ঢাকা, রবিবার, ১৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

‘সাম্প্রতীক একটা ঘটনা বলি’

তানভীর শাহরিয়ার রিমন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০১০ ঘণ্টা, আগস্ট ১১, ২০২১
‘সাম্প্রতীক একটা ঘটনা বলি’ তানভীর শাহরিয়ার রিমন

সাম্প্রতীক একটা ঘটনা বলি, ঢাকার একজন মেয়রের মোবাইলে একটা ফোন আসে। অপরিচিত, কাঁপা কাঁপা কণ্ঠস্বর।

  মেয়র সাহেব হ্যালো বলে উঠতেই ওই পাশ থেকে সেই পৌঢ় ভীষণ নরম কিছুটা ভাঙা ভাঙা স্বরে বলতে থাকেন

-বাবা, আপনাকে ফোন দিয়েছি বড় অপারগ হয়ে, লজ্জাও পাচ্ছি। আমার সন্তানরা দেশের বাইরে থাকে, প্রায় ৩ মাস ধরে কাজ হারিয়ে বেকার হয়ে পড়ায় টাকা পাঠাতে পারছে না। ঘরে খাবার নেই। লজ্জায় আত্মীয়-স্বজন কাউকে বলতেও পারছি না। আপনি তো নগরীর অভিভাবক। যদি মনে হয় সাহায্য করতে পারবেন তাহলে করবেন, প্লিজ। না পারলে অন্তত আমার দুরবস্থার কথা কাউকে বলবেনা দয়া করে। ইজ্জতের বড় ভয় আছে বাবা।  

মেয়র সাহেব বললেন, আপনার ঠিকানা দিন, চাচা। তারপর কাগজ কলম নিয়ে ঠিকানা লিখতে গিয়ে তিনি চমকে উঠেন।  
এযে অভিজাত এলাকা! এখানেও কেউ না খেয়ে আছে!!

তিনি এক সপ্তাহ পরিমাণ খাবার এর একটা বস্তা নিয়ে নিজেই রওয়ানা দেন পৌঁছে দিতে।  

নির্দিষ্ট ঠিকানায় পৌঁছেও যান। তারপর লিফ্ট বেয়ে ওপরে উঠে কলিংবেল চাপতেই কেউ একজন এগিয়ে আসেন।  

মেয়র সাহেব চোখে চোখে তাকানোর ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন। শুধু বলেন, আপনার চেহারা দেখতে চাইনা, চাচা। এখানে এক সপ্তাহের খাবার আছে । এগুলো শেষ হলে আপনি আবার আমাকে ফোন করবেন, আমি খাবার পৌছে দেব।  

মেয়র সাহেব মনে তীব্র ঝাঁকুনি নিয়ে নিচে নেমে আসেন। তার চিন্তা জগতে তোলপাড় চলে। তিনি বলেন, আমি উনাকে এক সপ্তাহের খাবার দিয়ে এসেছি। বলে এসেছি, শেষ হলে ফোন দিতে। আমি নিশ্চিত, তিনি এই খাবার দিয়ে অন্তত দু’সপ্তাহ চলবেন। তার যে আত্মসম্মানবোধ সেটা তার সাথে কথা বলেই টের পেয়েছি। তিনি পারতপক্ষে আমাকে ফোন করবেন না।  

এই পুরা ঘটনায় মেয়র মহোদয়ের নাম আমি সঙ্গত কারণে উল্লেখ করিনি। তিনি অসম্ভব মহানুভবতার পরিচয় দিয়েছেন। তার জন্য শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা।  

এই ঘটনাটা আমি একারনেই শেয়ার করলাম, কারন কভিড পরিস্থিতিতে নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণী নানা কারণে সবচেয়ে বেশি অর্থনৈতিক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন। তারা আত্মসম্মানের কথা ভেবে এক বেলা খেয়ে কিংবা না খেয়ে দিন কাটিয়েছেন, কিন্তু কাউকে মুখফুটে নিজেদের কষ্টের কথা বলতে পারেননি। অনেক মধ্যবিত্ত পরিবার কোভিড-১৯ চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে সমস্ত জমাজাটি ভেঙেছেন, হয়েছেন ঋণে জর্জরিত। যে পরিবারে কেউ কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়েছেন, যদি তাকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়ে থাকে তাহলে যে কী অর্থনৈতিক চাপ সেই সম্পর্কে অনেকেই অবগত আছেন।  

