ঢাকা, রবিবার, ১৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ট্রাভেলার্স নোটবুক

জামালপুরের পথে-প্রান্তরে

ফরিদ ফারাবী | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২২৬ ঘণ্টা, মে ২৩, ২০১৫
জামালপুরের পথে-প্রান্তরে ছবি : বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

যান্ত্রিক এ শহরে মাঝে মধ্যেই হাঁপিয়ে উঠি। একটু স্বস্তির নিশ্বাস নিতে তখন শহর ছেড়ে চেষ্টা করি নিরুদ্দেশ হওয়ার।

আর একা ভ্রমণের অন্য রকম মজা আছে।

অনেকদিন থেকেই ইচ্ছা ছিলো একা ট্রেন জার্নি করার। ময়মনসিংহ রুটের বিচিত্র ট্রেন জার্নির কথা চিন্তা করেই জামালপুর যাওয়ার পরিকল্পনা করলাম। সুযোগ পেয়েই পরিকল্পনা মতো জামালপুরের ট্রেনের টিকিট কাটলাম। নির্দিষ্ট দিন সকালে সাড়ে ৭টায় তিস্তা এক্সপ্রেস ছাড়লো। ট্রেনের কামরা প্রায় পরিপূর্ণ। প্রচণ্ড গরম আর মানুষের ভিড়ে কিছুটা কষ্টই হচ্ছিলো। তবু নতুন জায়গা ভ্রমণের আনন্দ সে কষ্টের কাছে কিছুই না।

হাতে রয়েছে পাওলো কোয়েলহোর লেখা দ্য অ্যালকেমিস্ট। বই পড়তে পড়তে আর আশপাশের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে দুপুর ১২টায় পৌঁছলাম জামালপুর। জামালপুর জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার শাকিল ভাইয়ের সঙ্গে আগেই যোগাযোগ হয়। সরাসরি চলে গেলাম অফিসার্স ডরমেটরিতে। দুপুরে খাওয়া দাওয়া করলাম তার সঙ্গেই। দুপুরের পর বের হলাম ক্যামেরা নিয়ে।

ব্রহ্মপুত্রপাড়ে কিছুক্ষণ হেঁটে সেখান থেকে পুরো শহর ঘুরে দেখলাম। হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছলাম জামালপুরের ঐতিহ্যবাহী দয়াময়ী মন্দিরে। প্রায় ৪শ বছরের পুরনো এই মন্দির বেশ কয়েকবার সংস্কার হয়ে এখন আগের সেই অবস্থাতে না থাকলেও জৌলুশ ধরে রেখেছে। ঘুরে ফিরে সন্ধ্যা হলে ফিরে এলাম ডরমেটরিতে। পাশেই বয়ে চলা ব্রহ্মপুত্রের বুকে পড়েছে চাঁদের ছায়া। সব মিলিয়ে মায়াবি এক পরিবেশ। রাতের খাওয়া দাওয়া শেষে রুমে ফিরে শুয়ে পড়লাম।  

পরদিন সকালে একাই বের হলাম। আগেই মোটামুটি খোঁজ নিয়ে রেখেছিলাম ভ্রমণের স্থান সম্পর্কে। পরিকল্পনা মতো রওয়ানা হলাম সীমান্তবর্তী বখশীগঞ্জ উপজেলার লাউচাপড়া অবকাশ কেন্দ্রের উদ্দেশ্যে। শহরের প্রান্তে শেরপুর ব্রিজ থেকে সিএনজিতে উঠলাম বখশীগঞ্জের উদ্দেশ্যে। লাউচাপড়া জামালপুরে পড়লেও শেরপুর থেকেই বেশি কাছে। প্রায় ৪০ কি.মি রাস্তা। পৌঁছাতে ঘণ্টা দেড়েক লাগলো।

সেখানে নেমে বেশ কিছুদূর হেঁটে সামনে থেকে স্থানীয় বাহন নসিমনে উঠলাম। বখশীগঞ্জ বাজার থেকে লাউচাপড়া প্রায় ১৫ কি.মি। এতোটা দূর অবশ্য ভাবিনি। তবু উদ্দেশ্য যেহেতু ঘোরাঘুরি তাই উপভোগ করছিলাম বেশ। লাউচাপড়া নেমে খোঁজ নিয়ে জানলাম আমার গন্তব্যস্থল গারো পাহাড় আরো প্রায় ৩ কি.মি। কি আর করা! ভ্যানে চড়ে রওয়ানা হলাম। পথিমধ্যেই আবহমান গ্রামীণ বাংলার দৃশ্য যে কোনো মানুষেরও মন ভালো করে দেবে।

