ঢাকা, বুধবার, ১৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

যে যুদ্ধে জেতেনি কেউ!

ফজলুল বারী, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪২০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১১, ২০১১
যে যুদ্ধে জেতেনি কেউ!

২০০১ সালের ৯/১১’র দিনে নির্বাচনী রিপোর্টিং`এ খালেদা জিয়ার গাড়ির বহরের সঙ্গে। আমরা তখন কুষ্টিয়া শহরে তাঁর নির্বাচনী জনসভা কভার করতে যাচ্ছিলাম।

পথে গাড়িতে বসা অবস্থায় সেলফোনে ৯/১১`র ঘটনার খবরটি দেন যশোরের সাংবাদিক বন্ধু সাজেদ রহমান বকুল। কিন্তু তখনও পুরো ঘটনার ডিটেইলস জানি না।

হাতের প্রযুক্তি আজকের মতো সমৃদ্ধ না থাকায় তাৎক্ষণিক  ইনফরমেশনও গেদার করতে  পারিনি। খালেদা জিয়ার সফরসঙ্গী মিডিয়া টিম সমন্বয়কারীকে ঘটনা বলতেই তিনি জানান ম্যাডাম কুষ্টিয়ার বক্তৃতায় ঘটনার নিন্দা করবেন।
 
খালেদা জিয়া সেখানে ঘটনার তীব্র নিন্দাও করেন। কিন্তু কী ঘটনা, কারা তা ঘটালো বা ঘটাতে পারে এসব তার বক্তৃতায় স্পষ্ট হয়নি বা ঘটনা তাকে ঠিকমত ব্রিফ করাও হয়নি। পরেরদিন পত্রিকা দেখে ঠাওর করতে পারি ঘটনার ভয়াল দিকগুলো। ৯/১১`র খবর-ছবির ভিড়ে আমাদের সবার সব রিপোর্ট ডাউনপ্লে হয়ে গিয়েছিল।
 
আমরা মিডিয়ার লোকজন আবার অনেকটা শবেবরাতের ফকিরের মতো! পাবলিক কী চায় বা খায় বা খাচ্ছে সেদিকে খেয়াল রাখি! সেভাবেই পাল তুলে দিই অথবা মেইন স্ট্রিম রিপোর্টিং ইভেন্টের সঙ্গে থাকার চেষ্টা করি। পত্রিকা বা মিডিয়ায় প্রতিদিন টিকে থাকা যায়। সে কারণে ইন্টারন্যাশনাল মিডিয়ার পাশাপাশি দেশি মিডিয়ার বড় অংশ জুড়েও তাই কয়েকদিন ৯/১১’র নানাদিক নিয়ে মাতামাতি চলে। তাই দেশে নির্বাচনী ডামাঢোলের মাঝেও টুইন টাওয়ারে হামলায় নিহত বাংলাদেশি আর তাদের স্বজনদের নিয়ে লেখালেখি এখানেও চলেছে বেশ কিছুদিন।

ওই হামলার প্রতিশোধ নিতে যুক্তরাষ্ট্র মিত্রদের নিয়ে আক্রমণ করে আফগানিস্তানে। এরপর ইরাকে। এসবের মাধ্যমে আমেরিকা তাদের স্বরচিত সর্বনাশ আফগানিস্তানের তালেবান আর ইরাকের সাদ্দাম হোসেনকে ক্ষমতা থেকে বিদায় করতে  পারলেও দেশ দুটিতে শান্তি আসেনি। শান্তি নিরাপত্তা কিছুই আসেনি আমেরিকানদের মনে ও জীবনে। আপনি দুনিয়ার যে কোন ট্যুরিস্ট ডেস্টিনেশনে গেলে তা নিজে আঁচ-পরখ করতে পারবেন। ওইসব টুরিস্ট ডেস্টিনেশনে দুনিয়ার নানাদেশের ট্যুরিস্ট পেলেও আমেরিকান কাউকে পাবেন না। ৯/১১’র প্রতিশোধ নিতে গিয়ে আমেরিকা এমন নিজেদের স্বাধীন ঘোরাঘুরি বন্ধ করে ফেলেছে অথবা তাদের সে পথ বন্ধ হয়ে গেছে।
 
