ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

কবিতা

সাহসী সত্তর/ পর্ব-৫

কামাল চৌধুরীর কবিতার বিভাস

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪১৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২০, ২০১৬
কামাল চৌধুরীর কবিতার বিভাস

কামাল চৌধুরীর কবিতার বিভাস
কাজী জহিরুল ইসলাম

‘শেষ বিকেলের ঝিনুক শাসিত বিচ্ছেদে মৌতাতে
যার হাত ধরে মাস্তুলে আমি নাবিকের চোখ রাখি
দিগন্তে শ্রুত ডানার শব্দে অনিকেত সন্ধ্যায়
প্রতিসরণের গোধুলিবেলায় বারবার তাকে ডাকি’

এভাবেই সত্তুরের গুরুত্বপূর্ণ কবি কামাল চৌধুরী আমাদের জানান দেন তার ‘সূর্য ডোবার স্মৃতিকথা’। এই নিবন্ধে শুদ্ধতার কবি কামাল চৌধুরীকে পুরোপুরি আবিষ্কার করা যাবে না কারণ আলোচনাটি সীমিত তার একটি মাত্র কাব্যগ্রন্থ ‘উড়ে যাওয়া বাতাসের ভাষা’য়।

‘কবি কাজী জহিরুল ইসলামকে আসীম সুভেচ্ছাসহ’লিখে স্বাক্ষর করে এই কাব্যগ্রন্থটি আমার হাতে তুলে দেন গত ২৩ আগস্ট ২০১৫র এক হিরণ্ময় সন্ধ্যায়, যখন তিনি দাপ্তরিক কাজে এসেছিলেন নিউ ইয়র্কে এবং আমরা তাকে একসন্ধ্যা-আড্ডায় পেয়েছিলাম। গ্রন্থটি আমি আদ্যপান্ত পাঠ করেছি।

‘মাছাইমারা’ছাড়া বাকী চৌত্রিশটি কবিতাই কলেবরে ক্ষুদ্র। ক্ষুদ্র শরীরে তারা কখনো ধারণ করেছে এক সুবৃহৎ অতীত-ক্যানভাস, কখনো বাঙময় হয়ে উঠেছে প্রকৃতি বর্ণনায়, কখনো প্রতিজ্ঞ সুদৃঢ় প্রতিশ্রুতি প্রকাশে। কবি কামাল চৌধুরীকে আমি শুদ্ধতার কবি বলি, কারণ তিনি বহুমাত্রিক স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়ে কখনোই পরিহার করেননি কবিতার পরিভাষা। ছন্দের ব্যাপারেও তিনি খুবই যত্নশীল। দক্ষ গ্রন্থাগারিক যেমন সুনিপুণভাবে গ্রন্থের তালিকা নির্মাণ করেন প্রতিটি গ্রন্থের প্রকৃতি অনুযায়ী এবং গ্রন্থগুলো শেলফে সাজিয়ে রাখেন সেই তালিকা অনুসারে, সেই দক্ষ গ্রন্থাগারিকের যত্নের ছাপ রয়েছে কামাল চৌধুরীর শব্দ চয়ন এবং শব্দ বিন্যাসে। স্যামুয়েল টেইলর কোলরিজের সংজ্ঞার মতোই তিনি ‘শ্রেষ্ঠতম শব্দের শ্রেষ্ঠতম বিন্যাস’ ঘটাতে চেয়েছেন প্রতিটি কবিতায়।

কখনো কখনো তাকে দেখি কবিসুলভ আবেগী না হয়ে, হয়ে ওঠেন এক কঠিন বাস্তববাদী মানুষ। তিনি বলেন,
‘ঘুমের ভেতর মেষপালকের পিছু পিছু
অনুসরণ করছি এই স্বপ্নকে
হাতের রেখায় যা স্পষ্ট নয় তাই নিয়ে
অংকুরিত হচ্ছে সম্ভাবনার রক্তবীজ
কোথাও ধুলো উড়িয়ে দেখছি
কোথাও প্লাবিত বদ্বীপে আমাদের
অস্থির খননকর্ম, মাটি সন্ধান…’ (স্বপ্ন)।