পাহাড়ের কোল ঘেঁষে অবশেষে পৌছলাম লাউচাপড়া অবসর বিনোদন কেন্দ্রে। গেটের সামনেই বিশাল গাছকাটা উৎসব দেখে মনটা একটু খারাপ হলো। তবু সারা বাংলাদেশে এটাই বাস্তবতা। প্রবেশপথের পাশেই কৃত্রিম লেক। তার পাশেই চমৎকার রেস্ট হাউজ। কিছুদূর এগিয়ে ওয়াচটাওয়ারে উঠলাম। চারদিকে সবুজ আর সবুজ। দূরে দেখা যাচ্ছিলো ভারতের মেঘালয় রাজ্যের আকাশ ছোঁয়া সব পাহাড়। পাহাড়ে রয়েছে নানা বর্ণের পাখি। শুনেছি বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে মেঘালয় থেকে এখানে নেমে আসে বুনো হাতির দল। কাছেই রয়েছে গারোদের একটা ছোট গ্রাম। সময়ের অভাবে যাওয়া হল না সেদিকে।

ভ্রমণার্থীরা লাউচাপড়া গেলে ঘুরে আসতে পারেন গারোদের গ্রামে। সরকারি সঠিক পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এই স্থানকে গড়ে তোলা যাবে দেশের অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে। তবে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা অনেক ক্ষেত্রেই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে কৃত্রিম করে তোলে। তাই এসব না হলেই বরং এখন বেশি ভালো লাগে।

দুপুর হয়ে এলো। ক্ষুধায় পেট জ্বলছে। যেতে হবে আরো বহু পথ। তাই বের হলাম সেখান থেকে। ভ্যানে করে ফিরলাম লাউচাপড়া। সেখান থেকে নসিমনে আবার বখশীগঞ্জ বাজার। পরবর্তী গন্তব্য ইসলামপুরের কাঁসারীপট্টি। বাজারেই খাওয়া দাওয়া সেরে নিলাম। নসিমনে চড়ে কিছুদূর এসে তিন রাস্তার মাথায় নামলাম। খোঁজ নিয়ে জানলাম এখান থেকেই ইসলামপুরের মোটরসাইকেল পাওয়া যায়।

কিছুক্ষণ বসে চা পান করে মোটরসাইকেল ভাড়া করে রওয়ানা হলাম ইসলামপুর বাজারের উদ্দেশ্য। ঘাট পর্যন্ত ভাড়া ১২০ টাকা। কিছুদূর গিয়ে দেখলাম সামনের ব্রিজের কাজ চলছে। তাই যান চলাচল বন্ধ। তাই বলে তো মোটরসাইকেল থেমে থাকবে না। পার্শ্ববর্তী ধান খেতের মাঝখানের মাটির রাস্তা ধরে চলতে লাগলো মোটরসাইকেল। গ্রামের বিভিন্ন বাড়ির ভিতর দিয়ে ঘুরে পৌঁছলাম ইসলামগঞ্জ বাজারের এপারে নদীর ঘাটে। পথে বেশ কিছু জায়গায় দেখলাম পাট সংগ্রহের কাজ চলছে। এই অঞ্চলে এখনো বেশ ভালো পাট উৎপাদন হয়। খোলা মাঠের কিছু জায়গায় দু চারটে ঘোড়াও দেখলাম।

সেখান থেকে নৌকায় নদী পার হয়ে রিকশা নিয়ে গেলাম ইসলামপুরের বিখ্যাত কাঁসারীপট্টিতে। বিকেল হয়ে এসেছে তাই সবার কাজ প্রায় শেষের দিকে। এখন আর মাত্র অল্প কয়েকটি পরিবার এই এলাকার বিখ্যাত কাঁসার জিনিসপত্র তৈরির ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। কথা বলে জানতে পারলাম ঢাকা থেকে পাঠানো পুরনো কাঁসার ভাঙা টুকরো থেকেই তৈরি করা হয় চমৎকার সব তৈজসপত্র। কিছুটা ব্যয়বহুল হলেও কাঁসার জিনিসপত্র এখনো বেশ আভিজাত্য বহন করে চলছে।

