ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

সৈয়দ মকসুদ, রোকেয়া প্রাচী ও মুন্নী সাহা: বিশ্বাসভঙ্গের মহাপ্রলয়

সাইফুদ্দিন আহমেদ নান্নু, অতিথি কলামিস্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১০৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৪, ২০১১
সৈয়দ মকসুদ, রোকেয়া প্রাচী ও মুন্নী সাহা: বিশ্বাসভঙ্গের মহাপ্রলয়

আমার ছোট শহরটি চলছে, একটি যন্ত্র যেমন চলে ঠিক তেমনি। বাংলাদেশের অন্য দশটি শহরের মতই প্রাণহীন, বোধহীন।

যেন একঘেঁয়েমির অনন্ত স্রোতে ভেসে সময়কে টপকে যাওয়ার খেলা।

এমন শহরটাই হঠাৎ একদিন নড়ে চড়ে বসলো, তার প্রাণে প্রাণ জাগলো। শহর জুড়ে রাশভারি কণ্ঠে আবৃত্তির মত শব্দাবলীতে মাইকিং চলছে,জেগে উঠছে পুরো শহর, যেন ঊনসত্তর। চারজন শ্রদ্ধেয় মানুষ, অটোবাইকে বসে পালাক্রমে বলছেন। এদের একজন ৫০ পেরুনো ঝানু রাজনীতিক-আইনজীবী, অন্যজন লেখক-সাংবাদিক ও কলেজ শিক্ষক, তাঁরও বয়স ক`দিন বাদেই ৫০ পূর্ণ হবে। এ দুজনের সাথে আছেন একজন ডাকসাইটে আবৃত্তিকার, জেলা শিল্পকলা একাডেমীর একসময়ের সাধারণ সম্পাদক এবং চতুর্থজন প্রথিতযশা নাট্যব্যক্তিত্ব। এমন মাইকিং নিয়ে শহরজুড়ে মহাকৌতূহল, তোলপাড়। কারো ছোখ ছানাবড়া, কারো কাছে অবিশ্বাস্য ‘এরা মাইকিংএ, কেন!’। ‘গত দুই যুগ ধরে এই শহরের ভাড়াটে লোকরা যে কাজ করে বেড়াচ্ছে সে কাজ করা তো এদের সাজে না’!

‘স্রেফ স্ট্যান্টবাজি’ বলতেও ছাড়ল না কেউ কেউ। কারও মন্তব্য ‘ভীমরতি’। শুনেছি এদের বাড়িতেও নাকি তাদের বউ-বাচ্চারা মিনি আদালত বসিয়ে কৈফিয়ত তলব করেছিল। তবুও কোনও বাধা মানলেন না এরা। মাইকিং চললো শহর আলোড়িত করে, এক সময় শেষও হল।

১৮ অক্টোবর, মঙ্গলবার, বিকেল ৪ টা। মানিকগঞ্জের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বরে নাগরিক স্মরণসভা। বিজয় মেলার মাঠের বিশাল চত্বরের ঠিক দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে শহীদ মিনারের বেদী ঘিরে একজন দুজন করে মানুষের জমায়েত বাড়ছে। নির্ধারিত অতিথি প্রবীণ সাংবাদিক, গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ, এটিএন নিউজের কর্ণধার, মিশুক মুনীরের শিক্ষায়, ছায়া-মমতায় গড়ে ওঠা সাংবাদিক মুন্নী সাহা, তারেক মাসুদের ‘মাটির ময়না’র কল্যাণে দ্যুতি ছড়ানো,খ্যাতিধন্যা অভিনেত্রী রোকেয়া প্রাচী। এদের কেউ তখনও এসে পৌঁছাননি। তবে কথা রেখে ঘড়ির কাঁটা মিলিয়ে কেবল এসেছিলেন বরেণ্য চিত্রপরিচালক মোর্শেদুল ইসলাম।   তবুও শহীদ মিনার চত্বরে দর্শকদের জন্য পেতে রাখা একটি চেয়ারও তখন শূন্য ছিল না। বিকেল ৫ টায় বাঁশে ঘেরা স্মরণসভার বেষ্টনী উপচে মাঠজুড়ে মানুষ আর মানুষ। এত জমায়েত তবুও মাইক নিস্তব্ধ ! বিপন্ন বিস্ময়ে আয়োজকরা কেন জানি মিয়ম্রাণ, যেন বজ্রাহত বৃক্ষ। যারা বয়স আর অবস্থানের বাধা ডিঙিয়ে মাইকিং করে, হাতে হাতে লিফলেট বিলিয়ে পুরো শহরটাকেই প্রায় মাঠে টেনে এনেছেন, তারাও নিশ্চুপ এদিক সেদিক। বিকেল সোয়া ৫ টা, ‘আগুনের পরশমনি ছোঁয়াও প্রাণে, এজীবন পূর্ণ কর....’ কবিগুরুর অমর এ সঙ্গীতের কোরাস দিয়ে শুরু হল প্রয়াত মিশুক মুনীর আর তারেক মাসুদ স্মরণে জেলা সাংস্কৃতিক ঐক্য পরিষদ আয়োজিত নাগরিক স্মরণসভা। অতিথিদের মধ্যে মঞ্চে তখন ভীষণ বিব্রত এবং নিঃসঙ্গ মনে হচ্ছিল মোর্শেদুল ইসলামকে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা, সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নামলো তবুও এলেন না অন্য অতিথিরা । যারা আসেননি তারা  কথা দিয়েছিলেন ‘আসবোই’ বলে। আয়োজকরা লিফলেট, মাইকিংয়ে তাদের নাম হাজারবার উচ্চারণ করেছিলেন, তবু এরা কেউ এলেন না। কেন এলেন না, কেবল তারাই জানেন  আর জানেন ঈশ্বর। মানিকগঞ্জের মানুষ আজও জানেন না।  