এর মাঝেও এক শ্রেণীর মানুষ আছেন যারা এই উপলক্ষে জরুরি ওষুধ, অক্সিজেন সিলিন্ডার এসবের দাম বাড়িয়েছেন অযৌক্তিকভাবে। মনে হচ্ছে, এটাই বুঝি মোক্ষম সময় তাদের টাকা কামানোর। এই কষ্ট গুলো জমা থাক।  

আমি বরং অন্য কথা বলি । মেয়র সাহেবের ঘটনায় ফিরি । ওই যে ভ্দ্রলোক, যার প্রবাসী সন্তানরা কাজ হারিয়েছেন, এমন সন্তানের সংখ্যা অসংখ্য। এই প্রবাসীরাই প্রতিবছর মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দেশে বড় অংকের রেমিট্যান্স পাঠান। এই করোনাকালেও ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে তারা ২৪.৭৭ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন। যা একটি রেকর্ড। কিন্তু যেভাবে বিদেশ থেকে সংবাদ পাচ্ছি তাতে করে এই রেমিটেন্স প্রবাহে একটা ধাক্কা আসতে পারে। আমাদের অর্থনীতির জন্য যা মোটেও সুখকর কিছু হবে না। তাই অর্থনীতি চাকা সচল রাখতে কৃষি, শিল্প, সেবা, এসএমই খাতকে যেভাবেই হোক সচল রাখতে হবে। রপান্তীমুখী শিল্পের পাশাপাশি দেশীয় ক্ষুদ্র এবং মাঝারি উদ্যেক্তাদের কথা মাথায় রাখতে হবে।  

আগামীকাল থেকে দেশে সরকারি-বেসরকারি অফিস আদালত খুলে দেওয়া হচ্ছে। জীবিকার জন্য এটা ভালো সংবাদ । দেশে লকডাউন আর দেখতে চাই না । লকডাউনের পরিবর্তে গণটিকার সফল বাস্তবায়ন চাই। চাই আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে অন্তত ৫০ শতাংশ মানুষকে যেন সরকার টিকার আওতায় নিয়ে আসে।  
করোনায় সুরক্ষা বলয় যেমন দরকার, তেমনি দরকার অর্থনীতিরও একটা সুরক্ষা। এক্ষেত্রে বেসরকারি বিনিয়োগ একটা বড় ফ্যাক্টর। ফ্যাক্টর বিদেশি বিনিয়োগও। সেই সাথে কর্মসংস্থান।  

আমি মন থেকে দোয়া করি, প্রবাসী ভাই/বোনেরা তাদের কাজ ফিরে পাক। তারা সু্স্থ থাকুক। প্রায় এক কোটি রেমিট্যান্স যোদ্ধার জন্য মন থেকে ভালোবাসা।  
শ্রদ্ধা এবং দোয়া সেই চাচার জন্য। মহান আল্লাহ যেন তার সম্মান বৃদ্ধি করেন, চাচার সন্তানদের আয়ের একটা ব্যবস্থা যেন হয়।

পুনশ্চ: কেবল নিজে ভালোথাকার মাঝে সাফল্য নেই। আশেপাশের মানুষজনকে নিয়ে ভালোথাকার মাঝেই জীবনের প্রকৃত সাফল্য। মেয়র সাহেব সঠিক কাজটি করেছেন। আপনার আমার দায়িত্বও কম নয়। আসুন, চোখ কান খোলা রাখি। নেকস্ট ডোর নাইভার, প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজনের খোঁজ নিই। তাদের পাশে থাকি।

লেখক: সমাজকর্মী, লেখক, বক্তা; প্রধান নির্বাহী, র‍্যাংকস এফসি প্রোপার্টিজ লিমিটেড 
(ফেসবুক পেজ থেকে নেওয়া)

 

বাংলাদেশ সময়: ০০১০ ঘণ্টা, আগস্ট ১১, ২০২১
এসআরএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।