ঢাকা, রবিবার, ১৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

সালতামামি

সালতামামি ২০২০

সোলাইমানি-ফখরিযাদে হত্যা ও ট্রাম্পের পরাজয়ের বছর

আন্তর্জাতিক ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৩৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৬, ২০২০
সোলাইমানি-ফখরিযাদে হত্যা ও ট্রাম্পের পরাজয়ের বছর

করোনা ভাইরাসের দুঃসংবাদ দিয়ে শুরু হয় ২০২০ সাল। এ ভাইরাসের প্রকোপে ‘বিশ্বগ্রাম’ ধারণা মুখ থুবড়ে শুধু পড়েনি, সেই ধারণাকে একেবারে অচল মনে হচ্ছিল।

তা হবে না কেন? যেভাবে সীমান্ত বন্ধের হিড়িক পড়েছিল তাতে এমনটা ভাবা ছাড়া উপায়ও ছিল না। প্রাণঘাতী এই ভাইরাস মহামারিতে রূপ নেওয়ার পর বিশ্বব্যাপী ঝরেছে বহু প্রাণ।

তবে এই বৈশ্বিক মহামারির মধ্যেও থেমে ছিল না যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি। দেশটি ইরানকে কাবু করতে নানা চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে বরাবরই। বহু অপেক্ষার পর সুযোগ আসে হাতে। হত্যা করা হয় ইরানের কুদস ফোর্সের কমান্ডার কাসেম সোলাইমানিকে। বছরের শেষদিকে এসে হত্যা করা হয় ইরানি পরমাণু বিজ্ঞানী মোহসেন ফখরিযাদেকে।

এছাড়াও সীমান্তে ভারত-চীনের মধ্যে লড়াই, নাগরনো-কারাবাখে আজারবাইজান-আর্মেনিয়ার যুদ্ধ, লেবাননে বিস্ফোরণ, ইসরায়েলের সঙ্গে সংযুক্ত আরব আমিরাত-বহরাইন-সুদান-মরক্কোর সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য চুক্তি, যুক্তরাষ্ট্র-তালেবান চুক্তি এবং তুরস্ক-গ্রিসের মধ্যে উত্তেজনার মধ্যে নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরাজয় আলোচনায় ছিল বছরজুড়ে।

কাসেম সোলাইমানি হত্যা

ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ড (আইআরজিসি)-এর কমান্ডার ছিলেন জেনারেল কাসেম সোলাইমানি। আর রেভল্যুশনারি গার্ডের ‘কুদস্ ফোর্স’-এর কমান্ডারও ছিলেন তিনি। ছিলেন ইসরায়েলের মোসাদ এবং যুক্তরাষ্ট্রের সিআইএর হিটলিস্টে। এরমধ্যেও নির্বিঘ্নে তিনি ইরানের স্বার্থ রক্ষা করে গেছেন বহুদিন। কিন্তু তর যেন সইছিল না ডোনাল্ড ট্রাম্পের। তারই নির্দেশে ইরাকের মাটিতে হামলা চালিয়ে কাসেম সোলাইমানিকে হত্যা করা হয়।

হামলায় ইরাকের এক জনপ্রিয় নেতাসহ বেশ কয়েকজন নিহত হন। এর প্রতিশোধ নিতে ইরান ইরাকে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটিতে হামলা চালায়। বিরাজ করে যুদ্ধাবস্থা। কিন্তু বিশ্বের জন্য স্বস্তির বিষয় হলো, যুদ্ধে জড়ায়নি ইরান-যুক্তরাষ্ট্র। এখনো ইরান তাদের জেনারেলকে হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার হুমকি দেয় প্রায়ই। তাদের দাবি, হত্যায় জড়িতদের বিরুদ্ধে সময়মতো প্রতিশোধ নেওয়া হবে।

