ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি

দেশ বিকিয়ে মুনাফা চায় সামিট গ্রুপ

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০১৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ১, ২০১৩
দেশ বিকিয়ে মুনাফা চায় সামিট গ্রুপ

ঢাকা: বিবিয়ানা-২ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে চুক্তি সই করা হয়েছে ২০১১ সালে। বিদ্যুৎকেন্দ্রটির উৎপাদনে আসার কথা চলতি বছরের আগস্ট মাসে।

কিন্তু আজও বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণকাজই শুরু করেনি সামিট পাওয়ার। এ কাজে প্রায় তিন বছর সময় লাগবে।

আইন অনুযায়ী সামিট পাওয়ারের চুক্তি বাতিল ও তাদের ৩০ লাখ (তিন  মিলিয়ন) ডলার জামানত বাজেয়াপ্ত হওয়ার কথা। কিন্তু একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর ভাইয়ের কোম্পানি হওয়ায় বিদ্যুৎ বিভাগ সামিটের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে সাহস পাচ্ছে না। তারা নজিরবিহীনভাবে দফায় দফায় সময় বাড়িয়ে যাচ্ছে।

সর্বশেষ সময় ছিল রোববার পর্যন্ত (৩১ মার্চ)। সেদিন আবারও জুন মাস পর্যন্ত সময় বাড়ানো হয়। অথচ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড অনেক আগেই কাজটি বাতিল করে দেওয়ার মত দিয়েছিল।

পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক প্রকৌশলী বিডি রহমতউল্লাহ বাংলানিউজকে জানান, “সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে সামিটকে সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। সরকার এটা কোনোভাবেই পারে না। ”

তিনি বলেন, “বিবিয়ানা-১ বিদ্যুৎকেন্দ্রটি একটি আইপিপি (ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্ল্যান্ট), এখানে সরকারের অর্থায়নের কোনো দায় থাকে না। অর্থায়ন, কোন কোম্পানি থেকে মালামাল আনবে এবং তাদের অভিজ্ঞতা নিশ্চিত করেই টেন্ডারে অংশ নেবে এটাই বিধান। ”

‘‘অর্থায়ন কোন ফান্ড থেকে হবে সে বিষয়টি দরপত্রে নিশ্চিত করতে হয়। তাহলে আজকে সামিটকে দফায় দফায় সময় দেওয়ার অর্থ কি দাঁড়ায়। মূলত সরকার কোনোদিনই তাদের এই জামানত বাতিল করতে চায় না’’ বলে দাবি করেন বিডি রহমতউল্লাহ।

তিনি বলেন, “সরকার এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চায়। এক হচ্ছে সামিটকে সময় দেওয়া। অন্যটি হচ্ছে বিদ্যুৎখাতকে কুইক রেন্টাল-নির্ভর করে এখান থেকে লুটপাট করা। ”

তিনি আরও জানান, কিছু ব্যবসায়ী রয়েছেন তাদের কাছে দেশের স্বার্থ বড় নয়। তারা দেশ বিকিয়ে দিয়ে হলেও মুনাফা লুটতে চায়।

বিদ্যুৎ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব তাপস কুমার রায় বাংলানিউজকে জানান, এবারেই শেষ আর সামিটের মেয়াদ বাড়ানো হবে না। দেশের স্বার্থেই শেষবারের মতো মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে।
তিনি দাবি করেন, এখন টেন্ডার বাতিল করলে নতুন করে কাউকে দিতেও তো অনেক সময়ের ব্যাপার। তাই সামিটকে সময় দেওয়া হয়েছে। তাহলে আগে কেন বাতিল করা হলো না এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, তারা শুরু থেকেই বলে আসছে অর্থায়ন যোগাড় করতে পারবে তাই সময় দেওয়া হয়েছে। এখানে দোষের কিছু নেই।

