ঢাকা, রবিবার, ১৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন ও বাংলাদেশের বাস্তবতা

খাদেমুল ইসলাম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮২২ ঘণ্টা, আগস্ট ২, ২০২২
সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন ও বাংলাদেশের বাস্তবতা

নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর চলমান সংলাপে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পদ্ধতিগত পরিবর্তন আনার প্রস্তাব দিয়েছে বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল। সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টিসহ বেশ কয়েকটি দল আসনভিত্তিক প্রতিনিধিত্বের পরিবর্তে দেশে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব নির্বাচন পদ্ধতি প্রবর্তনের দাবি জানিয়েছেন।

এই দাবির প্রতি প্রথমে ইতিবাচক মতামত দেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। পরে অবশ্য তিনি বলেন, নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

বিশ্বব্যাপী গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে প্রতিনিধি নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রধানত, দুটি ব্যবস্থা বিদ্যমান। প্রথমতঃ একটি নির্বাচনী এলাকায় প্রার্থীদের মধ্যে যিনি সর্বোচ্চ ভোট পাবেন তিনি নির্বাচিত হবেন। এই পদ্ধতিকে বলা হয়- First past the post system. নির্বাচনের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় যে ব্যবস্থাটি প্রচলিত তা হলো- সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা বা Proportional representation system. এই পদ্ধতিতে একটি দল যে পরিমান ভোট পাবে সেই অনুপাতের ভিত্তিতে তাদের প্রতিনিধিত্ব নির্ধারণ হবে। অনেক দেশে এই দুটি পদ্ধতির সমন্বিত ব্যবস্থাও চালু রয়েছে।

সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে প্রতিটি দল নির্দিষ্ট সংখ্যক আসনের জন্য একটি তালিকা প্রণয়ন করে নির্বাচন কমিশনে জমা দেবে। সেই তালিকা অনেক দেশে প্রকাশ করা হয়, অনেকে দেশে আবার গোপন রাখা হয়। ভোটাররা নির্দিষ্ট ব্যালটে প্রার্থীর পরিবর্তে দল বা দলীয় প্রতীকে ভোট দেবে। তখন সারা দেশের ভোট গণনা করা হবে। প্রত্যেক দল যে পরিমান ভোট সেই অনুপাতে তাদের প্রতিনিধিদের নির্বাচিত ঘোষণা করা হবে।

ধরা যাক বাংলাদেশে এই পদ্ধতি চালু করা হলো। তখন রাজনৈতিক দলগুলো জাতীয় সংসদের সাধারণ আসনের জন্য ৩০০ জন এবং সংরক্ষিত নারী আসনের জন্য ৫০ জনের একটি তালিকা প্রণয়ন করে নির্বাচন কমিশনে জমা দেবে। প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দল শতকরা হারে যে পরিমান ভোট পাবে সাধারণ আসনে তার তিনগুন এবং সংরক্ষিত নারী আসনে অর্ধেক সংখ্যক প্রার্থীকে বিজয়ী ঘোষণা করা হবে। তখন ভোটের সংখ্যানুপাতে তালিকার প্রথম দিকের প্রার্থীরা বিজয়ী হবেন এবং শেষ দিকের প্রার্থীরা বাদ পড়বেন।

বাংলাদেশের বাস্তবতায় এই পদ্ধতি কতটুকু প্রয়োগযোগ্য তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। উন্নত দেশে আইনসভার সদস্যরা শুধু আইন প্রণয়ন ও রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণী বিষয়গুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকেন। আর স্থানীয় উন্নয়নমূলক কাজ হয়ে থাকে স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে। অথচ বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের সদস্যরা নির্বাচিত হয়ে মূলত এলাকার উন্নয়নমূলক কাজকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। ওই সংসদ সদস্যের আইন প্রণয়ন পদ্ধতিতে দক্ষতা নয় বরং এলাকার উন্নয়নের মাপকাঠিতেই জনসাধারণ পরবর্তী নির্বাচনে ভোটে মূল্যায়ন করে থাকেন।

এমতাবস্থায় সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে দলের কেন্দ্রীয় তালিকার ভিত্তিতে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলে কোনো একটি নির্দিষ্ট থানায় বা বর্তমান সংসদীয় আসনে বিভিন্ন দল থেকে একাধিক সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে যেতে পারেন। আবার কোনো এলাকা এমনকি প্রত্যন্ত অঞ্চলের জেলাগুলো থেকে কোনো প্রতিনিধিই নির্বাচিত নাও হতে পারেন। তখন ওই এলাকাগুলোর উন্নয়ন কাজ বাধাগ্রস্ত হতে পারে।