শান্তি আসেনি ইরাক-আফগানিস্তানেও। বিশেষ করে এখনও খুবই নাজুক আফগানিস্তানের পরিস্থিতি। প্রায় প্রতিদিনই সেখানে আত্মঘাতী বোমা হামলা, হতাহতের ঘটনা ঘটছে। মারা পড়ছে স্থানীয় নিরীহ সাধারণ নাগরিক অথবা সরকারি চাকুরে থেকে শুরু করে মার্কিন-ব্রিটিশ-অজিসহ নানাদেশের সেনা। সেকারণে আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়াসহ দেশে দেশে যুদ্ধবিরোধী আওয়াজ এখন অনেক বেশি জোরদার। আফগানিস্তান-ইরাক থেকে সৈন্য ফিরিয়ে আনার পথও খুঁজছে দেশগুলো। ধর্মের নামে হামলার পাশাপাশিতে খবরদারিতে গিয়ে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় যে শান্তি আসেনা, সে অভিজ্ঞতায় সে কারণে লিবিয়ার কর্নেল গাদ্দাফির উৎখাতে এবার বিদ্রোহীদের সহায়তার সাপোর্টে ন্যাটো হামলা চললেও মার্কিন নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক বাহিনী সেখানে সশরীরে যায়নি। এবার ৯/১১’র দশম বর্ষপূর্তিতে সন্ত্রাসবাদ ইসলাম ধর্মীয় বিশ্বাসের মধ্যেই জাতীয় মন্তব্য সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার করলেও মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেছেন মুসলমানদের বিরুদ্ধে আমেরিকার কোনও যুদ্ধ নেই বা তা তারা করবেনও না।
 
আবার শান্তির ধর্মের নামে আল কায়েদা আর তালেবান কারখানা থেকে উৎসারিত সন্ত্রাসে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে ইরাক-ইয়েমেন থেকে শুরু করে আফগানিস্তান-পাকিস্তানসহ আরও অনেক দেশ। বাংলাদেশ-ভারতের মতো দেশগুলোও এর ভিকটিম!
 
একসময় কাবুলের বারবাক কারমালের নেতৃত্বাধীন সোভিয়েত সমর্থিত সরকারকে হঠাতে আফগানিস্তানের তালেবান মোল্লা গোষ্ঠীকে সংগঠিত করে আমেরিকা-পাকিস্তান। বুমেরাং’এর মতো এখন সেই তালেবানসহ নানা নামের মোল্লা গ্রুপগুলোর হাতে আমেরিকান-পাকিস্তানিসহ তাদের মিত্ররা এখনও মারা যাচ্ছে।
 
১৯৪৭’এ ভারত বিভাগের পর পাকিস্তান-ভারত নামের দুটি দেশের সৃষ্টি করা হয়। সেই ভারত এখন দুনিয়ার বৃহৎ গণতান্ত্রিক শক্তি থেকে অন্যতম বিশ্ব অর্থনৈতিক শক্তি হবার চেষ্টা করছে আর বেহেস্তে যাবার নিয়তে পৃথক মুসলমান দেশ সৃষ্টির হোতা পাকিস্তানের নাম এখন বিশ্বের অন্যতম ব্যর্থ রাষ্ট্রের খাতায়! উপায়হীন অবস্থায় তারা নিজেরা তালেবান হবার বা তালেবানদের বিরুদ্ধে ফাইট করে টিকে থাকার চেষ্টা করছে!

কাবুলের বারবাক কারমালের নেতৃত্বাধীন সোভিয়েত সমর্থিত সরকার হঠাতে আরও অনেক কিছুর মতো পাকিস্তান দেশটি এ ক্ষেত্রেও আমেরিকার লাঠিয়ালের ভূমিকায় কাজ করেছে। আমেরিকানরা আবার এসব কাজের বিশ্বস্ত লাঠিয়ালদের অস্ত্র-গোলাবারুদ ছাড়াও বিস্তর টাকা-পয়সা দেয়। ব্রিটিশদের ফ্রি চা থিওরির মতো অস্ত্র-গোলাবারুদ প্রথমে ফ্রি দিলেও পরে ঋণের নামে বা ছদ্মাবরণে দেয়। আর সেসব নগদ লাভের লাঠিয়ালগিরির সুযোগে আদি খাঁটি গাওয়া ঘি’র মতো তালেবানির আছর উল্টো সেনাপ্রভাবিত পাকিস্তানি সমাজ-রাজনীতিতে আরও জাঁকিয়ে বসে। সেই থেকে ধর্মের নামে লস্কর-ই-তৈয়বাসহ নানান জঞ্জাল এখন নিত্য নিয়তি পাকিস্তানের!
 
