ঢাকা, রবিবার, ১৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

পর্যটন

পর্যটনে নিরাপত্তা জরুরি 

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৩৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ২০, ২০২৩
পর্যটনে নিরাপত্তা জরুরি  অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া

বাংলাদেশ বহুমাত্রিক সৌন্দর্যের আধার। এদেশের উন্নয়ন ভাবনায় পর্যটন জায়গা দখল করে নিয়েছে।

অজানাকে জানার দূর্বার ইচ্ছা ও মানুষের বিনোদনের সব উপকরণ নিয়ে গড়ে উঠেছে পর্যটন শিল্প। পর্যটন এখন শুধু আনন্দের খোরাক নয়, এটি একটি শিল্প। যেকোনো স্থানের পর্যটন বিকাশের জন্য পূর্ব শর্ত হচ্ছে সে স্থানের নিরাপত্তা। পৃথিবীর প্রায় সকল দেশে পর্যটন এখন অন্যতম প্রধান অগ্রাধিকার খাত। নিরাপত্তা ও অবকাঠামোগত সুযোগ সুবিধা পর্যটন বিকাশের পূর্বশর্ত। পর্যটন বান্ধব পরিবেশ পর্যটকের আস্থা ও  বিশ্বাস বৃদ্ধি করে। কিছুদিন পূর্বে ঘটে যাওয়া গণধর্ষনের ঘটনাটি বাংলাদেশের পর্যটন ক্ষেত্রে নিরাপত্তার ওপর প্রশ্ন তুলে ধরে। দেশের প্রধান পর্যটন স্থল কক্সবাজারে ১২৫০ জন পর্যটকের নিরাপত্তার জন্য রয়েছে মাত্র একজন পুলিশ। সন্ধ্যার পর এ এলাকায় নিরাপত্তা সংকট এখন অনিবার্য ইস্যু। দুনিয়ার দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতে পর্যটকদের আগমন নিশ্চিত করতে নিরাপত্তার দিকটিকে গুরুত্ব দিতে হবে।  

প্রায় দুই বছর পর মহামারি কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে পুরো দেশ। জমজমাট দেশের পর্যটন কেন্দ্রগুলোও। প্রতিদিনই দেশের পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে বাড়ছে ভ্রমণপিপাসু মানুষের পদচারণা। কিন্তু এসব জায়গার বেশিরভাগেই নেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যথাযথ তৎপরতা। ফলে বেড়েই চলছে নানা ধরনের অপকর্ম। স্থানীয়দের হাতে প্রায়ই পর্যটকদের হেনস্তা হওয়ার খবর পাওয়া যাহচ্ছে। শারীরিক হেনস্তার পাশাপাশি ঘটছে ধর্ষণের মতো ঘটনাও। তাই দেশের পর্যটন খাতকে গতিশীল রাখতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা আরও বাড়ানোর তাগিদ সংশ্লিষ্টদের। জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র সিলেটের জাফলংয়ে টিকিট কেনাকে কেন্দ্র করে পর্যটকদের সঙ্গে কাউন্টারের লোকদের বাগ্বিতণ্ডা হয়। একপর্যায়ে কাউন্টারে থাকা স্বেচ্ছাসেবকরা লাঠিসোঁটা দিয়ে পর্যটকদের পেটাতে শুরু করে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এক ভিডিওতে এক কিশোরীর গায়ে হাত তোলার দৃশ্যও আতঙ্কিত করে দেয় সাধারণ পর্যটকদের।  

যদিও সরকার দেশের পর্যটনস্থলে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। এখানে বলা বাহুল্য, ট্যুরিস্ট পুলিশদের সার্বিক সহযোগিতায় পূর্বের তুলনায় কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে অপরাধের অভিযোগ অনেকাংশে কমেছে এবং রাতের বিচ এখন আগের তুলনায় বেশ নিরাপদ। ট্যুরিস্ট পুলিশদের আরো বেশি সতর্ক থাকতে হবে এবং অপরাধকে কঠোর হাতে নির্মূল করতে হবে। উন্নত দেশগুলোতে পর্যটকদের নিরাপত্তার জন্য সঠিক ব্যবস্থাপনার ব্যবহার প্রশংসার দাবিদার। আমাদের দেশেও ব্যবস্থাপনা আরো দৃঢ় করতে হবে। অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে বাড়তি নজরদারি এবং আধুনিক উন্নত ব্যবস্থাপনা পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে।

