ঢাকা, রবিবার, ১৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

পর্যটন

পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২৮)

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭১৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০২০
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২৮) সুরমা নদী

বাবর আলী। পেশায় একজন ডাক্তার। নেশা ভ্রমণ। তবে শুধু ভ্রমণ করেন না, ভ্রমণ মানে তার কাছে সচেতনতা বৃদ্ধিও। ভালোবাসেন ট্রেকিং, মানুষের সেবা করতে। সম্প্রতি চট্টগ্রামের এই ডাক্তার হেঁটে ভ্রমণ করেছেন দেশের ৬৪ জেলা। সেটা আবার ৬৪ দিনে। কেমন ছিল সেই অভিজ্ঞতা? সেটা নিয়ে ধারাবাহিকভাবে লিখেছেন বাংলানিউজের ট্রাভেলার্স নোটবুকে। ৬৪ দিনে থাকবে ৬৪ দিনের ভ্রমণ-অভিজ্ঞতা।

দিন ২৮
সিলেট -ফেঞ্চুগঞ্জ ( সিলেট) - আখড়াঘাট বাজার ( রাজনগর, মৌলভীবাজার) = ৩৪.৬৬ কি.মি.

সাধারণত প্রত্যেকদিনই আমি ভোর সাড়ে পাঁচটা থেকে ছয়টার মধ্যে উঠে পড়ি। আজ ইচ্ছে করেই সাড়ে ছয়টা নাগাদ বিছানা ছাড়লাম।

আজকের দূরত্ব তুলনামূলক কম বলেই এই নগণ্য বিলাসিতা।  

ইমদাদ ও সাইফুলের ওসমানী মেডিক্যাল লাগোয়া বাসা থেকে যখন রাস্তায় নেমেছি তখন সকাল সাতটা। বামে মোড় নিতেই হাসপাতালের জরুরি বিভাগের গেট। অল্প এগিয়েই এপ্রন পড়া একদল ছেলে-মেয়ের দেখা। পাশেই বাস দাঁড়ানো। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, এরা মেডিক্যালের তৃতীয় বর্ষের রেসিডেন্সিয়াল ফিল্ড সাইট ট্রেনিংয়ে যাচ্ছে। এই পনেরোটা দিন সব মেডিক্যাল শিক্ষার্থীরই খুব আনন্দে কাটে।  

মেডিক্যাল ক্যাম্পাসের পরেই সিলেটের ইসকন মন্দির। এই সকালেও বেজায় ভিড়। ভাতালিয়ার রাস্তা ধরে লামাবাজারের কাছেই এক বাড়ির সামনে বাগান বিলাসের পাপড়ি বিছানো। এই সকালে দৃশ্যটা দেখে দারুণ লাগলো।

কুশিয়ারা নদীদু-তিনটা মোড় ঘুরে সুরমা নদীর ওপর নির্মিত ক্বীন ব্রিজ। কত পুরনো এই ব্রিজ। এখনো এর আবেদন কমেনি। মোমিনখলা থেকে এন ২০৮ মহাসড়ক ধরে নিলাম। দিনের বাকি পথটুকু এই পথ ধরেই চলা। কিছুদূর এগোতেই হাতের ডানে সঙ্গী হলো রেললাইন। গুগল ম্যাপ বলছে আজ পুরোদিনই সঙ্গে থাকবে এই রেললাইন। শিববাড়ী মোড়ের আশেপাশে প্রচুর রড-সিমেন্টের দোকান। সেগুলো পেরিয়ে পড়ে গেলাম ময়লার পাহাড়ে। ময়লা জমতে জমতে আক্ষরিক অর্থেই পাহাড় হয়ে গেছে। আর উপরের আকাশটা ছেয়ে গেছে ময়লা খাবার লোভে উড়ে আসা কাকপক্ষীতে।  

নাকে শ্বাস চেপে জায়গাটা পার হতে একটা সাইনবোর্ড দেখে বেশ চমকে গেলাম। মেডিক্যাল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার প্রজেক্ট হাতে নেওয়া হয়েছে। সেটার জন্যই চলছে অবকাঠামো নির্মাণের কাজ। মেডিক্যাল বর্জ্য এই দেশের অন্যতম অবহেলিত বস্তু। সেই বিষয়টা নিয়ে টনক নড়েছে দেখে ভালোই লাগলো।

