ঢাকা, বুধবার, ১৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ট্রাভেলার্স নোটবুক

ভারত ভ্রমণপঞ্জি-৪

নিজাম ডাকাত ও বিতাড়িত বাহাদুর উপাখ্যান

এরশাদুল আলম প্রিন্স, ল’ এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩২৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ৭, ২০১৫
নিজাম ডাকাত ও বিতাড়িত বাহাদুর উপাখ্যান ছবি: লেখক

দিল্লি থেকে ফিরে: ‘কিৎনা বদনসিব জাফর...দাফনকে লিয়ে দোগজ জামিন ভি মিলানা চুকি ক্যোয়ি ইয়ার মে। .
অর্থাৎ এতই হতভাগা জাফর...যে তার দাফনের প্রয়োজনে,  স্বজনের দেশে দু’গজ মাটি- তাও মিলল না।

"

মুঘল সাম্রাজ্যের গোধুলি বেলায় প্রাণ বাঁচাতে শেষ সম্রাট যখন দিল্লি থেকে বিতাড়িত হয়ে রেঙ্গুনে অন্তরীণ তখন রচনা করেন এ বিষাদময় কবিতা।

আজকের এই দিনটিতেই মুঘল সাম্রাজ্যের শেষ সূর্যটি অস্তমিত হয়। ১৮৬২ সালের এই দিনেই মৃত্যু বরণ করেন সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফর। ১৭৭৫ সালের ২৮ অক্টোবর দিল্লির লাল কেল্লায় যে সূর্য উদিত হয় নিয়তির অমোঘ পরিহাস-দু:খ, কষ্ট, মনোবেদনা, অমর্যাদা ও নিদারুন অসহায়ত্ব নিয়ে জীবনের শেষ দিনগুলো কাটাতে হয়েছে দিল্লির মসনদের এই উত্তরাধিকারীকে। সে ইতিহাস বড়ই যাতনাময়।

বাবর থেকে বাহাদুর। মাঝে সাড়ে তিনশ’ বছরের ইতিহাস। কিন্তু ইতিহাসেরও পালা বদল হয়, নদীর যেমন গতি, আকাশের যেমন রং। কারো আকাশই চিরদিন নীল থাকে না। সেখানে কালো মেঘ এসে ছেয়ে যায়। ঝড় আসে, তুফান আসে। অবশেষে সূর্য হাসে। দিগন্ত প্রসারিত রংধনু ছবি আঁকে আকাশে। তাও ক্ষণিকের।

বাবর দিল্লি জয় করে কখনো কি ভাবতে পেরেছিলেন যে তারই বিশতম বংশধরকে প্রাণভয়ে পালিয়ে বেড়াতে হবে এই দিল্লিতেই? কিংবা যে মুঘলরা তাদের সাম্রাজ্যকে তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন এক নতুন আভিজাত্য ও মর্যাদায় সে সাম্রাজ্যে সামান্য দুই গজ জায়গা হবে না এ সাম্রাজ্যেরই উত্তরাধিকারের?

ইতিহাসের সন্তানের জন্য সে ইতিহাস বড়ই যন্ত্রণাময়, তারচেয়েও বেশি শিক্ষণীয়। কিন্তু ইতিহাসের বড় শিক্ষা তো এই যে ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না।

বাবরের হাত ধরে হুমায়ুন গড়ে তুলেছেন এ দিল্লি। আকবর যে দিল্লিকে দিগন্ত বিস্তৃত করেছেন, শাহজাহান যাকে নতুন আলোয় দোদিপ্যমান করেছেন, আওরঙ্গজেব যাকে করেছেন শান্তিময়, সে দিল্লির প্রাণকেন্দ্র নিজামুদ্দিনেই একদিন আশ্রয় খুঁজে ফিরছিলেন দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফর।