দর্শক শ্রোতারা জানলেন, দেখলেন, সৈয়দ আবুল মকসুদ নেই, মুন্নী সাহা নেই, রোকেয়া প্রাচী এরা কেউ মঞ্চে নেই। হয়তো ভাবলেন এরা আসবেন এমন কোনও কথাই হয়তো দেননি। মাইকিং করা মধ্যবয়েসী ঐ চারজনই হয়তো লোক জমাতে এদের নামে বেসাতি করেছেন।   সৈয়দ আবুল মকসুদ বয়সের ভারে ক্লান্ত মানুষ, তার কথা না হয় আলাদা। তা ছাড়া মিশুক মুনীর আর তারেক মাসুদের কাছে সৈয়দ আবুল মকসুদের ব্যক্তিগত কোনও দায় আছে বলে তিনি অন্তত কোথাও বলেননি।   তাই বলে মিশুক মুনীরের মৃত্যুতে কান্নায় ভেঙে পড়া মুন্নী সাহা, শোকাহত রোকেয়া প্রাচী’রা আসবেন না, এ তো হতে পারে না!

মুন্নী সাহার  সাংবাদিক হয়ে ওঠা, রোকেয়া প্রাচীর শিল্পী সত্তার বিকাশ তো মিশুক মুনীর আর তারেক মাসুদের হাতেই। এরা নিজেরাই তো টিভিতে, পত্রিকায় অশ্রুসজল কণ্ঠে দেশবাসীকে জানিয়েছেন একথা। এরা দুজন অনেক বড় মানুষ, কথা দিলে নিশ্চয় কথা রাখতেন, অবশ্যই আসতেন মিশুক মুনীর আর তারেক মাসুদের নাগরিক স্মরণসভায়। হাজার হোক এ মানিকগঞ্জের মাটিতেই তো এঁদের জীবনবাতি নিভেছে। স্মরণসভায় শ্রদ্ধা জানাতে আসা সাধারণ মানুষ, পান দোকানি , কলেজের অধ্যাপকের এমন সরল হিসাব কষাটাইতো স্বাভাবিক। হয়তো কষেছেনও তাই। তবুও স্মরণসভায় তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। বাঁধভাঙা জোয়ারের মত আসা নারী-শিশু-ছাত্র-ছাত্রী-ব্যবসায়ী-আমলা পিনপতন স্তব্ধতায় শুনলেন মোর্শেদুল ইসলামকে, শুনলেন ‘কাগজের ফুল’র ক`জন সহকর্মীর স্মরণ, শুনলেন তারেক মাসুদ মিশুক মুনীরকে উৎসর্গ করে লেখা কবিতা, শুনলেন নীল বেদনার শব্দে গাঁথা শোকপ্রস্তাব, শুনলেন ‘অশোকের পদাবলীর’ পাঠ।

ক্যাথেরিন মাসুদ, তারেক মাসুদের সদ্য বিধবা স্ত্রী। তিনি আসবেন না বিনয়ের সাথে আগেই জানিয়েছিলেন, সবাই জানতেনও সে কথা। তবুও এই নারী মোবাইলফোনে মিনিট পনের সময় নিয়ে বললেন মানিকগঞ্জকে ঘিরে তাঁর অসংখ্য স্মৃতি-কথা, কৃতজ্ঞতা জানালেন মানিকগঞ্জবাসীর প্রতি। মাইক্রোফোনের সামনে রাখা মোবাইল ফোনে ক্যাথরিন যখন বলছিলেন, “মানিকগঞ্জের কালীগঙ্গার পাড়ে আমাদের বাড়ি করবার স্বপ্ন ছিল, কিন্তু হল না” পুরোমাঠ তখন  নিরবে অশ্রুসিক্ত হয়েছে। নিথর থেকেছে কয়েকশ গজ দূরের কালীগঙ্গার জলে ভেজা দখিনা হাওয়া ।            