ফখরিযাদে হত্যা

ইরান পরমাণু অস্ত্র তৈরি করতে পারে— এমন আশঙ্কা থেকেই ইউরোপ-আমেরিকা-ইসরায়েল তটস্থ। মূলত, ইসরায়েলের ‘নিরাপত্তার’ জন্যেই আমেরিকা এবং ইউরোপ একজোট হয়ে ইরানের বিরুদ্ধে একই কাতারে এসে দাঁড়িয়েছে। বহু দেনদরবার এবং কূটনৈতিক প্রচেষ্টা শেষে ২০১৫ সালে বারাক ওবামা প্রেসিডেন্ট থাকাকালে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্স, রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে পরমাণু চুক্তি হয় ইরানের। পরে ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর এ চুক্তি থেকে নিজেদের সরিয়ে নেন। এরপর থেকে জটিলতা বাড়তে থাকে। শর্ত অনুযায়ী ইউরোপ কথা না রাখায় চুক্তি মানার ক্ষেত্রে ইরানও ঢিল দিতে শুরু করে। এমন সময় ইরানের পরামাণু কর্মসূচিকে থামিয়ে দিতেই মূলত দেশটির গবেষণা ও উদ্ভাবনী সংস্থা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রধান মোহসেন ফখরিযাদেকে হত্যা করা হয়।

ইসরায়েল এবং পশ্চিমা গোয়েন্দারা ফখরিযাদেকে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির প্রধান স্তম্ভ বলেই মনে করতো। এ ঘটনায় ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি ইসরায়েলকে দায়ী করেছেন।

লেবাননে বিস্ফোরণ

ইরানের সঙ্গে হিজবুল্লার ঘনিষ্ঠতা, দুর্নীতি নিয়ে সরকারের টালমাটাল অবস্থা এবং ইসরায়েলের সঙ্গে বিরোধপূর্ণ সম্পর্কের কারণে লেবানন ছিল আলোচনার কেন্দ্রে। যেকোনো সময় ইসরায়েল-হিজবুল্লাহর কথার লড়াই সংঘাতে রূপ নিতে পারে, এমন আশঙ্কা করছিলেন সমরবিদরা। কিন্তু আগস্টের শুরুতে দেশটির রাজধানী বৈরুত বন্দরে এক ভয়ানক বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে প্রায় ২শ’ মানুষের। আহত হয়েছেন অসংখ্য।

বিস্ফোরণের ঘটনার সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পৃক্ততা আছে বলে অভিযোগ তোলা হয়েছিল সেই সময়। আবার অভিযোগ ছিল, হিজবুল্লাহর অস্ত্রের গুদামে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। দুটি অভিযোগই হালে পানি পায়নি। পরে লেবাননের প্রেসিডেন্ট মিশেল আউন বলেছেন,  গুদামে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রাখা ২৭৫০ টন অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটের কারণে বিস্ফোরণ হয়েছে।

নাগরনো-কারাবাখ যুদ্ধে আজারবাইজানের বিজয়

নাগরনো-কারাবাখকে কেন্দ্র করে ২৭ সেপ্টেম্বর যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান। যুদ্ধ স্থায়ী হয় ছয় সপ্তাহ। যুদ্ধে তুরস্ক আজারিদের সরাসরি সমর্থন দিয়ে গেছে। পরে রাশিয়ার মধ্যস্থতায় আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়।

১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার পর থেকেই আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছিল। এর শুরুটা হয় আর্মেনিয়া দ্বারা আজারবাইজানের ভূখণ্ড নাগরনো-কারাবাখ দখলের মধ্য দিয়ে। ১৯৯৪ সালে আন্তর্জাতিকভাবে আজারবাইজানের অংশ হিসেবে স্বীকৃত নাগরনো-কারাবাখ ও আরও সাত অঞ্চল আর্মেনিয়া দখল করে নিলে উত্তেজনা নতুন দিকে মোড় নেয়।

সেই সংঘাত এবং উত্তেজনার সমাপ্তি টানলো সাম্প্রতিক ছয় সপ্তাহের যুদ্ধে। এতে আজারবাইজানের প্রায় ২ হাজার ৮শ’র বেশি এবং আর্মেনিয়ার ৩ হাজারের মতো সেনার প্রাণ গেছে।