সামিট গ্রুপের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ভয় পাচ্ছে মন্ত্রণালয় এমন কথা জনশ্রুতি রয়েছে। এমন প্রশ্নের জবাবে তাপস কুমার বলেন, মন্ত্রণালয়ের কাউকে বিশেষ সুযোগ দেওয়া বা কাউকে চেপে ধরার সুযোগ নেই।
এদিকে, বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র ঝুলিয়ে রাখার কারণ হিসেবে জানা গেছে, আশ্চর্যজনক সব তথ্য।

বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো যাতে যথা সময়ে না আসতে পারে তার জন্য সামিট গ্রুপসহ একটি সংঘবদ্ধ চক্র কাজ করছে বিদ্যুৎ খাতে। তারা কুইক রেন্টাল ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে এ পন্থা অবলম্বন করেছে। বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদনে আসলে রেন্টাল, কুইক রেন্টাল বন্ধ হয়ে যাবে।

চক্রটি এরই মধ্যে সফলতা পেতে শুরু করেছে। বেশ কয়েকটি রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে বলে মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে।
বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদনে আসলে সামিটসহ অনেকের রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়া হবে। সে কারণে অতিমাত্রার মুনাফালোভি মানসিকতা থেকেই সামিট গ্রুপ এ অনৈতিক ব্যবসায় নেমেছে।

মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, সামিট গ্রুপ, ইউনাইটেড গ্রুপ, অটবি, সিনহা গ্রুপসহ বেশ কয়েকটি গ্রুপের বসে বসে টাকা আয়ের পথ বন্ধ হয়ে যাবে। সে কারণে তারা নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারে এ কাজে নেমেছে। দেশের স্বার্থ তাদের কাছে বড় বিষয় না। এই চক্রটি দেশ বিকিয়ে হলেও টাকার পাহাড় গড়তে চায়।

পিডিবি এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছে, সামিট, ইউনাইটেড গ্রুপসহ অনেকের রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র বিকল হয়ে পড়ে রয়েছে। এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মালিকের জরিমানা করার কথা। কিন্তু বিদ্যুৎ বিভাগের কিছু কর্মকর্তার যোগসাজশে এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র সচল দেখিয়ে ভাড়ার নামে হাজার হাজার কোটি টাকা পরিশোধ করা হচ্ছে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে। যার দায় গিয়ে পড়ছে সাধারণ গ্রাহকদের ঘাড়ে। এ কারণে দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েও পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছে না সরকার।

বড় বড় এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র যথাসময়ে উৎপাদনে আসলে সরকারের শেষ সময়ে একটি সহনীয় পরিস্থিতি বিরাজ করত। কিন্তু সামিট চক্রের সঙ্গে আপস করতে গিয়ে সরকারের টালমাটাল অবস্থা। ছুড়ে ফেলতে পারছে না, গিলতেও পারছে না।

সরকার শুরুতে ২০১৩ সালে লোডশেডিংমুক্ত বাংলাদেশের কথা বললেও শেষ দিকে এসে ভিন্ন সুরে কথা বলতে বাধ্য হয়েছে। বলা হচ্ছে, চাহিদা বেড়ে যাওয়ার কারণে সংকট চলছে।

বিদ্যুৎ বিভাগের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, সামিটের কারণে সরকারকে বড় ধরনের মাশুল গুনতে হবে আগামী নির্বাচনে। আসছে গ্রীষ্ম মৌসুমে কুইক রেন্টাল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে সংকট মোকাবেলা করতে গেলে ভর্তুকি ২০ হাজার কোটি টাকায় গিয়ে ঠেকবে।

সরকার এখন কম উৎপাদন করে সংকট সামাল দেওয়ার পথে হাঁটছে। যে কারণে পুরোপুরি গরম পড়ে গেলে পরিস্থিতি ভয়ানক হতে পারে।

