ঢাকা, রবিবার, ১৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

কক্সবাজারের মাদক সাম্রাজ্য ধ্বংসের এখনই সুবর্ণ সুযোগ

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯১৬ ঘণ্টা, মে ৭, ২০১৭
কক্সবাজারের মাদক সাম্রাজ্য ধ্বংসের এখনই সুবর্ণ সুযোগ ফাইল ফটো

কক্সবাজার, উখিয়া ও টেকনাফ ঘুরে: অফিসিয়ালি পর্যটন নগরী নামে পরিচিত জনপদকে কার্যক্ষেত্রে মাদক সাম্রাজ্যে রূপান্তরিত করেছে একটি মাফিয়া চক্র। এক গুচ্ছ উন্নয়ন প্রকল্প দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন মাদকের বিরুদ্ধে আপোসহীন যুদ্ধ ঘোষণা করলেন (শনিবার), তখন সৈকতময় লাখো মানুষের জনসভায় বয়ে যায় স্বস্তির ঢেউ। কক্সবাজারের লোক-মানসে আস্থার প্রলেপ প্রধানমন্ত্রীর সফরের মূল অর্জন।

লাবনী পয়েন্টে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা শোনার সময় লক্ষ্য করি আশেপাশের জনতার আবেগ ও অনুভূতি। ‘উন্নয়ন থমকে যাবে যদি মাদক সাম্রাজ্য ধ্বংস করা না হয়’, বললেন স্থানীয় কলেজের অধ্যাপক আবুল মনসুর।

নেত্রীত্বের মোহনীয় প্রাজ্ঞতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবলীলায় পাঠ করলেন মানুষের প্রত্যাশা। মাদক, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক অবস্থানের স্পষ্ট ও দৃঢ় অঙ্গীকার জানিয়ে আশ্বস্ত করলেন সবাইকে। কাট-ফাটা রৌদ্রে সমুদ্র তীরের আর্দ্রতায় ঘর্মাক্ত জনতা শান্তি ও স্বস্তির বার্তা নিয়ে হাসি মুখে সভা শেষে বাড়ির পথ ধরলেন। নতুন আশাবাদের আলোয় যেন রাঙা হলো সাগর-কন্যা কক্সবাজারের আকাশ।

সন্ধ্যার আগে আগে নব নির্মিত ও সদ্য-উদ্বোধন হওয়া মেরিন ড্রাইভে গিয়ে দেখা গেল মানুষের ঢল। নিজস্ব বাহনে অল্প সময়েই পৌঁছে গেলাম ৮০ কিলোমিটার দূরের টেকনাফে। দু’পাশে গড়ে ওঠছে বিভিন্ন নির্মাণ। নানা প্রতিষ্ঠান আয়োজন করছে নিজেকে গড়ে তোলার।

‘কক্সবাজারের পর্যটন কার্যক্রম ও ব্যবসা অতি তাড়াতাড়ি এদিকে সম্প্রসারিত হবে’, জানালেন সহযাত্রী হোসেন। স্থানীয় পত্রিকায় সাংবাদিকতার সুবাদে হাল-হকিকত সবই তার জানা। গুগল ম্যাপ

টেকনাফ থেকে কক্সবাজারে ফিরে এলাম অন্য পথে, পুরনো আরাকান সড়ক বা সিএন্ডবি রোড ধরে। টেকনাফ, হ্ণীলা, উখিয়ায় সুন্দর সুন্দর কটেজ আকারের বাড়ি। মাদারবুনিয়া বাজারে কিছুক্ষণের জন্য বিরতি নিয়ে চা খেতে খেতে জানতে চাইলাম, ‘এসব চমৎকার বাড়ি কাদের? প্রবাসীদের রেমিটেন্সের টাকার প্রতীক কি এগুলো?’ আমার প্রশ্নে মাঝ-বয়েসী দোকানি চমকে ওঠেন। টুলে বসা চার-পাঁচ জন স্থানীয় লোক একে অপরের মুখ ও অভিব্যক্তি দেখেন। কথা নেই কারো কণ্ঠে। আমি বিস্মিত।

নির্বাক মানুষের কাছ থেকে ফিরে আসি গাড়িতে। একজন সহযাত্রী জানালেন, ‘এসব বাড়ি ও জৌলুস স্থানীয় মাদক ব্যবসায়ীদের। কেউ ভয়ে এদের কথা জানাবেন না। ’ আমার অবাক চোখের দিকে তাকিয়ে আরেক সহযাত্রী বলেন, ‘টেকনাফ ও কক্সবাজারের ব্যাঙ্কগুলোতে এমন বহু মানুষের কোটি টাকার একাউন্ট আছে, যাদের কোনো চাল-চুলা ছিল না। মাদকের ব্যবসায় রাতারাতি ফুলে-ফেঁপে ওঠেছে। ’

