ঢাকা, রবিবার, ১৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি

বিদ্যুৎ খাতের কফিনে শেষ পেরেক!

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৪৪৯ ঘণ্টা, জুন ২৩, ২০১৩
বিদ্যুৎ খাতের কফিনে শেষ পেরেক!

ঢাকা: বিদ্যুৎ খাতের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকতে যাচ্ছে সরকার। কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মালিকদের মুনাফা নিশ্চিত করার জন্যই এমনটি করা হচ্ছে বলে দাবি করেছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা।


 
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে তিনটি রেন্টাল (তিন বছর মেয়াদী) ও ১৭টি কুইক রেন্টাল (পাঁচ বছর মেয়াদী)বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করে। যার মোট উৎপাদন ক্ষমতা রয়েছে এক হাজার ৬৫৩ মেগাওয়াট। এর আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় উৎপাদনে আসে আরও পাঁচটি রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র।
 
রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর কয়েকটি চলতি বছরে আর বেশিরভাগই ২০১৫ সালের দিকে মেয়াদ শেষ হবে। বহুল সমালোচিত এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই ১৫ বছর মেয়াদী আইপিপিতে(ইন্ডিপেন্ডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার)রূপান্তর করতে উদ্যোগ নিয়েছে মন্ত্রণালয়।
 
এরই মধ্যে বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মোফাজ্জেল হোসেনকে প্রধান করে আট সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে আইনি কাঠামো ও সম্ভাব্যতা যাচাই করে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে।
 
মোফাজ্জেল হোসেন বাংলানিউজকে জানান, তারা কাজ শুরু করেছেন। চূড়ান্ত রিপোর্ট দিতে কিছুদিন সময় লাগবে। চলতি মাসের শেষ দিকে রিপোর্ট জমা দিতে পারবেন বলে আশা করছেন তিনি।
 
তিনি জানান, “আইনি জটিলতা রয়েছে, আইপিপি করা যাবে না। মেয়াদ বাড়ানো যেতে পারে। তবে এর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে কী না সবকিছু পরীক্ষা করেই রিপোর্ট দেওয়া হবে। ”
 
কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পক্ষে সাফাই গেয়ে মোফাজ্জেল হোসেন বলেন, “আজকে কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র না থাকলে কি অবস্থা হতো তা ভেবে দেখেন একবার। যারা সমালোচনা করে তারা এ বিষয়টি নিয়ে ভাবেন না। ”
 
বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো যতদিন উৎপাদনে না আসবে, ততদিন এগুলোর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বলেও মনে করেন তিনি।
 
কুইক রেন্টালের বিকল্প ছিল না বলে সরকার পক্ষ বরাবরেই যুক্তি দিয়ে আসছে। কিন্তু অন্যরা বলে আসছে এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই। বসিয়ে রেখে বিশাল অংকের ভাড়া পরিশোধ করা হচ্ছে। যা সামাল দিতে সরকার দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে।
 
অন্য এক পক্ষের যুক্তি হচ্ছে বর্তমানে প্রায় সাড়ে আট হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা অর্জণ করেছে সরকার(কুইক রেন্টাল সহ)। কুইক রেন্টাল বাদ দিলে উৎপাদন ক্ষমতা দাঁড়ায় প্রায় ছয় হাজার ৯শ মেগাওয়াট।
 
কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনোদিনই ছয় হাজার ৪শ মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করেনি পিডিবি। দিনের বেশির ভাগ সময়েই বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়েছে চার থেকে পাঁচ হাজার মেগাওয়াট। তাহলে কুইক রেন্টালের যৌক্তিকতা কি। তা তারা খুঁজে পাচ্ছেন না।
 
তেল-গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা কমিটির সদস্য সচিব আনু মুহাম্মদ বলেন, “কুইক রেন্টাল করাই হয়েছে কিছু ব্যক্তিকে ব্যবসার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য। বড় একটি অংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেই বসে বসে টাকা নিয়েছে। এ কারণে শুধু বিদ্যুৎ খাত নয় পুরো অর্থনীতি আজ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। ”
 
