ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ট্রাভেলার্স নোটবুক

সুন্দরী তৈদুছড়া

মো. অহিদ উল্লাহ পাটোয়ারী | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০৪১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৮, ২০১৫
সুন্দরী তৈদুছড়া ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

‘ঘুরে বেড়াই বাংলাদেশ’ এর এবারের ভ্রমণ ছিল খাগড়াছড়ির গহীনে বনাঞ্চলে। সবুজ পাহাড় আর বুনো জঙ্গলের মাঝে নয়াভিরাম জলপ্রপাত তৈদুছড়া।



ত্রিপুরা ভাষায় ‘তৈদু মানে পানির দরজা’ আর ছড়া মানে ঝরনা। ঈদুল ফিতরের পরদিন রাতের বাসে রওনা দিয়ে সকাল সাড়ে ৬টায় পৌঁছালাম দীঘিনালা।

বাস থেকে নেমেই গেস্ট হাউজে। দীঘিনালা গেস্ট হাউজের পরিচালক দিপ্তীময় চাকমার সহযোগিতায় আগে থেকে রুম বুক করা ছিল। তাই কোনো ঝক্কি-ঝামেলা ছাড়াই সোজা গিয়ে ফ্রেশ হয়েই সকালের নাস্তা।

তারপর সিএনজি অটোরিকশা নিয়ে জামতলা। স্থানীয় ১৩ বছরের কিশোর অজিত ত্রিপুরাকে গাইড হিসেবে সঙ্গে নিই। এবার শুরু হলো হাঁটা পথ। জামতলা পার হওয়ার পর থেকেই জুম ক্ষেত শুরু।

আনারস আর ধানের আবাদ বেশি। রাস্তায় ইট বিছানো। ৪০ মিনিট হাঁটার পর এসে পৌঁছালাম রাজেন্দ্র পাড়া। কোনো বাড়ির আঙ্গিনায় শিশুরা খেলছে, কোনো বাড়ির উঠানে কাজ করছে স্থানীয় নারীরা। পাড়ার পাশেই বোয়ালখালী খাল। এ পাড়াতে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে খাল ধরে হাঁটতে থাকি। পথে কখনও ডানে কখনও বামে আবার কখনও বা খাল ছেড়ে পাহাড়ে জঙ্গলের ভেতরে দিয়ে চলতে থাকি।

হাঁটতে হাঁটতে একটু পরই পেলাম বোয়ালখালী ছড়া। এবার তৈদুছড়া যাওয়ার যাত্রা শুরু। জল প্রপাতের পানি দিয়ে সৃষ্টি বোয়ালখালী ছড়া দিয়ে যাচ্ছি।

ছড়ার কোনো কোনো জায়গায় বেশ সুরু। দুই পাশের পাহাড় যেন চেপে ধরছে। আবার কখনও মনে হয় আমরা কোনো গুহায় প্রবেশ করছি কিনা!

কখনও হাঁটু সমান পানি আবার কখনও কোমর সমান। কখনও বা গলাপর্যন্ত এসেও ঠেকেছে। সে পানিকে হাতের ধাক্কায় ঠেলেঠুলে যখন বাঁকের পর বাঁক পেরোচ্ছি তখনই দেখা দিল ছড়ার মাঝখানে ছড়ানো-ছিটানো ব্লক আকারে পাথর।

ইব্রাহীম বললো, তৈদুছড়া ঢুকে পড়েছি। সেই সকাল থেকে হাঁটা শুরু করছি, রাজেন্দ্রপাড়া সামান্য বিশ্র্রাম নিলেও পাহাড়ি পিচ্ছিল ছড়ায় হাঁটতে হাঁটতে আবার ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। মাঝেমধ্যে পাথরের ওপর বসে কিছুটা বিশ্রাম নিয়েছি।

ছড়ার ঠাণ্ডা পানি ছিটিয়ে দিই চোখেমুখে, আহ! কী শান্তি। নিমেষেই মিলিয়ে গেল সব ক্লান্তি। এভাবে যতই এগোচ্ছি ততই পাথরের আকার বড় হচ্ছে।

হঠাৎ জাহাঙ্গীর থমকে দাড়িয়ে চিৎকার দিয়ে উঠল। চোখের সামনে বিশাল দেহ ঠাণ্ডা রাখার জন্য শুয়ে আছে একদল হাতি। কিন্তু আসলে এগুলো হাতি না!