সিলেট বিভাগীয় স্টেডিয়ামের জন্য নির্ধারিত ভূমির জায়গায় দেখলাম বড়সড় এক দীঘি। তাতে আবার চলছে ইঞ্জিনচালিত ছোট নৌকা। সামনে যেতেই পীর হাবিবুর রহমান চত্বর। বামের রাস্তাটা গিয়েছে তামাবিলের দিকে। আমি সোজা রাস্তাই ধরলাম। বিলের মধ্যে বিকটাকার সব ইলেক্ট্রিক পোল। সেসব ছাড়িয়ে জনা ত্রিশেক লোক হাঁটু কাদাতে মাছ ধরতে ব্যস্ত।

ফেঞ্চুগঞ্জের সুদৃশ্য মসজিদ

দক্ষিণ সুরমা উপজেলা পরিষদের বিশাল আয়তনের কমপ্লেক্সটা পড়লো এর একটু পরেই। এই রাস্তায় শুধুমাত্র রাস্তার বাম পাশেই গাছ। ডান পাশটা পুরোপুরি ন্যাড়া বলা চলে। এর পেছনে কি কারণ কে জানে। একে একে পার হলাম খালোমুখ, তিরাশীগ্রাম, ত্রিমুখী প্রভৃতি জায়গা। চলার পথে অনেকেই কথা বলতে আসে। যারা সাহস সঞ্চয় করে কথা বলতে পারে না, তাদের অতিক্রম করার পরও এরা হাঁ করে পেছন দিক থেকে চেয়ে থাকে। আজ আমিও এটা নিয়ে হালকা মজা করা শুরু করলাম। আমি অতিক্রম করার একটু পরেই ওদেরই দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকি। এতে উনারা হালকা অপ্রস্তুত হয়ে আশেপাশের আকাশ-বাতাস দেখতে থাকেন।

এসব করতে করতেই মোগলা বাজার। অনেকগুলো দোকানপাট আছে এই বাজারে। বাজারের শেষে ছোট্ট একটা রেলস্টেশনও আছে। এই রাস্তায় বড় গাছ এক প্রজাতিরই। সেটা কড়ই গাছ। রেঙ্গায় লন্ডন-সিলেট ফ্রেন্ডশিপ অরগানাইজেশনের বেশ কার্যক্রম দেখলাম। বীরমঙ্গল পার হতেই রাস্তার বাম পাশে বড় একটা বিল। বিলে সাদা শাপলাই বেশি।

উত্তর কুশিয়ারা নামক ইউনিয়ন থেকে ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার সীমানা শুরু। কটালপুর বাজার পার হতেই বড় গাছ অদৃশ্য হয়ে গেলো। তার বদলে রাস্তার দুপাশে ঘন ঝোপ-ঝাড়। লাল টালির সুদৃশ্য ডুপ্লেক্স বাড়ি দেখলাম বেশ কয়েকটা। তালাবন্ধ এসব বাড়ি দেখেই ধারণা করা যায় এর মালিক লন্ডনি। ইলাশপুর পেরিয়েই কুশিয়ারা সেতুর উপরের টোল প্লাজা। হাতের ডানে নিচের বাজারটার নাম চান্দপুর বাজার।

মৌলভীবাজারে স্বাগতম

সেতুর উপর থেকে কুশিয়ারার দারুণ ভিউ দেখা যায়। বিশেষ করে বামের রেলসেতুটা দারুণ দেখায়। এই মাঝ নভেম্বরেও বেশ চওড়া এই নদী। সেতুর ওপারেই ফেরীঘাট বাজার এককালের ফেরী পারাপারের স্মৃতি বহন করছে। নুরপুরের কাছে সামনে বাগান সমেত সুদৃশ্য মসজিদ। ফেঞ্চুগঞ্জে প্রবেশের পর থেকেই রাস্তার দুপাশে মাঝারি সাইজের বেশ কিছু বরই গাছ পড়ছে। এগুলোর ডাল-পালা না ছাঁটায় আমার গা বাঁচিয়ে চলতে হচ্ছে।

ফরিদপুর নয়া বাজার, কর্মদা ছাড়িয়ে এত এত খাল-নদীর ভিড়ে রাস্তার পাশেই পেয়ে গেলাম একটা ছড়া। একে একে পার হলাম পালবাড়ী, কচুয়া বহর। মির্জাপুরের কাছে এসে ছোটখাটো টিলা পেলাম দু-একটা। কতদিন পাহাড় দেখি না আমি। টিলাতেই তাই মন ভরলো। চেলারচক নামক জায়গা থেকে প্রবেশ করলাম মৌলভীবাজার জেলায়। এর মধ্যেই ফোনে কথা হলো রাউফ ভাইয়ের সেঙ্গে। উনার বাড়িতেই থাকা হবে আজ।  