এই কবিতা নিঃসন্দেহে উত্তর প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে কররেখা নির্ভর আলস্য পরিহার করে ভাগ্যান্বেষণে বিশ্বজয়ের প্রত্যয় নিয়ে বেরিয়ে পড়তে। আমি এক রচনায় লিখেছিলাম ‘এরোপ্লেনের ডানায় ভর না দিলে স্বপ্নের ডানা বিস্তৃত হয় না। ’ কবি কামাল চৌধুরীর ‘স্বপ্ন’ কবিতায় তারই প্রতিফলন দেখে ভালো লেগেছে। এই গ্রন্থের প্রায় সবগুলো কবিতায়ই এক সুবৃহৎ ক্যানভাস দেখতে পাই। তিনি খুব ছোট একটি উপলব্ধি থেকে শুরু করেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা ব্যপ্ত হয়, কখনো কখনো ভূতল থেকে আকাশ অবধি।
‘আজ জরুরী হয়ে পড়েছে বৃষ্টির মুখোমুখি হওয়া
আজ নিজের ভেতর ভেজা শালিকের দ্রোহকাল।
অনন্ত স্নানঘরে আমাদের যৌথ আকাশ
বর্ষাতি হারিয়ে ফেলা বালক, তোয়ালেতে
মুখ মোছার আগে নড়ে উঠছে বানভাসি পাতার শব্দ
তাই নিয়ে আমাদের দূর অবগাহনের দিন-’(স্নানঘর)।

কবি খোলা আকাশের নিচে বৃষ্টিভেজা দিনকে এক অনন্ত স্নানঘর হিশেবে দেখছেন, যেখানে উচ্চারিত ‘যৌথ আকাশ’কথাটি নিবিড় সান্নিধ্য, পারস্পরিক সৌহার্দ্য কিংবা আরো বৃহৎ পরিসরে সমগ্র জাতি এমন কি বিশ্বাবাসীর জন্য একক সুখানুভূতির অংশীদার হবার আহ্বান। আরেক কবিতায় তিনি বলেন,
‘কোন ভণিতা ছাড়াই তোমাকে উৎসর্গ করেছি কোলাহল
উদাস দুপুরে পাতা ঝরার দৃশ্যে আমি রচনা করিনি
শান্ত সমাহিত বটবৃক্ষের ত্রোস্ত
যে মুখোশে বেঁচে থাকবার কথা সেখানে বৃষ্টি
এসে তুলকালাম ঘটে গেছে
অবগাহনের শেষে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে নিজের ভেতরের কম্পন
ভালোবাসার মত একটা দেশ আছে,
সেখানে কেউ একজন এখনো অপেক্ষা করে
এই কোলাহলই আমার প্রতিদিনকার আরাধ্য কবিতা’ (আরাধ্য)।

এ যেন এক দূর প্রবাসীর প্রাণের আকুতি। এই নিস্তরঙ্গ নিরবচ্ছিন্ন নির্লিপ্ত নিয়মতান্ত্রিক সুখের প্রবাস আমি চাই না, আমি চাই কোলাহল, আমি চাই আত্মীয়-বন্ধু পরিবেষ্টিত হৈ চৈ-এ মুখর এক জীবন। এই দূর পরবাসে সবাই ছুটছে, কেউ কারো জন্য অপেক্ষা করে না। তাই ‘অবগাহনের শেষে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে নিজের ভেতরের কম্পন’ আমারও ‘ভালবাসার মতো একটি দেশ আছে, সেখানে কেউ একজন এখনো অপেক্ষা করে। ’ এবং সবশেষে যখন তিনি বলেন, ‘এই কোলাহলই আমার আরাধ্য কবিতা’ তখনি আমরা পেয়ে যাই এক প্রচন্ড দেশপ্রেমিক কবি কামাল চৌধুরীকে।
‘যে লাটাই আমাকে উড়িয়ে দিচ্ছে আকাশে
আমাকে ঠেলে দিচ্ছে উন্মুক্ত এক যুদ্ধের দিকে
সেখানে হাজারো বালকের উল্লাসের মধ্যে
আমিও রঙিন মুখোশ/আমিও আকাশ দখলের হোলিখেলা
কর্তিত ঘুড়ির উ‍ৎসব
কোন কোন উৎসবের দিনে আমিও অনিশ্চিত এক খোলামাঠ
আমিও পদদলিত লতাগুল্ম
আমিও গোত্রহীন সাদা কাগজের পাখি
পতনের আগে আমিও দেখে নিতে চাই
সুতো ও সম্পর্কের চতুরতা’ (লাটাই)।