ট্রাম্পের পরাজয়

যুক্তরাষ্ট্রের মসনদে ফের বসার স্বপ্ন নিয়ে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেছিলেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। কিন্তু ডেমোক্র্যাট পার্টির প্রার্থী জো বাইডেন জিতবেন, এমন পূর্বাভাস মিলছিল নানা জরিপ থেকে। অবশেষে পূর্বাভাসই সত্যি হয়েছে। পরাজিত হয়েছেন ট্রাম্প। যদিও তিনি হার মেনে নিতে নারাজ। নির্বাচনে জো বাইডেন পেয়েছেন ৩০৮ আর ট্রাম্প পেয়েছেন ২৩২ ইলেক্টোরাল ভোট। ২০২১ সালের ২০ জানুয়ারি জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেবেন।

লাদাখে চীন-ভারত সংঘাত

দীর্ঘদিন ধরে শত্রুভাবাপন্ন সম্পর্ক থাকলেও সীমান্তে সংঘর্ষে জড়ায়নি ভারত-চীন। সংঘর্ষের পরিস্থিতি তৈরি হলে কৌশলে এড়িয়ে গেছে উভয় দেশ। কিন্তু ১৫ জুন আর পরিস্থিতি আগের মতো থাকেনি। ১৯৭৫ সালের পর ফের চীন ও ভারতের মধ্যে গালওয়ান উপত্যকায় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে ভারতের এক কর্নেল পদমর্যাদার কর্মকর্তাসহ সেনাবাহিনীর মোট ২০ সদস্য নিহত হন। ভারতের দাবি, চীনের ৪৫ জনের মতো সেনা ওই সংঘর্ষে প্রাণ হারিয়েছেন। ১৯৬২ সালেও সীমান্ত বিরোধ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে সংক্ষিপ্ত যুদ্ধ হয়।

ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার হিড়িক

ফিলিস্তিনিদের ভূমি দখল করে ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্রের সূচনা। এরপর থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে। কিন্তু ফিলিস্তিনিদের অধিকারের প্রতি সমর্থন জানিয়ে মুসলিম অধ্যুষিত মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বহু দেশ ইসরায়েলের সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক জিইয়ে রাখে। কিন্তু এরমধ্যে চাপে পড়ে হোক বা নানা অবৈধ সুবিধার লোভে সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, সুদান এবং মরক্কো ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে ‘বাধ্য’ হয়। যার জন্য সরাসরি কাজ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তার মেয়ে জামাই জেরাড কুশনার। দেখা যাক, ইসরায়েলের সঙ্গে দেশগুলোর সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের ফল কী আসে।

যুক্তরাষ্ট্র-তালেবান চুক্তি

দেড় যুগ কম সময় নয়। এ সময়ের মধ্যে বিশ্বে কতকিছুর বদল ঘটেছে তার ইয়াত্তা নেই। কিন্তু বদল ঘটছিল না শুধু একটি বিষয়ের। সেটা হলো আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসনের অবসান। ২০০১ সালে টুইন টাওয়ারে আত্মঘাতী হামলার পর আফগানিস্তানে সেনা মোতায়েন করে যুক্তরাষ্ট্র। এরপর থেকে আফগানিস্তানে প্রাণ গেছে অগুণতি মানুষের।

প্রায় ১৯ বছর পর ২০২০ সালে এসে যুক্তরাষ্ট্র ও তালেবানের মধ্যে শান্তিচুক্তি হয়। দীর্ঘদিনের সহিংসতা বন্ধের আশায় বুক বাঁধছেন আফগানরা। আশা করা যাচ্ছে, এই চুক্তি আফগানিস্তানে শান্তি আনবে।  

চুক্তি অনুযায়ী, ১৪ মাসের মধ্যে আফগানিস্তান থেকে সেনাদের সরিয়ে নেবে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো জোট।

তবে চুক্তি হলেও দেশটিতে বোমা হামলার ঘটনা দিন দিন বেড়েই চলেছে, ঝরছে প্রাণ। দেশটির ক্ষমতাসীন সরকার এবং তালেবানের মধ্যেও সমঝোতা দরকার। যদি তা না হয় তবে যুক্তরাষ্ট্র-তালেবানের মধ্যে চুক্তি কোনো সফলতা বয়ে আনতে পারবে কি-না তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়।

বাংলাদেশ সময়: ০৮৩২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৬, ২০২০
এইচএডি/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।