প্রাইমারি স্কুলের মাঠে খেলছিল কিছু বাচ্চা। আমাকে হেঁটে যেতে দেখে দুই-তিনজন চিং চং চং নামক অদ্ভুত শব্দ করতে লাগলো। আমি কাছে গিয়ে বললাম, আমি বাংলাদেশি হলেও তোমাদের এই চাইনিজ ভাষা বুঝি। দৌড়ে সরে গিয়ে খেলায় মনোযোগ দিল ওরা।

ময়লার পাহাড়আরও বেশ কিছু টিলা পেরিয়ে আখড়াঘাট নামক বাজার। আজকের হাঁটার ইতি টানা হলো এখানেই। এর মধ্যেই রাউফ ভাই বাইক নিয়ে চলে এলেন। আমাদের এখন যেতে হবে বেশ খানিকটা পেছনের দিকে। ফেঞ্চুগঞ্জ আর গোলাপগঞ্জ উপজেলার সীমান্তের গ্রামে উনার বাড়ি।

রাউফ ভাইয়ের বাইকটা দেখতে দারুণ। রয়েল এনফিল্ড টাইপ একটা অনুভূতি আসে বাইকে চাপলে। পেছন দিকে যাত্রা শুরু করতেই উনার বাড়ির গল্প শুরু করলেন রাউফ ভাই। উনার বাড়ির ঠিক পেছন থেকেই শুরু হাকালুকি হাওর। এইটা শুনেই আমি দারুণ উত্তেজিত।

কুশিয়ারা সেতুর নিচ দিয়ে যে রাস্তাটা নদীর পাড় ঘেঁষে এগিয়েছে সে রাস্তা ধরেই চলছি আমরা। সন্ধ্যার আগে পৌঁছাতে পারলে দিনের আলোয় হাওর দেখার একটা সুযোগ থাকবে। নদীর এপাশের গ্রামের নামটা বেশ মনে ধরলো। গ্রামের বাম হাওড়তলা। কুশিয়ারা নদীর ওপাড়ের একটা বেকারিতে বাইক রেখে নৌকায় নদী পার হয়ে উনার বাড়ির কম্পাউণ্ডে ঢুকতেই সন্ধ্যা নেমে এলো।  

আজকের দিনটা খানিকটা অদ্ভুত। আজকের গন্তব্য ছিল সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ। হাতে সময় থাকায় কিছুটা এগিয়ে ঢুকে পড়েছিলাম মৌলভীবাজারের রাজনগরে। আর এখন এসে থাকছি এর থেকে বেশ খানিকটা পেছনে গোলাপগঞ্জ উপজেলায়। ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে পড়লাম রাতের আঁধারে হাওর দেখতে।  

রাউফ ভাইয়ের ভাতিজা রিপন টর্চ জ্বালিয়ে মূল পথ প্রদর্শকের ভূমিকা পালন করছে। রাতের হাওর দেখেও যথেষ্ট মুগ্ধ। ওখান থেকে সরু একটা বাঁশের সাঁকো পেরিয়ে ছোট্ট একটা বাজারে প্রবেশ করলাম। একটা খোলা জায়গা কেন্দ্র করে তার তিনপাশে দোকানপাট। মাঝে বিশাল এক গাছ। বাজারের নাম কুশিয়ারা বাজার।  

ছোট্ট একটা বেঞ্চিতে বসে পেঁয়াজু খেতে খেতে রাউফ ভাই বলছিলেন, কুশিয়ারা যে হারে ভাঙছে আর শখানেক বছর পর আমাদের এই গ্রামের হয়তো আর কোনো অস্তিত্বই থাকবে না।

চলবে…

আরও পড়ুন...
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২৭)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২৬)​
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২৫)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২৪)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২৩)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২২)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২১)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২০)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৯)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৮)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৭)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৬)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৫)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৪)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৩)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১২)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১১)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১০)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৯)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৮)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৭)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৬)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৫)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৪)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (দিনাজপুর-৩)
পায়ে পায়ে ৬৪ জেলা (ঠাকুরগাঁও-২)
পায়ে পায়ে ৬৪ জেলা (পঞ্চগড়-১)

বাংলাদেশ সময়: ১২১৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০২০
এইচএডি/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।