এই কবিতায় কবি তার অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছেন প্রাতিষ্ঠানিক শক্তির কাছে। কবিতাটির প্রথম ৬ পঙ্‌ক্তিকে আমরা একটি আধ্যাত্মিক প্রেক্ষাপটেও বিবেচনা করতে পারতাম কিন্তু শেষের ৫ পঙ্‌ক্তিতে তিনি বিষয়টি খোলাসা করেই দিয়েছেন যে এই লাটাইয়ের মালিক অন্য এক ঈশ্বর, যার হাতে ক্ষমতা এবং আমি যার হুকুমের দাসমাত্র। তবে তিনি যে তার অধিকার সম্পর্কে সচেতন আছেন তা তিনি যথেষ্ট দৃঢ়তার সাথেই ঘোষণা করেন, ‘আমিও দেখে নিতে চাই সুতো ও সম্পর্কের চতুরতা’
এই গ্রন্থে বেশ কিছু মাত্রাবৃত্তের কবিতা রয়েছে, এই কবিতাগুলোতে তিনি খুব মজার ছন্দে খেলেছেন বিষয়বস্তুকে নিয়ে। পাঁচ মাত্রার ছন্দে ‘করতাল’ কবিতাটি করতালের মতোই বেজে ওঠে,
‘যাদের সাথে আকাশ দেখার কথা
তারা সবাই বিস্মরণের বাড়ি
আমি তাদের পথ হারিয়ে খুঁজি
বলো জীবন কোথায় কড়া নাড়ি?
দাঁড়িয়ে থাকি ইতস্তত মেঘে
বাইরে ধূলি, ঘূর্ণি তাড়া করে
অরক্ষিত বাস্তু অভিজ্ঞতায়
সাপের আগে সূর্যমুখী মরে।
তবু আমার ফুল ফোটাবার আশা
তবু আমার পাখিউড়াল কাল
এক অজানা পথের আঁকে বাঁকে
বাজিয়ে যাবো তোমার করতাল। ’

বাস্তববাদী কবি প্রত্যাশা এবং ক্রমাগত প্রচেষ্টারই জয়গান গেয়েছেন এই কবিতায়।
আরো একটি ছয়মাত্রার মাত্রাবৃত্ত ছন্দের কবিতা ‘মধুমাস’ আমাদের আন্দোলিত করে একইভাবে।
‘অচেনা দিনেও যৌথ খামার গড়ি
আমরা দুজন লিখিনা বিয়োগফল
কুয়াশা শেষের পদ্মা-যমুনা বাঁকে
রাতজাগা স্রোতে এখনো অনেক জল।
জীবন এখানে আদিম-সমতামুখী
ভাগ করে নেবো খামারের উদ্ভাস
লোকায়ত মাটি, বদ্বীপের হাত ধরে
আজো নবান্ন আমাদের মধুমাস।
এসো মধুমাসে আরো কিছু পথ হাঁটি
এসো নদীতীরে লিখে রাখি ঊষাকাল
অচেনা দিনের ধূলিকে উড়িয়ে দিয়ে
চুম্বনে লিখি দু’হাজার ছয় সাল’।

এইভাবেই কবি ২০০৬ সালকে বিদায় জানিয়েছেন। এখানেও প্রচণ্ড ইতিবাচকতা এবং জিজীবিষা।
তিনি কর্ম উপলক্ষে পৃথিবীর নানান দেশ ভ্রমণ করেন, যেখানেই যান সেখানকার অভিজ্ঞতাকে শব্দের ক্যামেরায় বন্দি করার চেষ্টা করেন। সেরকম কয়েকটি কবিতা এই গ্রন্থে সন্নিবেশিত হয়েছে। প্যারিসের অভিজ্ঞতাকে তিনি তুলে এনেছেন, ‘ক্লঁদ মনের বাড়ি ও বাগান’ এবং ‘ক্লঁদ মনের সঙ্গে একদুপুর’ কবিতা দুটিতে। ‘নায়াগ্রাঃ মেইড অব দ্য মিস্ট’ কবিতায় তিনি দক্ষ আলোকচিত্রীর মতো ক্যামেরাবন্দী করেছেন বিশ্বখ্যাত নায়াগ্রা ফলসকে এবং ‘মাছাইমারা’ কবিতায় তিনি কেনিয়ার বিশ্বখ্যাত বন্যপ্রাণির অভয়াণ্যকে ধারণ করেছেন।

এই পঁয়ত্রিশটি কবিতায় কামাল চৌধুরীকে পুরোপুরি আবিষ্কার করা না গেলেও আমরা এই ধারণা পাই যে কামাল চৌধুরীর কবিতার বিভাস রচিত হয়েছে ইতিবাচকতা এবং জিজিবীষায়।

বাংলাদেশ সময়: ১৩৩০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২০, ২০১৬
এমজেএফ/

শিহাব সরকার: বনগহনের নিবিড় হাতছানি
সানাউল হক খান: একজন স্বতঃস্ফূর্ত শিল্পী
আবিদ আজাদ: বহুমাত্রিক কবি
মতিন বৈরাগী: বৈপরীত্যেও অনিবার্য বিপ্লব

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

কবিতা এর সর্বশেষ