এসবে আবার বোমায় মানুষ না মারলে ধর্ম সেবা হয় না! ডাইরেক্ট বেহেস্তে যেতে আত্মঘাতী বোমাবাজ হতে হয়! অতএব পাকিস্তানি লাঠিয়াল মিলিটারির এমন নীতির মাশুল প্রাণ দিয়ে গুনেছেন সেদেশের প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভূট্টো।
 
এখনও এখানে-ওখানে ধর্মের নামের নানান বোমায় নিত্য মরছেন সাধারণ পাকিস্তানি মানুষজন। জাতি হিসাবেও দুনিয়ার কোথাও তাদের আর ইজ্জতের আসন নেই। পাকিস্তানি শুনলে লোকজন উগ্র মোল্লা তালেবান কিনা পরখ করার চেষ্টা করে! ক্রিকেটের অন্যতম বিশ্বশক্তি হওয়া সত্ত্বেও দুনিয়ার কোনও দেশ আর পাকিস্তানে খেলতে যেতে চায় না! পাকিস্তানে খেলতে গেলে তালেবান সন্ত্রাসীরা হামলে পড়ে তাদের ওপর। তখন আক্রান্ত শ্রীলংকান খেলোয়াড়দের মতো তাদের হেলিকপ্টারে করে নিরাপদে বের করে নিতে হয়!

কিন্তু এতসবকিছু করেও কোনওদিন আমেরিকানদের মন পায়নি তালেবানদের পাকিস্তান। সবশেষ আবোটাবাদের বাড়িতে আল কায়দার নেতা ওসামা বিন লাদেনকে শনাক্ত ও হত্যার ঘটনার পর লাঠিয়ালের প্রতি আস্থা তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে! লাঠিয়াল রাষ্ট্রের পরিণতি বুঝি এমনই হয়!

আফগানিস্তানের মোল্লা রাজনীতির উৎসাহ-উসিলায় মানুষকে ডাইরেক্ট বেহেস্তে পাঠানোর মোল্লা ভূতের হাত পাকিস্তান হয়ে লম্বা হয়েছে বাংলাদেশ অবধি! ৯/১১’র আগে থেকে আফগানিস্তানে প্রশিক্ষণ আর তালেবানি আশকারার বাংলাদেশজুড়ে সৃষ্টি করা হয় বোমাতঙ্কের বিশেষ এক পরিস্থিতির! মোল্লা ধর্ম ব্যবসায়ীরা মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত দেশে বাঙ্গালির প্রাণের পহেলা বৈশাখ, একুশে ফেব্রুয়ারি, ছাব্বিশে মার্চ, ষোল ডিসেম্বর পালন উৎসব উদযাপনের বিরুদ্ধে ধৃষ্ট ফতোয়া দিয়েছে। ফতোয়ায় কাজ হচ্ছে না দেখে বোমা হামলা চালিয়ে তারা গণহত্যা চালিয়েছে পহেলা বৈশাখ রমনার বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ উৎসবে। যশোরে উদীচীর সম্মেলনে, পল্টনে সিপিবির সমাবেশে, বানিয়ারচরের গির্জায় ধর্মের নামে বোমা হামলা চালিয়ে তারা শতশত নিরীহ মানুষজনকে হত্যা-পঙ্গু করেছে! কোটালিপাড়ায় জনসভার মঞ্চের নিচে বোমা পুঁতে রেখে হত্যার চেষ্টা চালিয়েছে দেশের প্রধানমন্ত্রীকে!
 