এখন ৯০টি দিন পার হয়নি মিশুক মুনীর এবং তারেক মাসুদ ইহলোক ত্যাগ করেছেন। দিনটি ছিল ১৩ আগস্ট, শনিবার।   সবকিছু স্পষ্ট মনে আছে। প্রবল বৃষ্টি মাথায় করে হাজার জনের সাথে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের জোকায় ছুটে গেছি, সদর হাসপাতালে ভীড় জমিয়েছি। টেলিভিশনের পর্দা  থেকে চোখ সরাইনি দিনের পর দিন। স্যাটেলাইট টিভির পর্দা জুড়ে কত কান্না, কত শোক, কত কথা, কত বয়ান-বিশ্লেষণ । শোক আর ক্ষোভের তপ্ত উর্মিমালা টেলিভিশনের পর্দা, পত্রিকার পাতা থেকে আছড়ে পড়ছিল ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলে। তারেক মাসুদ আর মিশুক মুনিরের স্মৃতিকথা গাইতে গাইতে কিংবদন্তী হয়ে উঠছিলেন কেউ কেউ। সাধারণ মানুষ আমরা,সরল,ভাবিও সরল-সোজা। অভিশপ্ত জোকার মাটি মানিকগঞ্জের বলে মনের ভিতরে অপরাধবোধের ছোট্ট একটু যন্ত্রনাও ছিল। আশা ছিল মিশুক মুনীর, তারেক মাসুদের কাছের কিছু মানুষের সান্নিধ্য, কিছু কথা শুনলে জোকা ট্রাজেডির ভার কিছুটা হলেও লাঘব হবে । কিন্তু কাছের মানুষ বলে সারাদেশের মানুষ এ ক`দিনে যাদের জেনেছিলেন তারা সে সুযোগটি দিলেন না। কিন্তু  বিধাতা মানিকগঞ্জবাসীর আশা অপূর্ণও রাখেন নি। ক্যাথেরিনের স্মৃতিচারণ, কৃতজ্ঞতা, তারেক মাসুদের ‘রানওয়ে’ আর ‘নরসুন্দর’ চলচ্চিত্রের মুক্ত  প্রদর্শনী  বিজয়মেলার মাঠ আর শহীদ মিনারের বেদীমূলের সব অপূর্ণতাকে এক ফুৎকারে নিভিয়ে দিয়েছিল ১৮ অক্টোবরের রাতে।    

তারপরও কথা থাকে, বুকপকেটে থেকেই যায় বেদনার নীল খাম। কথায় বলে ‘প্রবঞ্চনার বিপরীতে জাগায় গভীর হতাশা আর যন্ত্রণার কৃষ্ণ গহ্বর’। বাংলাদেশের ছোট্ট একটি জেলা শহরের কিছু প্রগতিবাদী মানুষের মন তেমনি এক কৃষ্ণ গহ্বরে আকণ্ঠ ডুবে আছে । হয়তো থাকবে আরও কিছুকাল অথবা অবশিষ্ট জীবনে এরা আর কখনোই তাড়িত হবেন না কোনও মানবিক বোধসম্ভুত সামাজিক প্রয়োজনে। ঘটনাটি কারও কাছে পুতুলখেলা, কারও কাছে তা বিশ্বাসভঙ্গের মহাপ্রলয়। শহীদ মুনীর চৌধুরীর সন্তান, এদেশে আধুনিক টিভি মিডিয়ার পথিকৃৎ, শিক্ষক, সাংবাদিক মিশুক মুনীর, মুক্তির গান, মাটির ময়না আর রানওয়ের তারেক মাসুদের নাগরিক স্মরণসভার মাইকিং হবে ভাড়াটে কামলার অশুদ্ধ উচ্চারণে, ফিল্মি কায়দায়! ‘অসম্ভব’ বলে ঐ যে মানুষগুলো যাঁরা ‘বড্ড অসময়ে’ মাইক হাতে শহরে নেমেছিলেন তারা, তাদের সাথে আরও যাঁরা নিজেদের ঘাম ঝরানো অর্থে-শ্রমে দিন রাত কাঠ ফাটা রোদে খেটেছেন, চেয়ার টেনেছেন, হেঁটে হেঁটে বিলিয়েছেন লিফলেট, তারা সবাই এখন এ শহরে মলিন মুখে হাঁটেন, লজ্জায় কুঁকড়ে থাকেন বন্ধুমহলে।   আর চলতে ফিরতে এই ভেবে আতঙ্কিত হন- কখন কোন দুরন্ত কিশোর পথ আগলে চিৎকার করে বলে ‘কাকু কারা কারা আসবেন বলে শহর মাতালেন, কই কেউ তো এলো না, আপনারাও তা হলে মিথ্যে বলেন !`

বিশ্বাস যেখানে ভাঙ্গে সেই জনপদের কিশোর করতেই পারে এমন প্রশ্ন। এটি তার অধিকার ।

[email protected]
বাংলাদেশ সময় ১০৫৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৪, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।