প্রায়ই পত্রিকায় প্রকাশ পায়, কোটি টাকার ইয়াবা আটকের খবর। ‘যেগুলো আটক হয় না, তার পরিমাণ কত?’ আমি জানতে চাই। উত্তরও পাওয়া গেল সঙ্গে সঙ্গে। ‘প্রতিদিন শত শত কোটি টাকার ইয়াবা ও অন্যান্য মাদকের চোরাচালান আর কেনা-বেচা হয়। ’

ভৌগোলিক কারণে কক্সবাজারের পাহাড়, জঙ্গল, নদী, সমুদ্র দিয়ে স্রোতের মতো মাদক আসছে মায়ানমার থেকে। জেলে নৌকায়, মালবাহী সাম্পানে, স্থানীয় ধরনের গাড়িতে, মানুষের শরীরের নানা স্থানে হাজার হাজার পিস ইয়াবা বহন করাচ্ছে মাফিয়ারা। একটি বিশাল নেটওয়ার্কে হাজার হাজার মানুষকে নিয়োজিত করা হয়েছে এ কাজে। স্থানীয়-অস্থানীয় মিলে প্রচুর মানুষ পর্যটন নগরে আসা-যাওয়া করে। মাদক চক্র সহজে মিশে থাকে এদের সঙ্গে। ফাইল ফটো

টেকনাফ থেকে কক্সবাজার, কুতুবদিয়া-মহেশখালী দ্বীপ, শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে মাদক দ্রব্যের চালানের হাত-বদল আর কেনা বেচা চলে। একজন রাজনৈতিক নেতার কথা জানা যায়, যিনি লোকমুখে মাদক সম্রাট নামে কুখ্যাত। রাজনীতি ও প্রশাসনের আরো অনেকেই পেছন থেকে মদত দিচ্ছে, কলকাঠি নাড়ছে এ জঘন্য ব্যবসার। হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। স্থানীয় ও দেশের বাজার সয়লাব করে দিচ্ছে মরণ নেশায়।

রামু উপজেলার একটি সম্পন্ন পরিবারের একমাত্র সন্তান কলেজে পড়ার সময় মাদকে আসক্ত হয়। দুই-তিন বছরে তার জীবন অন্ধকারে হয়ে গেছে। মাদকের জন্য সহায়-সম্পদ সব বেচে এখন ভিক্ষা করে। এমন উদাহরণ একটি নয়। শত শত। উদাহরণ শুধু স্থানীয় পর্যায়েই সীমাবদ্ধ নয়। দেশের নানা স্থানে পাওয়া যাচ্ছে মাদকের নীল গ্রাসে ধ্বংস হয়ে-যাওয়া হাজার হাজার তরুণের করুণ কাহিনী।

বাংলাদেশের সীমান্তগুলোর মধ্যে দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল এখন চরম ভয়ঙ্কর রূপ লাভ করেছে। মাদক আর অস্ত্র স্থানীয় সমাজ ও অর্থনীতিকে গ্রাস করেছে। প্রধানমন্ত্রী উন্নয়ন প্যাকেজ এবং স্বপ্নের কক্সবাজার গড়ার সকল কর্মযজ্ঞ, পরিকল্পনা ও প্রকল্প ভেস্তে যাবে, যদি মানুষকে মাদক সাম্রাজ্যের রাহুগ্রাস থেকে বাঁচিয়ে উন্নয়নমুখী করা না যায়। এমন মত দিয়েছে স্থানীয় সুধী ও শিক্ষিত সমাজের প্রায়-সকলেই। সকলেই এক বাক্যে মাদককে কক্সবাজারের বিকাশ, উন্নয়ন, শান্তি ও অগ্রগতির প্রধান অন্তরায় হিসাবে চিহ্নিত করেছেন।

প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে মানুষ আশাবাদী হয়েছেন। পুরো বক্তব্যের একটি বড় অংশই প্রধানমন্ত্রী মাদকচক্রের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত হুসিয়ারি দিয়ে আশাবাদের আলো জ্বালিয়েছেন। কক্সবাজারের মাদক সাম্রাজ্য ধ্বংসের এখনই সুবর্ণ সুযোগ। উন্নয়ন ও ইতিবাচকতার স্রোতে অপতৎপরতা ভাসিয়ে দেওয়াই এখনই মাহেন্দ্রক্ষণ।

ড. মাহফুজ পারভেজড. মাহফুজ পারভেজ: কবি ও লেখক। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগে অধ্যাপনারত,        [email protected]

 


বাংলাদেশ সময়: ১৫১০ ঘণ্টা, মে ৭, ২০১৭
জেডএম/     

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।