অনেকের অভিযোগ ৯/১১’র ঘটনারও পাকিস্তানি ধারার সামরিক ঔরসে জন্ম নেয়া বিএনপি নামের দলটি ক্ষমতায় যাওয়াতে তালেবানি ধারা বাংলাদেশে আরো শক্তপুষ্ট হয়! যে কারনে মুফতি আমিনীর মতো আত্মস্বীকৃত ফতোয়াবাজ ধর্মব্যবসায়ী যে কিনা পল্টন ময়দানে দাঁড়িয়ে আমরা হবো তালেবান বাংলা হবে আফগান’ জাতীয় শ্লোগান দেবার পরও ক্ষমতার রাজনীতির সহজ ধারাপাত মুখস্ত করতে তাকে না থামিয়ে উল্টো রাজনৈতিক জোটের ছায়ায় নিয়ে এমপি বানানো হয়েছে।
 
এমপি-মন্ত্রী করা হয়েছে নিজামী-মুজাহিদের মতো ধর্মব্যবসায়ী-স্বাধীনতা বিরোধীদের। ৯/১১’র পর মার্কিন ‘নো ফ্লাই প্যাসেঞ্জার’দের বিপদজ্জনক চিহ্নিত তালিকার দেলোয়ার হোসেন সাঈদীকে সরকারি আদরে নিরাপদ লুকিয়ে রাখা হয়েছে।
 
আবার বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর সেই কোটালিপাড়ার বোমার ঘটনায় পলাতক মুফতি হান্নানকে চরিত্রবান, রাজনৈতিক হয়রানির শিকার উল্লেখ করে তার মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ লিখেন তৎকালীন ‘আল্লার মাল’ খ্যাত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলতাফ হোসেন চৌধুরী! এসবে উৎসাহী তালেবান মতাদর্শী ধর্ম ব্যবসায়ী মোল্লার দল অতঃপর বাংলাদেশে একদিনে পাঁচশ’র বেশি স্থানে বোমা হামলা চালানোর কৃতি্ত্ব দেখিয়েছে!
এরপর তাদের ব্যবহার করে সরকারি উদ্যোগ-ছত্রছায়ায় গ্রেনেড হামলা চালিয়ে হত্যা করতে চেয়েছে দেশের অন্যতম প্রধান নেত্রী, তৎকালীন বিরোধীদলের নেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে! এরপর আবার সরকারি আতিথেয়তা নিরাপত্তায় হত্যা ষড়যন্ত্রকারীদের অন্যতম উপমন্ত্রীর ভাই জঙ্গিনেতা মাওলানা তাজুল ইসলামকে পার করে দেয়া হয়েছে পাকিস্তানে!
 
তালেবান অনুসারী মোল্লাদের ব্যবহার তখন দেশের কৃতি এক সোনার মানুষ, সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়াকে হত্যা করা হয়েছে! হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীকে! পানিতে বিষ ফেলে মেরে ফেলা হয়েছে সিলেটে হযরত শাহজালালের(রঃ) মাজারের পুকুরে থাকা গজার মাছ পর্যন্ত! গত নির্বাচনে দেশের মানুষ ভোটের মাধ্যমে এদের পরাস্ত করলেও প্রধান বিরোধীদলের আস্কারা আর শাসকদলের নতজানু অবস্থানের কারণে সেই আমিনীরা এখনও যখন খুশি দেশের বিচারপতি-মন্ত্রী-সাংবাদিক-সাহিত্যিক যেখানে যার সঙ্গে মতে মেলে না তাকে-তাদেরকে মুরতাদ-অমুসলিম ঘোষণা করে ছাড়ে! খালেদা জিয়া সংবিধান ছুঁড়ে ফেলার কথা বললে সাচ্চা মোল্লা লাঠিয়ালের মতো সেটি ডাস্টবিনে ফেলার অঙ্গীকার করেন। রাষ্ট্র আর আদালতও তার বুড়ি ছুঁতে পারে না। তাকে কোর্টে ডাকলে বিচারকদের উদ্দেশে ট্রে ছুঁড়ে মারে একদল মস্তান অ্যাডভোকেট! পরে তাদেরকে মাপ করে দিতেও হয়!
 
শান্তির ধর্মের নামের ৯/১১’র সন্ত্রাসী হামলা পালটা হামলায় সারা দুনিয়াজুড়ে শান্তিপ্রিয় মুসলমানরা এখন এমন কোথাও শান্তিতে নেই। আমেরিকার পক্ষে থাকলেও নেই। বিপক্ষেই নেই। উল্টো দুনিয়াজুড়ে তা মুসলমান শুধু না, গোটা সব ধর্মে বিশ্বাসী অথবা অবিশ্বাসীদের টিকে থাকার অর্থনৈতিক সংগ্রামকে আরও কঠিন-জটিল করে রেখেছে!

ফজলুল বারীঃ সিডনিপ্রবাসী সাংবাদিক

বাংলাদেশ সময় ১৪১৬ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১১, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।