ঢাকা, রবিবার, ১৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

গণহত্যা ‘উপভোগ’ করতে ঢাকায় থেকে গেলেন ভুট্টো

এরশাদুল আলম প্রিন্স, ল’ এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৫৭ ঘণ্টা, মার্চ ২৫, ২০১৭
গণহত্যা ‘উপভোগ’ করতে ঢাকায় থেকে গেলেন ভুট্টো স্বাধীনতার রক্ত-কথন

পৃথিবীর জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ড জুলফিকার আলী ভুট্টো। পাকিস্তানের সবচেয়ে কপট, ধূর্ত ও রহস্যময় এক চরিত্রের নাম ভুট্টো। ঘোলা পানিতে মাছ স্বীকার করে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করাই তার লক্ষ্য ছিল। যে কোনো উপায়ে গদি দখলই তার একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান ছিল।

ভুট্টো ১৯৫৮ সালে প্রথম আইয়‍ুব খানের মন্ত্রিসভায় যোগ দেন। এরপর ১৯৬৩ সালে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন ও ১৯৬৭ সালে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করে নিজেই পাকিস্তান পিপলস পার্টি নামে একটি দল গঠন করেন।


 
বাংলাদেশের ইতিহাসে ভুট্টো গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হয়ে যান ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর। এ নির্বাচনে তার দল পশ্চিম পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু সার্বিকভাবে পাকিস্তানের দুই অংশেই আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। কিন্তু বেকে বসলেন ভুট্টো। তিনি ইয়াহিয়াকে কাজে লাগিয়ে ষড়যন্ত্রের ‍জাল বিস্তার করতে থাকলেন। ইয়াহিয়‍া ভুট্টোর প্ররোচনায় ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে টালবাহানা করতে থাকলেন। অনেক ইতিহাস গবেষকই একাত্তরের বেদনাদায়ক ঘটনার জন্য মূলত ভুট্টোকেই দায়ী করেন।
 
একাত্তরের মূল ষড়যন্ত্রকারী এই ভুট্টো। অবিভক্ত পাকিস্তানে তিনি গদিতে বসতে পারেননি সত্য, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পর পশ্চিম পাকিস্তানে তিনি ইয়াহিয়া খানের স্থলে রাষ্ট্রপতি ও পরে প্রধানমন্ত্রীও হন।
 
কিন্তু ক্ষমতা কারও চিরস্থায়ী নয়; আজ একজনের, কাল আরেকজনের। পাকিস্তান কখনোই গণতন্ত্রের পথে চলেনি। সেই ধারাবাহিকতাতেই ক্ষমতার মসনদে আসেন জেনারেল জিয়াউল হক। তিনি ভুট্টোকে গদিচ্যুত করেন এবং পরে ফাঁসিতে ঝুলান।
 
স্বাধীনতার পর ভুট্টো বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য বারবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে অনুরোধ করেন। বঙ্গবন্ধু সে আবেদনে সাড়া দেননি। ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানিদের উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘তোমরা সুখে থাক’।
 
একদিকে ভুট্টো সম্পর্ক স্থাপনের জন্য অনুনয়-বিনয় করতে থাকেন, অন্যদিকে কমনওয়েলথে বাংলাদেশের অন্তর্ভূক্তির বিপক্ষে অবস্থান নেন। ভুট্টো বাংলাদেশকে পাকিস্তানেরই অংশ হিসেবে উল্লেখ করে এর বিরুদ্ধে অবস্থা নেন। এর প্রতিবাদে সেসময় বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘ভুট্টো যদি বাংলাদেশের কমনওয়েলথ সদস্যপদ পেতে বাধা দেন বা চালাকি করেন, আমি পশ্চিম পাকিস্তানের দখল নেবো এবং সেটিকেও বাংলাদেশের অংশ করবো। আমিই পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা। আর তিনি সেনাবাহিনীর কৃপায় সেই দেশটির প্রেসিডেন্ট। গণতান্ত্রিকভাবে আমি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী এবং সেখানকার প্রদেশগুলোতে আমি আমার লোকজনকে নিয়োগ দেবো..। । ”
 
আসলে ‌স্বাধীনতার পরেও ভুট্টোর অন্তরের বিষ দূর হয়নি। তাই বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশ স্বীকৃতি পাক, মাথা তুলে দাঁড়াক তা তিনি কখনোই চাননি।
 
ভুট্টো নিজেকে ক্ষমতার বাইরে কখনো ভাবতে পারেননি। তাই তিনি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করতে ও সামরিক শক্তি প্রয়োগ করতে ইয়াহিয়াকে প্ররোচনা দেন। পরাজিত হয়ে তিনি কয়েকবার ঢাকায় আসেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ক্ষমতার মসনদ নিয়ে বোঝাপড়া করতে। কিন্তু কোনোবারই  সুবিধা করতে পারেননি। রণাঙ্গনের হন্তারক জেনারেল আব্দুল্লাহ খান নিয়াজী পাকিস্তানের বিভক্তির জন্য এই ভুট্টোকেই দায়ী করেন। সেইসঙ্গে জেনারেল টিক্কা খানকেও দায়ী করেন তিনি।
 
