন্ডল

জুয়ার আড্ডা, শপিংমল, থিম পার্ক আর রেস্তোরাঁ এড়িয়ে মুক্ত বাতাসে বেরিয়ে এলেই আপন করে নেবে পাহাড় চূড়ার বিশুদ্ধ বাতাস। রাতে ২০ ডিগ্রি থেকে ১৫ ডিগ্রিতে নামলেও দিনে ২০ থেকে ২৬ ডিগ্রির ভেতরই ওঠানামা করে গেন্টিং এর তাপমাত্রা। সারাবছরই থাকে কুয়াশা, হয় বর্জ্রবৃষ্টি। এখানকার বাতাসে তাই মিশে থাকে মেঘভাঙা হিম। মনে হয়, যেনো গুঁড়ো গুঁড়ো হওয়া মেঘ হিম হিম আবেশে মিশে যেতে চাইছে শরীরে।

মেঘ গলে বৃষ্টি হলে সব রাইড বন্ধ থাকে গেন্টিংয়ে। কিন্তু তখন অন্যরকম সাজ নেয় প্রকৃতি। রেইন ফরেস্টের সবুজ গাছগুলো হয়ে ওঠে আরো বেশী সবুজ। ঝপসা হয়ে যায় দূরের কুয়ালালামপুরে শহরের অবয়ব। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে গড়া মৌমাছি, স্ট্রবেরি আর মাশরুমের খামারও তখন বদলে যায় অন্য এক আবহে। ধুলো ধোয়া রঙ খোলে চাইনিজ শিন শুয়ে টেম্পলে। মেঘমোড়া ঝিরি ঝিরি বৃষ্টিও হয়ে ওঠে উপভোগের অনবদ্য কাব্য।  

তবে মার্চ থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে বৃষ্টির ছাঁট একটু কমই ভোগায় এক ঋতুর দেশ মালয়েশিয়ায়।  

ভাগ্যান্বেষী ফুজিয়ান লিম গহ তঙ কি কস্মিনকালেও ভেবেছিলেন, এতোটা জমে যাবে তার স্বপ্ন পাহাড়। ১৯৩৭ সালে মাত্র ১৯ বছর বয়সে মালয়েশীয় উপকূলে নামার পর প্রথমে ক্যামেরন হাইল্যান্ডসে সবজির চাষ শুরু করেছিলেন তিনি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে যায় তার কাজের আওতা। টিন খনি, লোহার খনি ইত্যাদিতে ঈর্ষণীয় মাত্রায় সফল হওয়ার পর নির্মাণ কাজটাও চলে আসে তার হাতে। গেন্টিং হাইল্যান্ডসে ফাইভ স্টার হোটেল।  ছবি: জাকারিয়া মন্ডল

একদিন ক্যামেরন হাইল্যান্ডের পাহাড়ে বসে খাওয়ার সময়ে এক অদ্ভূত চিন্তা ভর করে তার উদ্ভাবনী মাথায়। কুয়ালালামপুরের কাছে পাহাড় চূড়ায় রিসোর্ট তৈরির চিন্তা শুরু করেন তিনি। সাহসী সেই চিন্তাকে বাস্তবে রূপ দিতে কুয়ালালামপুর থেকে ২শ’ কিলোমিটার দূরের ক্যামেরন হাইল্যান্ড ছেড়ে চলে আসেন কাছের গেন্টিং হাইল্যান্ডে।

সঞ্চিত সব অর্থ ব্যয় করে তিনি রিসোর্ট গড়েন পাহাড় চূড়ায়। গড়েন রাস্তা। করেন সুপেয় জল আর বিদ্যুতের ব্যবস্থা।

বাণিজ্যের জন্য ১৯৭১ সালে খুলে দেওয়া হয় গেন্টিং। স্বাধীন মালয়েশিয়ার প্রথম প্রধানমন্ত্রী টুংকু আব্দুর রহমান দেশের একমাত্র ক্যাসিনোর অনুমতি দিয়ে দেন গেন্টিংয়ে।  গেন্টিং হাইল্যান্ডস।  ছবি: জাকারিয়া মন্ডল  

পরবর্তী ৩০ বছরে গেন্টিং হয়ে ওঠে অবসরপ্রেমীদের সেরা গন্তব্য। বড় হয় ছোট ক্যাসিনো। বাড়তে থাকে হোটেল-রিসোর্টের সংখ্যা। বসে ক্যাবল কার, থিম পার্ক।

গেন্টিংয়ের চূড়ায় এখন এশিয়ার সবচেয়ে বড় হোটেল ফার্স্ট ওয়ার্ল্ড। যাতে কেবল বাজেট রুমই আছে হাজার ছয়েক। ফ্যামিলি ওরিয়েনটেড এই থিম পার্ক হোটেল ছাড়াও গ্রেন্টিং গ্রান্ড ও ম্যাক্সিমস এর মতো ফাইভ স্টার হোটেলও আছে গেন্টিংয়ে। এখানকার ফার্স্ট ওয়ার্ল্ড প্লাজা এখন কেনাকাটার স্বর্গ। ভোজন রসিকদের জন্য আছে নানা দেশি রেস্টুরেন্টে রকমারি খাবারের আয়োজন। মালয়েশিয়ায় কেউ বেড়াতে গেলে তাই ভ্রমণ তালিকায় গেন্টিংটা রাখতেই হয়।

বাংলাদেশ সময়: ১০১২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়‍ারি ১১, ২০১৭
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।