এখানে বলা বাহুল্য যে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সীমাবদ্ধতা আছে। লাখ লাখ পর্যটকের নিরাপত্তায় আছেন মাত্র ২১১ জন ট্যুরিস্ট পুলিশ। হিমছড়ি, রামু, সোনাদিয়া, সাবরাং, টেকনাফসহ বহু স্থানে পর্যটকের নিরাপত্তায় কেউ নেই। ২০১৫ সালে বিদেশি একজন নারী পর্যটক ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন। বিভিন্ন পর্যটন স্থানে এমন বহু ঘটনা দেখা গেছে বিগত বছরগুলোতে। ট্যুরিস্ট পুলিশের সীমাবদ্ধতা ছাড়াও সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবকে দায়ী করা যায় এরূপ অবস্থার পেছনে। হোটেল, মোটেলগুলোতে তেমন কোনো নিরাপত্তার উদ্যোগ দেখা যায় না। তাদের উদ্দেশ্য শুধু ব্যবসা করা। হোটেল ব্যবসায়ীরা পর্যটকদের নিরাপত্তার ব্যাপারে তেমন সচেষ্ট নয়।  

প্রতি বছর বিশ্ব পর্যটন সংস্থা (ইউএনডব্লিউটিও) পর্যটকের সংখ্যা বৃদ্ধিতে সর্বাধিক ধনী দেশের তালিকা তৈরি করে। বিশ্ব পর্যটন সংস্থার মতে ২০১৮ সালে ১০টি শীর্ষ পর্যটকদের দেশ হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ইতালি, মেক্সিকো, যুক্তরাজ্য, তুরস্ক, জার্মানি ও থাইল্যান্ড। অথচ বিশ্বের অন্যতম পর্যটন বান্ধব দেশ হয়েও সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার অভাবে বাংলাদেশ পর্যটন শিল্পে তলানিতেই পড়ে আছে। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) ‘ভ্রমণ ও পর্যটন প্রতিযোগী সক্ষমতা প্রতিবেদন-২০১৭’ অনুযায়ী ১৩৬ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২৫ তম। ১৯৫০ সালে পৃথিবীতে পর্যটকের সংখ্যা ছিল ২৫ মিলিয়ন ২০১৬ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ হাজার ২৩৫ মিলিয়নে। ধারণা করা হচ্ছে এ বছর প্রায় ১৩৯ কোটি ৫৬ লাখ ৬০ হাজার পর্যটক সারাবিশ্বে ভ্রমণ করবেন। অর্থাৎ বিগত ৬৭ বছরের পর্যটক সংখ্যা প্রায় ৫০ গুণ বেড়েছে। পর্যটকের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের পরিধি ব্যাপকতা লাভ করেছে।  

বাংলাদেশ সরকার পর্যটন শিল্পের বিকাশ ও উন্নয়নকে গতিশীল করতে বহুবিধ প্রকল্প হাতে নিয়েছে। ২০২০-২১ অর্থ বছরে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩ হাজার ৬৩৪ কোটি টাকা। করোনা পরবর্তী দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকার পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। সম্প্রতি সরকার পর্যটন শিল্পের ব্যাপক উন্নয়ন ও বিকাশের পাশাপাশি দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণের লক্ষ্যে একটি মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করছে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড। আগামী ১৮ মাসের মধ্যে এটি সম্পন্ন হবে। মহাপরিকল্পনার অংশ হিসেবে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা অনুযায়ী পর্যটন উন্নয়ন কাজ পরিচালিত হবে। ২০১৬-২০২১ সালকে পর্যটন বর্ষ হিসেবে উদযাপন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। উন্নয়ন ও বিকাশের লক্ষ্যে ২০১৫-২০১৮ তিন অর্থ বছরে আনুমানিক ২০০কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। এর মাধ্যমে পর্যটন শিল্পের বিদ্যমান ও সম্ভাব্য স্থান গুলোর পরিকল্পিত উন্নয়ন নিশ্চিত করা হবে।