বিশাল অংকের ভর্তুকির পুরো টাকাই কুইক রেন্টাল মালিকদের পকেটে যাচ্ছে বলেও দাবি করেন আনু মুহাম্মদ।
 
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক বিডি রহমতউল্লাহ বাংলানিউজকে জানান, রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কারণে মৃত্যুকূপের মধ্যে পড়েছে বিদ্যুৎ খাত। সেখান থেকে বের হয়ে আসতে পারছে না।
 
কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র সমূহের যে পরিমাণ ভাড়া পরিশোধ করা হয়েছে একই পরিমাণ টাকা খরচ করা হলে স্থায়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসানো যেতো। আবার যদি এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মেয়াদ বাড়ানো হয়, তা হবে বিদ্যুৎ খাতের জন্য আত্মঘাতী।
 
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. শামছুল আলম বাংলানিউজকে জানান, বিদ্যুৎ সমস্যা দূর করার জন্য কুইক রেন্টাল আইপিপি করার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে ব্যক্তি বিশেষের ব্যবসা ও মুনাফা বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য। উদ্দেশ্যেই গলদ রয়েছে। সুতরাং পুরোটাই সমস্যা।
 
মন্ত্রণালয়ের একটি ‍সূত্র জানায়, সরকারের শেষ মেয়াদে এসে নিজেদের ব্যবসা নিয়ে চিন্তিত কুইক রেন্টাল মালিকরা। তারা তাদের এই বিশাল আয়ের পথ বন্ধ হতে দিতে চান না। তাই সরকারের মেয়াদেই নিজেদের বিদ্যুৎ কেন্দ্রসমূহ ১৫ বছর মেয়াদী আইপিপি করে নিতে উঠে পড়ে লেগেছেন। সরকারকে এই গ্রুপটির চাপ প্রয়োগ অব্যাহত রয়েছে বলে সূত্র জানায়।
 
চাপ প্রয়োগের শীর্ষে রয়েছেন কুইক রেন্টালের সুবিধাভোগী সামিট গ্রুপের মালিক আব্দুল আজিজ খান, দেশ এনার্জি’র মালিক এফবিসিসিআই’র সাবেক সভাপতি আনিসুল হক, ইউনাইটেড গ্রুপের চেয়ারম্যান হাসান মাহমুদ রাজা, অটবি’র সিস্টার কনসার্ন কোয়ান্টাম পাওয়ারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অনিমেশ কুন্ড।
 
এই গ্রুপটির সঙ্গে মন্ত্রণালয় ও পিডিবির কিছু অতি উৎসাহী কর্মকর্তা জড়িত রয়েছেন। যারা সব সময় সরকারকে ভূল ব্যাখ্যা দিয়ে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিতে প্রভাবিত করছে।
 
বিদ্যুৎ জ্বালানি ‍ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এনামুল হক বাংলানিউজকে জানান, কুইক রেন্টাল থেকে আইপিপি করার বিষয়ে এখনও চুড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। একটি কমিটি করা হয়েছে। তাদের রিপোর্টের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
 
কুইক রেন্টাল নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা রয়েছে। এগুলো আইপিপিতে রূপান্তর করা হলে বিদ্যুৎ খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে এমন সমালোচনার বিষয়ে প্রতিমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, দেশের ক্ষতি হয় এমন কিছু সরকার করেনি। আর করতেও চায় না। এর বেশি মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।
 
পিডিবির তথ্য অনুযায়ী, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে ৬০টি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য চুক্তি হয়। যার উৎপাদন ক্ষমতা আট হাজার মেগাওয়াটেরও বেশি। এর মধ্যে রেন্টাল তিনটি, কুইক রেন্টাল ১৭টি, আইপিপি ১৯টি এবং সরকারি মালিকানাধীন ২১টি।

বাংলাদেশ সময়: ০৪৩৬ ঘণ্টা, জুন ২৩, ২০১৩
ইএস/সম্পাদনা: জনি সাহা, নিউজরুম এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।