ওই কর্মকর্তা জানান, বিবিয়ানা-২ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির উৎপাদন ক্ষমতা ৪৫০ মেগাওয়াট। গ্যাসভিত্তিক এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি থেকে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ ২ দশমিক ৬৬ টাকা দরে দেওয়ার কথা। কুইক রেন্টাল থেকে বিদ্যুৎ পেতে ভাড়াসহ প্রতি ইউনিট প্রায় ২০ টাকার মতো খরচ পড়ে।

বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদনে আসলে কুইক রেন্টাল বন্ধ করে দিতে পারত সরকার। এতে করে সরকার সারাদিন বিদ্যুৎ সরবরাহ করে মুনাফা করতে পারতো। আর এখন সেখানে প্রতি ইউনিটে ঘাটতি যাচ্ছে প্রায় ১৫ টাকার মতো।
 
এদিকে, সামিটের বিবিয়ানা-২-এর সঙ্গে একই দিনে আরও দুটি গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে চুক্তি করা হয় সামিটের সঙ্গে। এগুলো হচ্ছে বিবিয়ানা-১ ও মেঘনাঘাট ৩৫০ মেগাওয়াট কম্বাইন্ড সাইকেল পাওয়ার প্ল্যান্ট। প্রতি ইউনিটের দর ধরা হয় ৩ দশমিক ১২ টাকা।
 
বিবিয়ানা-১ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটিও উৎপাদনে আসার কথা চলতি বছরের আগস্ট মাসে। আর মেঘনাঘাট চলতি বছরের অক্টোবর মাসে উৎপাদনে আসার কথা। কিন্তু অনেক বিলম্বে এ দু’টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্মাণ কাজ শুরু করে।
 
মেঘনাঘাটের কাজ কিছুটা অগ্রগতি থাকলেও বিবিয়ানা-১-এর চলছে ভূমি উন্নয়নের কাজ। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি ২০১৫ সালের আগে আর উৎপাদনে আসতে পারবে না বলে জানিয়েছে বিদ্যুৎবিভাগ সূত্র।
 
মেঘনাঘাট এগিয়ে নেওয়ার পেছনেও সামিটের মুনাফালোভি মনোভাব কাজ করছে বলে জানা গেছে। সামিটের অপর দু’টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে উৎপাদিত বিদ্যুতের ইউনিট প্রতি দর ধরা হয়েছে (বিবিয়ানা-১) ২ দশমিক ৭১ টাকা, আর মেঘনাঘাটে ৩ দশমিক ১২ টাকা। সে কারণে বেশি মুনাফা লুটতে মেঘনাঘাট আগে নির্মাণ করছে সামিট পাওয়ার।
 
এদিকে, সামিট গ্রুপ জমি ভাড়া নিলেও যথাসময়ে কিস্তি পরিশোধ করছে না। চুক্তি অনুযায়ী জমির ভাড়া তৃতীয় কিস্তির টাকা পরিশোধের মেয়াদ শেষ হয়েছে কিন্তু কোনো অর্থ পরিশোধ করেনি সামিট গ্রুপ।
 
প্রসঙ্গত নতুন ও পুরনো মিলিয়ে সামিট গ্রুপ ৩১৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। এগুলো হচ্ছে সাভার-৪৫ মেগাওয়াট, চান্দিনা-২৫ মেগাওয়াট, মাধবদী-৩৫ মেগাওয়াট, রূপগঞ্জ-৩৩ মেগাওয়াট, মাওনা-৩৩ মেগাওয়াট, জাঙ্গালিয়া-৩৩ মেগাওয়াট, মদনগঞ্জ- ১০২ মেগাওয়াট এবং উল্লাপাড়া-১১।

এর বাইরে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে খুলনা পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (কেপিসিএল) উৎপাদন ১০০ মেগাওয়াট থেকে বাড়িয়ে এখন ২৬৫ মেগাওয়াট করা হয়েছে।
 
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান এমএ আজিজ খানের মোবাইলফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তার সাড়া পাওয়া যায়নি।

বাংলাদেশ সময়: ১০৯৭ ঘণ্টা, এপ্রিল ০১, ২০১৩
ইএস/আরআর;জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।