নিজামুদ্দিন জায়গাটি মুঘল আমলের দিল্লির প্রাণকেন্দ্র। বলা যায় ভারতবর্ষে মুঘলদের প্রাথমিক পদচারণা শুরু হয় এই নিজামুদ্দিন থেকেই। হুমায়ুনের সমাধি এ নিজামুদ্দিনেই।
Delhi_08
এই নিজামুদ্দিনের পাশেই হুমায়ুন গড়ে তুলেছিলেন দিনাপানা। এই নিজামুদ্দিনেই সমাহিত আছেন ঈশা খান নিয়াজী। যিনি ছিলেন শেরশাহ শুরীর রাজ দরবারের একজন অভিজাত ব্যক্তি। হুমায়ুনের সমাধি এখানে রচিত হওয়ারও কমপক্ষে কুড়ি বছর আগে নিয়াজিকে এখানে সমাহিত করা হয় (১৫৪৭-৪৮)। এই শেরশাহ শুরী বা শেরখানই হুমায়ুনকে পরাজিত করে দিল্লি দখল করেন।
Delhi_06
হুমায়ুনের সমাধি প্রাঙ্গণেই রয়েছে ঈশা খান নিয়াজীর সমাধি। হুমায়ুনের সমাধিতে প্রবেশের সময় প্রধান ফটক পার হলে ডান দিকেই চোখে পড়বে এ সমাধিটি।
Delhi_05
বু হালিমার (যার সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না) সমাধি ও বাগানের পাশেই রয়েছে এই সমাধি।
Delhi_04
পার্সিয়ান স্থাপত্য শৈলীতে করা এ সমাধি ও মসজিদটি একটি পৃথক বেস্টনির মধ্যে অবস্থিত। এর পাশাপাশি রয়েছে আরো কয়েকটি সমাধি। লাল বেলে পাথর দিয়ে তৈরি এ সমাধিটি অত্যন্ত মনোরম। সময়ের সাথে এ স্থাপত্যশৈলীর অনেক কিছুই আজ ম্লান হয়ে গেছে। সেই সাথে অযত্ন অবহেলা তো আছেই।  
Delhi_02
মুঘল সাম্রাজ্যের শুরুতে যেমন নিজামুদ্দিন, শেষেও তেমনি নিজামুদ্দিন। এখানে আত্মগোপনে থাকা জাফরকে ইংরেজরা গ্রেফতার করে রেঙ্গুনে নিয়ে যায়। কাজেই মুঘল সাম্রাজ্যের শেষ অঙ্কটিও রচিত হয় এই নিজামুদ্দিনেই।
Delhi_12
কিন্তু কী করে এলো ‘নিজামুদ্দিন’ নামটি? এ উত্তর আমাদের সবারই জানা। নিজাম ডাকাতের কথা শোনেননি এমন আদম সন্তান এ উপমহাদেশে খুঁজে পাওয়া ভার। কথিত আছে, প্রথম জীবনে ডাকাত ছিলেন নিজামুদ্দিন। কিন্তু জীবনের রেখা কখন কোথায় বাঁক নেবে তা বুঝি আমাদের কারোই জানা নেই। তাই বেশি দিন আর ডাকাতি করা হয়নি নিজামু্দ্দিনের। ডাকাতি ছেড়ে বুজুর্গ আউলিয়া হয়েছিলেন নিজামুদ্দিন।

যিনি অন্ধকারের কানাগলিতে জীবন খুঁজেছিলেন, সেই নিজামুদ্দিনই একদিন আলো ছড়িয়েছেন কোটি মানুষের হৃদয়ে। সব ধর্মের মানুষের কাছেই তিনি ছিলেন এক আলোকিত আত্মা। এজন্য তাকে লাঞ্ছনাও কম ভোগ করতে হয়নি।
Delhi_01
ইতিহাসে নিজামুদ্দিন আউলিয়াকে নিয়ে অনেক ঘটনা আছে। সেরকমই একটি ঘটনা। দিল্লির সিংহাসনে তখন গিয়াসউদ্দিন বলবন (১২৬৫-১২৮৭)। এই বলবনের নাম শুনলে প্রজাদের ঘুম হারাম হয়ে যেতো। কারো বিরুদ্ধে সম্রাটের দরবারে নালিশ গেলে ধরে নেওয়া হতো এবার বুঝি তার প্রাণটা যাবে।