২০২৫ সালের মধ্যে পর্যটন শিল্পের বিকাশে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। পুরো দেশকে আটটি পর্যটন জোনে ভাগ করে প্রতিটি স্তরে এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রথম বারের মতো সরকারি-বেসরকারি যৌথ বিনিয়োগের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর অংশ হিসেবে কক্সবাজারে পর্যটন অবকাঠামো নির্মাণে ২৫টি প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এগুলোতে প্রায় প্রত্যক্ষভাবে বিনিয়োগ হবে ৩৭ হাজার কোটি টাকা। পরোক্ষ ভাবে বিনিয়োগ হবে এক লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া ও সরকারের প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে; কক্সবাজার বিমান বন্দর উন্নয়ন, আধুনিক হোটেল-মোটেল নির্মাণ, মহেশখালীতে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ, সোনাদিয়াকে বিশেষ পর্যটন এলাকা হিসেবে গড়ে তোলা, ইনানি সৈকতের উন্নয়ন, টেকনাফের সাবরায়েং ইকো ট্যুরিজম পার্ক নির্মাণ, শ্যামলাপুর সৈকতের উন্নয়ন, ঝিলংঝা সৈকতের উন্নয়ন, চট্টগ্রাম কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণ, কুতুবদিয়ায় বায়ু বিদ্যুৎ প্রকল্পের সম্প্রসারণ, চকোরিয়ায় মিনি সুন্দরবনে পর্যটকদের গমনের জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, ডুলাহাজরা সাফারি পার্কের আধুনিকায়ন  ইত্যাদি। এছাড়া আরও চারটি নতুন প্রকল্প নিতে যা হচ্ছে সরকার। এসব বাস্তবায়িত হলে আগামীতে দেশের পর্যটন খাত আরও চাঙা হবে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতও পিপিপির মাধ্যমে বিনিয়োগ করা হবে। এর মধ্যে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কক্সবাজারে যাতায়াত করার জন্য রেললাইন নির্মাণ করা হচ্ছে।

পর্যটন শিল্প বিকাশে অবারিত সুযোগ রয়েছে বাংলাদেশে। বিদেশি পর্যটক নির্ভরতা ছাড়াও দেশের পর্যটক নিরাপত্তা, যোগাযোগের সুবিধা, আকর্ষণীয় অফার এবং পর্যটন ব্যবসায়ীদের মধ্যে থাকলে দেশের মানুষের আগ্রহ নিয়ে দেশ ঘুরে দেখতে চাইবে। এক হিসেবে বলা হয়, ১৬ কোটির বেশি মানুষ গড়ে প্রতি বছর ১০ ভাগও যদি দেশ ঘুরে দেখে, তাহলে বিশাল অংকের অর্থনৈতিক তৎপরতার সৃষ্টি হবে। দেশের অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বড় পরিবর্তন করেছে পর্যটন শিল্প বিকাশের ফলে। ২০০৯ সাল থেকে ২০১৭ সাল গত আট বছরে ছয় হাজারের ৬৯৯.১৬ কোটি টাকা পর্যটন শিল্পের মাধ্যমে আয় হয়েছে। বিভিন্ন উৎসবকালীন মানুষ ঘুরে বেড়ানো যে প্রবণতা তা এই অর্থনৈতিক বিকাশকে আরো বাড়িয়ে দেবে। বিশ্ব পর্যটন সংস্থার পক্ষ অনুযায়ী সমগ্র বিশ্বে ২০২০ সাল নাগাদ পর্যটন থেকে প্রতিবছর ২ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় হবে। ২০৫০ সাল নাগাদ ৫১ টি দেশের পর্যটক আমাদের দেশে আসবে। বাংলাদেশের জিডিপির ১০শতাংশ পর্যটন খাত থেকে আয় করা সম্ভব।

বাংলাদেশের সৌন্দর্যে যুগে যুগে বহু পরিব্রাজক ও ভ্রমণকারী মুগ্ধ হয়েছেন। স্বাভাবিকভাবেই এই সৌন্দর্যের লীলাভূমি বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন সম্ভাবনা অপরিসীম। আমাদের রয়েছে সুবিশাল সমুদ্র সৈকত, পাহাড়, জলপ্রপাত, ঐতিহাসিক নিদর্শনসহ নানান ধরনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত স্থান, যা পর্যটকদের আকৃষ্ট করার জন্য যথেষ্ট। নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সমৃদ্ধ ইতিহাস, বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতি আমাদের দেশকে পরিণত করেছে একটি বহুমাত্রিক আকর্ষণ সমৃদ্ধ অনন্য পর্যটন গন্তব্যে, বাংলাদেশকে গড়ে তুলছে পর্যটকদের জন্য তীর্থস্থান হিসেবে।

আধুনিক জীবনে চাওয়া মাথায় রেখে একটু সচেতন হলেই পর্যটন সক্ষমতা বাড়িয়ে বিপুল সংখ্যক বিদেশি দর্শনার্থীকে নিজের দেশে আনতে পারি। যা আমাদের পর্যটন শিল্পের বিকাশে ভূমিকা রাখবে।  

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া
ট্রেজারার, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়

বাংলাদেশ সময়: ১১৩৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ২০, ২০২৩
এসআইএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।