কাঁসারীপট্টি থেকে রিকশা নিয়ে গেলাম ইসলামপুর বাজার। ইসলামপুর বাজার থেকে হঠাৎ করেই ইচ্ছা হলো মেলান্দহের বিখ্যাত ধ্রুব জ্যোতি ঘোষ মুকুল দা’র সঙ্গে দেখা করার। ফোনে যোগাযোগ করে আসার আগ্রহের কথা জানাতেই তিনি বললেন চলে আসতে। সিএনজিতে রওয়ানা হলাম মেলান্দহ।

তার আগে ধ্রুব জ্যোতি ঘোষের একটু পরিচয় দিয়ে নেওয়া প্রয়োজন। ধ্রুব জ্যোতি ঘোষের কথা প্রথম শুনেছিলাম জামালপুরের ছড়াকার মাসুম হাবিবের কাছে।

পরবর্তীতে আলোকচিত্রী হামিদুল হকের মৃত্যুর পরে জাদুঘরে আয়োজিত এক স্মরণানুষ্ঠানে তার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয়। সেদিনই নিজ থেকে আমন্ত্রণ নিয়েছিলাম তার বাড়িতে যাওয়ার। একাধারে চিকিৎসক, কবি, মাউন্টেইনার, ডিজাইনার, ভাস্কর নানা পরিচয়ের অধিকারী এই সত্তরোর্ধ মানুষটি।

মজার ব্যাপার হলো শারীরিক ফিটনেস দেখে কেউ ধারণাই করতে পারবে না তার বয়স সম্পর্কে। মেলান্দহে তার বাড়িটি সংস্কৃতি চর্চার এক অন্যতমস্থল। বাড়ির আনাচে কানাচে ছড়িয়ে আছে তার হাতের শিল্পের ছোঁয়া। বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি থেকে শুরু করে নানা ম্যুরাল ও চমৎকার স্থাপত্যশিল্প রয়েছে সেখানে। এর আগে এখান থেকে এসে ঘুরে ঘুরে গেছেন বাংলাদেশ ও কলকাতার সাহিত্যাঙ্গনের প্রখ্যাত নানা ব্যক্তিত্ব। এই বয়সেও স্বপ্ন দেখেন পৃথিবীর সবচেয়ে প্রবীণ ব্যক্তি হিসেবে এভারেস্ট জয় করার।

মেলান্দহে পৌছে মুকুল ডাক্তারের বাড়ির কথা বলতেই রিকশাওয়ালা নিয়ে এলো তার বাড়িতে। সদর দরজায় অভ্যর্থনা জানালেন তিনি। ঘুরিয়ে দেখালেন নিজের নানা স্থাপত্য ও কারুকাজ। চা নাস্তা খাওয়ার ফাঁকে অনেক কথা হলো তার সঙ্গে। নিজের রিডিং রুমে নিয়ে গিয়ে দেখালেন বিভিন্ন সময়ের অনেক ছবি। মাস তিনেক আগেই এভারেস্টের অন্নপূর্ণা-১ বেস ক্যাম্প ঘুরে এসেছেন। দেখালেন সেসব ছবি। এই বয়সী একজন মানুষের এতোটা উদ্যোম সবার জন্যই আসলে বিশাল অনুপ্রেরণা হতে পারে।

সন্ধ্যা হয়ে আসছে। ফিরতে হবে অনেকদূর তাই বিদায় নিলাম দাদার কাছ থেকে। মেলান্দহ বাজার থেকে সিএনজিতে উঠলাম। ফিরে এলাম গন্তব্যস্থল জামালপুর শহরে। এবারের মতো শেষ হল মিশন জামালপুর। মাথায় ঘুরছে পরের গন্তব্য শেরপুর।

প্রিয় পাঠক, ভ্রমণ যাদের নেশা, বেড়ানোর সুযোগ এলে যারা উড়িয়ে দেন সব বাধা, কাজের অংশ হিসেবে যারা ভ্রমণ করেন কিংবা যাদের কালেভদ্রে সুযোগ হয় ভ্রমণের তারা সবাই হতে পারেন ট্রাভেলার্স নোটবুক’র লেখক। আপনার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারেন বাংলানিউজের পাঠকদের সঙ্গে।

আর একটা কথা লেখার সঙ্গে ছবি পাঠাতে ভুলবেনই না, সেই সঙ্গে বাতলে দিন সেখানে যাওয়ার পথঘাটের বিবরণও।  

প্রিয় পাঠক, আপনার ভ্রমণ আনন্দ বিশ্বজুড়ে বাঙালির কাছে ছড়িয়ে দিতে আমাদের ই-মেইল করুন- 

               
বাংলাদেশ সময়: ০২২০ ঘণ্টা, মে ২৩, ২০১৫
এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।