সারিবদ্ধ বড় বড় পাথর। তবে এখন সব আকৃতি যে দূর থেকে দেখে মনে হয় হাতির পিঠ। কিছুদূর যেতেই কান যেন বন্ধ হয়ে আসছে। পানি গড়িয়ে পড়ার শব্দে মংসানু তো প্রায় চেঁচিয়েই উঠলো।

তৈদুছড়া চলে এসেছি। আরেকটু সামনে এগোতে পাতার ফাঁক দিয়ে চোখে পড়ল ঝরনা। প্রায় ৬০ ফুট ওপর থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে নিচে।

মুগ্ধ হয়ে ঝাঁপাঝাঁপি করি। এবার দেখতে হবে দ্বিতীয় ঝরনাটি। তৈদুছড়ার প্রথম ঝরনার ডান পাশ ধরে খাড়া পাহাড়ি পথ ধরি। ছোট ছোট গাছ ধরলে শেকড় উপড়ে চলে আসে। হামাগুড়ি দিয়ে ‘ঘুরে বেড়াই বাংলাদেশ’ দলের সদস্যরা সবাই উঠতে থাকি।

এর মধ্যেই নামে বৃষ্টি। পথ আরও পিচ্ছিল হয়ে উঠে। কথা বালার শক্তিও বুঝি ফুরিয়ে যায়। পাহাড়ে ছিল অনেক মশা আর জোক। তাদের সঙ্গে লড়াই করে বৃষ্টিমাখা পথ বেয়ে ওপরে উঠে হাঁপাতে থাকি।

তারপর গিরিপথ ধরে এগোতে থাকি। পরের পথটুকু এতই পিচ্ছিল যে একটু খামখেয়ালি করলেই বড় ধরনের দুর্ঘটনা, হতে পারে মৃত্যুও। এমন বিপন্ন অবস্থায় আগে পড়িনি। থর থর করে কাঁপা পা নিয়ে এই ভয়ংকর পথটি পারি দিলাম ‘ঘুরে বেড়াই বাংলাদেশ’ দলের সদস্যরা।

এক সময় জঙ্গল আর গুহা পেরিয়ে পৌঁছালাম সুন্দরী তৈদুছড়া জলপ্রপাতে। অপরুপ সৌন্দর্য তার। প্রচণ্ড গর্জনে প্রায় ৩০০ ফুট ওপর থেকে বেয়ে পড়ছে বিশাল জলরাশি।

তৈদুছড়ার প্রথম ঝরনাটির চেয়ে দ্বিতীয়টি অনেক বড়। প্রাকৃতিকভাবেই পাহাড়ের গায়ে খাঁজ কাঁটা রয়েছে, যেখানে বসে জলপ্রপাতের পানিতে গোসল করা যায়।

আমরাও জলপ্রপাতের ঠাণ্ডা পানিতে দীর্ঘ সময় গোসল করি। পরে খেয়ে নিই সঙ্গে আনা শুকনো খাবার। সেখানে কিছুক্ষণ থেকে তারপর ফেরার পথ ধরি।
 
কীভাবে যাবেন
ঢাকার গাবতলী, ফকিরাপুল, কমলাপুর ও সায়েদাবাদ থেকে- শান্তি, সৌদিয়া, এস আলম, শ্যামলী, হানিফ,  ঈগল, ইউনিক, সেন্টমার্টিন ও ইকোনো পরিবহনের বাসে খাগড়াছড়ি যাওয়া যায়।

ভাড়া ৫২০ টাকা। আর শান্তি ও সৌদিয়া পরিবহনে দীঘিনালা যাওয়া যায়। ভাড়া ৫৮০ টাকা। দীঘিনালা থেকে সিএনজি অটো রিকশায় জামতলা। ভাড়া জনপ্রতি ১০ টাকা। এবার স্থানীয় গাইড নিয়ে তৈদুছড়া চলে যেতে পারবেন। গাইডকে দিতে হয়ে ৫০০ টাকা।

প্রিয় পাঠক, ভ্রমণ যাদের নেশা, বেড়ানোর সুযোগ এলে যারা উড়িয়ে দেন সব বাধা, কাজের অংশ হিসেবে যারা ভ্রমণ করেন কিংবা যাদের কালেভদ্রে সুযোগ হয় ভ্রমণের তারা সবাই হতে পারেন ট্রাভেলার্স নোটবুক’র লেখক। আপনার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারেন বাংলানিউজের পাঠকদের সঙ্গে। আর একটা কথা লেখার সঙ্গে ছবি পাঠাতে ভুলবেনই না, সেই সঙ্গে বাতলে দিন সেখানে যাওয়ার পথঘাটের বিবরণও।

travelers_notebook_5

বাংলাদেশ সময়: ০০৪১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৮, ২০১৫
এমএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।