তাছাড়া রাজনৈতিক দলগুলোর প্রভাবশালী নেতারা সাধারণত কেন্দ্রীয় পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করেন। সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব নির্বাচন করা হলে সেই তালিকায় সাধারণত কেন্দ্রের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা শুরুর দিকে জায়গা করে নেবেন। সেক্ষেত্রে জেলা ও আঞ্চলিক পর্যায়ের নেতারা পিছিয়ে পড়বেন। তখন প্রতিনিধিত্ব অঞ্চলভিত্তিক না হয়ে আরও বেশি রাজধানী কেন্দ্রিক হয়ে যাবে। এসব নির্বাচিত নেতাদের নির্দিষ্ট কোনো অঞ্চলের প্রতি আলাদা দায়বদ্ধতা তৈরি হবে না। এতে তুলনামূলক প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলো উন্নয়ন কাজে অনেক পিছিয়ে পড়বে। শুধু তাই না, জনগণের প্রতিনিধি হলেও এসব প্রতিনিধি একেবারেই জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বেন।

আপাত দৃষ্টিতে এই পদ্ধতিতে ছোট দলগুলো লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যায়। তবে দীর্ঘ মেয়াদে প্রত্যেকটি দলের অঞ্চলভিত্তিক কার্যক্রম দুর্বল হয়ে শুধু কেন্দ্রীয় তৎপরতা বেড়ে যাবে। বিশেষ করে নির্বাচনে কেন্দ্রীয় প্রার্থী তালিকার শেষ দিকে যাদের নাম থাকবে তারা নির্বাচনী কাজে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়বেন। কেউই মাঠপর্যায়ে জনসংযোগে আগ্রহ দেখাবেন না। দলের প্রার্থী তালিকায় শুরুর দিকে থাকতে অন্তঃকোন্দল বেড়ে যাবে। তাই বর্তমান কাঠামোতে রাজনৈতিক দল বা রাজধানীর বাইরের অঞ্চলের জন্য সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব নেতিবাচক ফলই বেশি আনবে।

বিশ্বের অনেক দেশে বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার ও দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভায় এই পদ্ধতি তুলনামূলক ইতিবাচক ফল বয়ে আনছে। যেহেতু বাংলাদেশ এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র এবং সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর অংশ যা ৭ (খ) অনুচ্ছেদ দ্বারা সংশোধন অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে। তাই এখানে যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সুযোগ নেই। এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা অনেক দেশেই আছে। শুধু আইন প্রণয়ন কাজে অংশ নেওয়ার ক্ষমতা দিয়ে জাতীয় সংসদের উচ্চকক্ষ করা যেতে পারে। তখন উচ্চকক্ষের জন্য সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব নির্বাচন করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে দুটি ব্যালট রাখতে হবে। একটিতে শুধু দলকে ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা থাকবে, যার মাধ্যমে সংখ্যানুপাতিক হারে উচ্চ কক্ষের সদস্যরা নির্বাচিত হবেন। অপর ব্যালটে সংশ্লিষ্ট সংসদীয় আসন থেকে প্রার্থীরা নির্বাচিত হবেন।

তবে বর্তমান বাস্তবতায় এমন একটি ব্যবস্থা চালু করা অত্যন্ত দুরহ ব্যাপার। যেখানে এক কক্ষবিশিষ্ট সংসদই পুরোপুরি কার্যকর হতে পারছে না। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের মাধ্যমে দলের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে হাত-পা বেঁধে দেওয়া হয়েছে। তাই বর্তমান সংসদকে কার্যকর না করে পার্লামেন্টের দ্বিতীয় কক্ষ করা হলে সেটি আরেকটি অকার্যকর ফোরামই হবে। তাই সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির দাবি বাংলাদেশের বাস্তবতায় অবাস্তব কল্পনা ছাড়া কিছুই নয়।

লেখক: আইনজীবী

বাংলাদেশ সময়: ১৭৪৫ ঘণ্টা, আগস্ট ০২, ২০২২
নিউজ ডেস্ক

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।