বলবনের দরবারে আসামি এবার নিজামুদ্দিন। অভিযোগ মুসলমান ও বিধর্মীদের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ করেন না তিনি, শরীয়তের আইন না মেনে খামখেয়ালি করছেন নিজামুদ্দিন। নিজামুদ্দিন সব অভিযোগই খণ্ডন করলেন। বললেন, হে সুলতান, একথা সত্য যে, আমি হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রীস্টান কারো মধ্যে ভেদাভেদ করিনা। কারণ আল্লাহর জমিনে সবাই তার বান্দা, আদম সন্তান।
Delhi_03
কেউ অভিযোগ করলো যে নিজামুদ্দিন মানু্ষের চোখে ধূলা দিয়ে প্রেমের কথা বলেন। জবাবে নিজামুদ্দিন বললেন, আপনারা নিশ্চয়ই সেই ঘুঘুর গল্প জানেন, যে তার সঙ্গীর কাছে নিজেকে সমর্পন করেনি। পুরুষ ঘুঘু আবেগে বলেছিল, ‘তুমি যদি নিজেকে সমর্পন না কর তাহলে আমি বাদশাহ সোলায়মানের সিংহাসন উল্টে দেব। ’ তার কথা বায়ুতাড়িত হয়ে বাদশাহ সোলায়মানের দরবারে পৌঁছলো। তিনি ঘুঘুকে ডেকে তার কথার ব্যাখ্যা দিতে বললেন। ঘুঘু উত্তর দিয়েছিল, ‘হে আল্লাহর রসুল, প্রেমিক-প্রেমিকার কথার কোনো ব্যাখ্যা আশা করা উচিত নয়। ’ ঘুঘুর উত্তরে বাদশাহ সোলায়মান খুশি হলেন। আমিও আশা করি, আমার উত্তরে সুলতান বলবন সন্তুষ্ট হবেন। ’ দরবারে উপস্থিত সবাই বাহ বাহ করে উঠলো।
Delhi_09
এভাবেই তিনি তার জ্ঞান, পাণ্ডিত্য, এবাদত-বন্দেগি আর মানব প্রেম দিয়ে জয় করেছিলেন মানুষের হৃদয়। জয় করেছিলেন ভারতবর্ষ।   মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ারও দুইশ’ বছর আগে নিজামুদ্দিনের আগমন। এখানেই তার সমাধি। তাঁর দুইশ’ বছর পরে যে মুঘল সাম্রাজ্যের সূচনা তারই দ্বিতীয় পুরুষ হুমায়ুন এখানেই সমাহিত। এরও একশ’ বছর পর এখানেই সমাহিত হন শাহজাহানের বিদূষী কণ্যা জাহানারা। এভাবেই নিজামুদ্দিন আউলিয়া মৃত্যুর দুইশ’ তিনশ’ এমনকি হাজার বছর পরও বেঁচে থাকবেন তার ভক্ত হৃদয়ে –হোক তা সম্রাট বা দীন-হীন কোনো ফকির মিসকিন।
Delhi_10
প্রধান সড়ক থেকে আধা কিলোমিটারেরও বেশি পথ পেরিয়ে পৌঁছা যাবে নিজামুদ্দিন আউলিয়ার দরগায়। দুই পাশে ফুল, পাপড়ি, আগরবাতি-মোমবাতির পসরা সাজিয়ে বসেছে দোকানিরা। আছে খাবার দোকান, আবাসিক হোটেল।

খাজা নিজামুদ্দিনের সমাধির পাশেই আছে ওস্তাদ কবি আমীর খসরু ও উর্দু কবি মীর্জা গালিবের সমাধি।

হজরত খাজা নিজামুদ্দীন আউলিয়া (র.)-এর মাজারে উর্দু কবি আল্লামা ইকবালের একটি কবিতা লেখা ছিল বলে কোনো কোনো পর্যটক উল্লেখ করেছেন।

কবিতাটি এই...
‘হিন্দকা দাতা হায়তু,
তেরা বড়া দরবার হায়।
কুছ মিলে মঝ কো ভি,
ইছ দরবারে গওহারে বারছে। ’

অর্থাৎ, (হে খাজা) তুমি তো হিন্দুস্থানের দাতা, তোমার বিশাল দরবার। তোমার এ রত্মপূর্ণ দরবার হতে আমার ভাগ্যও কিছু প্রসন্ন হোক।
Writer_Prince
হজরত নিজামুদ্দিন সবসময় রাজা-বাদশাহদের সান্নিধ্য এড়িয়ে চলতেন। অথচ মৃত্যুর পর তাঁর সমাধিকে ঘিরেই রচিত হয়েছে মুঘল সাম্রাজ্যের অনেক উত্তরাধিকারীদের সমাধি। শুধু জায়গা হলোনা বাহাদুর শাহ জাফরের।

প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী মায়ানমার সফরে গিয়ে বাহাদুর শাহর সমাধি পরিদর্শন করেন। বাহাদুর শাহর বিষাদময় কবিতার জবাবে রাজীব গান্ধী পরিদর্শক বইতে লিখেছিলেনঃ

"দু গজ জমিন তো না মিলি হিন্দুস্তান মে,
পার তেরী কোরবানী সে উঠি আজাদী কি আওয়াজ,
বদনসীব তো নাহি জাফর,
জুড়া হ্যায় তেরা নাম ভারত শান আউর শওকত মে, আজাদী কি পয়গাম সে"।

(হিন্দুস্তানে তুমি দু গজ মাটি পাও নি সত্য। তবে তোমার আত্মত্যাগ থেকেই আমাদের স্বাধীনতার আওয়াজ উঠেছিল। দুর্ভাগ্য তোমার নয় জাফর, স্বাধীনতার বার্তার মধ্যে দিয়ে ভারতবর্ষের সুনাম ও গৌরবের সঙ্গে তোমার নাম চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছে" )।

বাংলাদেশ সময়: ১২১০ ঘণ্টা, নভেম্বর ৭, ২০১৫
জেডএম/

** ভারত ভ্রমণপঞ্জি-৩: হুমায়ুনের সমাধি কি তাজমহলের অনুপ্রেরণা?
** ভারত ভ্রমণপঞ্জি-২: পলাশী থেকে ভিক্টোরিয়া
** ভারত ভ্রমণপঞ্জি-১: সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড, কলকাতা ইন অক্টোবর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।