নিয়াজী সাক্ষ্য-প্রমাণ দিয়ে তার বইয়ে বলেন, ‘তদানীন্তন ইয়াহিয়া সরকার জুলফিকার আলী ভুট্টোর পরামর্শে পরিকল্পিতভাবে ১৯৭১ সালে র্পূব পাকিস্তান পরিত্যাগ করেন’।   ভুট্টোকে পাকিস্তানের একচ্ছত্র নেতা বানানোর জন্য তারই ষড়যন্ত্রে ইয়াহিয়া পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ওপর অস্ত্র প্রয়োগ করেন। ভুট্টো চেয়েছেন ক্ষমতা; এতে পাকিস্তান টিকুক আর না টিকুক। শুধু নিয়াজীই নয়, তৎকালীন পাকিস্তানের সব সামরিক কর্মকর্তাই পাকিস্তান বিভক্তি ও গণহত্যার মাস্টারমাইন্ড হিসেবে ভুট্টোকেই দায়ী করেন। যার ইঙ্গিত খোদ ভুট্টোরই এক ভাষণে পাওয়া যায়, তিনি ওই ভাষণে বঙ্গবন্ধুকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, ‘এধার হাম, ওধার তুম’।
 
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে সামরিক অভিযান শুরু হওয়ার আগেই ইয়াহিয়া ঢাকা ত্যাগ করেন। ঢাকা ত্যাগের আগে তিনি টিক্কা খানকে বলেন, ‘তাদের খুঁজে বের করো’। নিয়াজীর ভাষ্য মতে, ‘টিক্কার নিষ্ঠুরতা দেখার জন্য ভুট্টো ঢাকায় থেকে গেলেন। ভুট্টো দেখতে পেলেন, ঢাকা জ্বলছে। তিনি জনগণের আর্তচিৎকার, ট্যাংকের ঘড়ঘড় শব্দ, রকেট ও গোলাগুলির বিস্ফোরণ ও মেশিনগানের ঠা-ঠা-ঠা আওয়াজ শুনতে পেলেন। ’
 
২৬ মার্চ সকালে জেনারেল টিক্কা, রাও ফরমান ও আরবাবকে পিঠ চাপড়ে ভুট্টো অভিনন্দন জানালেন। তিনি তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশ্বাস দেন।   ভুট্টো শেষতক তার কথা রাখেনও। গণহত্যায় নেতৃত্ব দেওয়ার স্বীকৃতি হিসেবে টিক্কা খানকে পাকিস্তানের চিফ অব স্টাফ হিসেবে নিযুক্ত করেন। রাও ফরমানকে ফৌজি ফাউন্ডেশনের চেয়াম্যরন এবং ব্রিগেডিয়ার আরবাবকে প্রথমে মেজর জেনারেল ও পরে লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদে উন্নীত করেন। রাতের আঁধারে নিরীহ বাঙালিকে নির্বিচারে হত্যার পর ২৬ মার্চ করাচি পৌঁছে ভুট্টো ঘোষণা করেন, ‘আল্লাহর রহমতে পাকিস্তান রক্ষা পেয়েছে’।

আরও পড়ুন
** ‘পূর্ব পাকিস্তানের শ্যামল মাটি লাল করে দেয়া হবে’
** কসাই টিক্কার নির্দেশ, ‘আমি মাটি চাই, মানুষ নয়’
** ২৫ মার্চের গণহত্যার সাক্ষ্য দেন নিয়াজী
** বাংলাদেশ প্রশ্নে মার্কিন সরকার ও জনগণের বিপরীত অবস্থান

** ‘স্বাধীন বাংলাদেশ’ আগেই বুঝে যায় যুক্তরাষ্ট্র-চীন
** নিক্সন-কিসিঞ্জারের ‘ড্রেস রিহার্সেল’​
** ইন্দিরা গান্ধীকে সাফল্যের নিশ্চয়তা জেনারেল মানেক শ’র
** নিক্সনের কাছে ইয়াহিয়ার নালিশ

** টিক্কা বললেন, আমরা আগে গুলি চালাইনি
** ‘টাইগার নিয়াজী’ হয়ে গেলেন ‘বাংলার শৃগাল’
** ইয়াহিয়াকে নিকোলাইয়ের হুমকি, সমর্থন চৌ এনলাইয়ের
** ভারতীয় সংসদে বাংলাদেশ নিয়ে উদ্বেগ​
** স্বাধীনতার রক্ত-কথন
** ২৫ মার্চ অধিবেশন! অন্তরালে অপারেশন সার্চ লাইট
** ‘পাকিস্তান রক্ষা’র জন্য হানাদারদের ভুট্টোর আগাম অভিনন্দন
** শক্তির ভারসাম্য খেলায় দৃষ্টি যখন বাংলাদেশে
** স্বাধীনতার পথের বন্ধুরা


বাংলাদেশ সময়: ০১৫০ ঘণ্টা, মার্চ ২৬, ২০১৭
এইচএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।