ঢাকা, রবিবার, ১৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

তারার ফুল

একজন শিবকুমার শর্মা এবং তার সন্তুর

খায়রুল বাসার নির্ঝর, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৪৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ৩০, ২০১৫
একজন শিবকুমার শর্মা এবং তার সন্তুর শিবকুমার শর্মা / ছবি- সোলায়মান হারুনী মৃদুল- বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

শিবকুমার শর্মার সঙ্গে তার বাবা উমা দত্ত শর্মার মূল পার্থক্যটা কোথায়? অথবা প্রসঙ্গটি এভাবে না হয়ে, শুরু হতে পারে তার বক্তব্যকে কোট করেও, ‘আমি আলাদা’। যখন শিবকুমার শর্মা বাবার কথা বলেন, এবং একটু পর ছেলে রাহুল শর্মার কথা; তখন তুলনামূলক বিচারে প্রশ্ন বেরিয়েই যায়, ‘তার মানে আপনি আপনার বাবার মতো নন?’ মাথা ঝুঁকিয়ে আরেকবার প্রশ্নটি শুনে নিয়ে, সেকেন্ডখানিক চুপ থাকেন, স্বর প্রক্ষেপণ আরও একধাপ নিচে নামিয়ে, জবাব দেন, ‘আমি আলাদা।



কোথায় আলাদা- সেটার উত্তর পেতে গেলে শুনতে হবে কথোপকথনের আগাগোড়া। ৩০ নভেম্বর সকালে ঢাকার একটি হোটেলে এই সংগীতগুরুর মুখোমুখি বসে, প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে, আমরা চুপচাপ বসে থাকি। তিনি আমাদেরকে ফিরিয়ে নিয়ে যান শৈশবে। বয়স কতো তখন? বছর পাঁচ। এর আগে থেকেই সংগীতে তার নেশা। হওয়ারই কথা। সংগীত-পরিবারেই জন্ম, ওই আবহেই বেড়ে ওঠা। তবলা ছিলো ভীষণ প্রিয়। বাবা বললেন- তবলা নয়, সন্তুর বাজাতে হবে। এখন যে সন্তুর নামক যন্ত্রটি নিয়ে পৃথিবী ঘুরছেন শিবকুমার শর্মা, সেটি হাতে তুলে নিয়েছিলেন বাবার আগ্রহেই। বাবা তার এ যন্ত্রটি নিয়ে গবেষণা করেছেন বহু বছর ধরে। তো, শিবকুমার সন্তুর ধরলেন ঠিকই, ‘তবে প্রথমে অতোটা খুশি মনে নয়’। বাবা শেখাচ্ছেন, তিনি শিখছেন। তবলা থেকে সন্তুরে প্রেম জন্মাতে বেশিদিন লাগেনি তারপর।

এই শিবকুমার যখন শারীরিক গঠনে-সুনামে-খ্যাতিতে আরও বড় হয়ে উঠলেন, উত্তরাধিকারীও জন্ম নিলো রাহুল শর্মা, বাবার মতো করলেন না একেবারেই। ছেলেকে ‘গান শেখো’ বললেন না একবারও। অবশ্য স্ত্রীর দিকেও খানিকটা চেয়ে, বলা যায়। ‘সংগীত পাগল’কে বিয়ে করে বেচারী বেশ বিপাকে! শিবকুমার তো সংসার বিষয়ে উদাসী মাত্রারিক্ত। গানেই বসবাস। একা হাতে তার স্ত্রীই সামলেছেন সব। ‘এমনকি আমার কঠিন সময়েও, যখন স্ট্রাগল করছি, ও-ই সামলেছে, উৎসাহ দিয়েছে’- বলেন তিনি, একইসঙ্গে জানিয়ে দেন, ছেলেও যদি সংগীতে ডুবে যায়, তবে স্ত্রীর আর দূর্দশার অন্ত থাকবে না, এমন ভাবনাও ছিলো।

কিন্তু রাহুল শর্মা তো বাবার পথেই মনোযোগি পা ফেলেছেন। বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবের গত আসরেও বাজিয়ে গেছেন, এসেছেন এবারও। দাপিয়ে উচ্চাঙ্গ-ভ্রমণ করছেন বিশ্বজুড়ে। কে দিলো অনুপ্রেরণা? শিবকুমার নড়েচড়ে বসেন। ঘটনা মেলে ধরেন, ‘জাপানে গিয়েছিলাম একবার। রাহুলের তখন দশ বছর বয়স। তখনও সে গান ধরেনি। ’ ছোট বাঁশির মতো একটা বাদ্যযন্ত্র তাকে দিলেন। বলছেন, ‘সে এতো ভালো বাজালো! আমি অবাক! তখন আমার স্ত্রীকে বললাম সব। এরপরও কখনও গান শেখার জন্য তাগাদা দিইনি। যখন রাহুল কলেজে উঠলো, আরও বড় হলো; তারপর সে নিজেই আগ্রহী হয়ে শিখতে শুরু করলো। ’

বাবার সঙ্গে শিবকুমারের পার্থক্য এখানেই- কখনও তিনি ছেলেকে জোরের স্বরে বলেননি, ‘এটা শিখতে হবে। ’ ছেড়ে দিয়েছেন ইচ্ছার ওপর। আগ্রহের ওপর।

চেয়ারে বসে হাঁটুর ওপর উল্টো করে ছড়িয়ে দিয়েছেন ফর্সা-লম্বা আঙুলগুলো, এক হাতের। অন্যহাত রেখেছেন তার ওপর, যেন নির্ভরতায়, মমতায়! খুব শান্ত-স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললেন তারপর, ‘আমাকেও সমালোচনার শিকার হতে হয়েছিলো। ’ শুনে কপালে কয়েকটি বিস্ময়ের রেখা ভাঁজ হয়ে আটকে থাকে কিছুক্ষণ। বলে চলেন, ‘আমি যে সন্তুর দিয়ে উচ্চাঙ্গসংগীতের চর্চা করি, এটা প্রথমে সংগীতগুরুরা স্বাভাবিকভাবে নেননি। তারা যুক্তি ছিলো, ফোক মিউজিকের ইন্সট্রুমেন্ট দিয়ে উচ্চাঙ্গ-চর্চা কেন! বাবা আমাকে সব সময় দিক-নির্দেশনা দিতেন। আমিও বাজাতে থাকলাম। যারা এ বিষয়ে ক্রিটিকাল ছিলেন প্রথমে, তারা বাধ্য হলেন পরবর্তীতে তাদের ধারণা পাল্টাতে। ’

খুব স্বাভাবিক-শান্ত স্বরে একজন শিবকুমার শর্মা একটি পরিবর্তনের গল্প বলে চলেন। বলে চলেন, রক্ষণশীলদের নানা বাধার মধ্য দিয়ে কীভাবে সন্তুরকে বিশ্ব দরবারে জনপ্রিয় করলেন, প্রতিষ্ঠিত করলেন- সে গল্প। রাজকীয় চেয়ারটা ছেড়ে উঠে দাঁড়ানোর আগে, ভাঙিয়ে দেন একটি বহুল প্রচলিত ভুল, ‘সন্তুর কিন্তু ফোক মিউজিকের না, এটা মূলত সুফি মিউজিকের ইন্সট্রুমেন্ট। ’

বাংলাদেশ সময়: ২১৩০ ঘণ্টা, নভেম্বর ৩০, ২০১৫
কেবিএন/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

তারার ফুল এর সর্বশেষ