ঢাকা, রবিবার, ১৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

নিক্সন-কিসিঞ্জারের ‘ড্রেস রিহার্সেল’

এরশাদুল আলম প্রিন্স, ল’ এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬৪২ ঘণ্টা, মার্চ ২২, ২০১৭
নিক্সন-কিসিঞ্জারের ‘ড্রেস রিহার্সেল’ নিক্সন-কিসিঞ্জারের ‘ড্রেস রিহার্সেল’

১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের প্রথম থেকেই পাকিস্তানি হানাদারদের আত্মসমর্পণ নিয়ে আলোচনা হতে থাকে। মিত্রবাহিনী ও পাকিস্তানি বাহিনীর মাঝে এ বিষয়ে যোগাযোগ হতে থাকে। সেসময় ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের কনসাল জেনারেল ছিলেন আর্চার ব্লাড। পাকিস্তানিদের অবস্থা দেখে তিনি বলেন, “সৈন্যদের ‘দড়ির ফাঁস ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে’ বলে মনে হচ্ছে।”

পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার জন্য আমেরিকা নানাভাবেই তার ঐতিহাসিক কূটনৈতিক বন্ধু পাকিস্তানকে সাহায্য করে। এ লক্ষ্যে তারা কূটনৈতিক তোড়জোড় তো চালায়ই, এক পর্যায়ে সামরিক সহায়তা দেওয়ার জন্যও পথ খোঁজে।

কিন্তু প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার নিশ্চিত হন যে, আইন অনুযায়ী পাকিস্তানকে সামরিক সাহায্য দেওয়া বা সমরাস্ত্র সরবরাহ করা সম্ভব না। তারা দেখলেন যে পাকিস্তানের নিরাপত্তায় তাদের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার কোনো আইনগত রক্ষাকবচ নেই।

সেজন্য তারা বিদ্যমান আইন ও চুক্তিপত্র ঘাটতে থাকলেন। বিভিন্ন চুক্তি, সমঝোতা স্মারক ও প্রতিশ্রুতি খুজে পাওয়া গেল সত্য, কিন্তু তার কোনোটি অনুযায়ীই পাকিস্তানকে সামরিক সাহায্য করার কোনো পথ খুঁজে পাওয়া গেলো না।

ওয়াশিংটন স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ পরিস্থিতির আন্তর্জাতিক তাৎপর্য মূল্যায়ন করবে ও পাকিস্তানের সামরিক সামর্থ্য যাচাই করবে। পররাষ্ট্র দপ্তর পাকিস্তানকে সামরিক সাহায্য সরবরাহের বিকল্পগুলোও খতিয়ে দেখবে।

ইয়াহিয়া শুধু আমেরিকা নয়, অপরাপর মুসলিম দেশগুলোর কাছ থেকেও সাহায্য চাইতে থাকেন। জর্ডানের বাদশা হোসেনের কাছে ইয়াহিয়া অস্ত্র সরবরাহের অনুরোধ জানিয়ে একটি বার্তা পাঠান। কিন্তু বাদশা হোসেন অনুমতি চান যুক্তরাষ্ট্রের। যুক্তরাষ্ট্র নিজে তো সাহায্য করেইনি, বরং জর্ডানের মাধ্যমে সাহায্য করার পথও রুদ্ধ করে দেয়। তৎকালীন মার্কিন আইনানুযায়ী এই বিধানই বলবৎ ছিল যে, যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি যে দেশকে অস্ত্র দিতে অপারগ, সেদেশে তার অস্ত্র তৃতীয় দেশের মাধ্যমেও পাঠানো যাবে না। সে কারণেই বাদশা হোসেনকে যুক্তরাষ্ট্র অনুমতি দিতে পারেনি।

ইরানের শাহের কাছ থেকেও প্রায় একই রকম অভিজ্ঞতা হয় যুক্তরাষ্ট্রের। তেহরানে একজন ঊর্ধ্বতন মার্কিন কূটনৈতিককে শাহ জানিয়ে দেন, ইন্দো-সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তিকে তিনি ভয় পান। এ কারণেই পাকিস্তানকে অস্ত্র দিয়ে সোভিয়েতের সঙ্গে যুদ্ধে জড়াতে চান না শাহ। তবে একটি বিকল্প প্রস্তাব দেন তিনি। তা হলো- যুক্তরাষ্ট্র জর্ডানকে তাদের এফ-১০৪ যুদ্ধবিমান ইরানে পাঠাতে বলতে পারে। তখন শাহ দুই স্কোয়াড্রন ইরানি যুদ্ধবিমান জর্ডানকে দেবে। কিন্তু জর্ডানের যুদ্ধবিমানগুলো ছিল আবার সম্ভাব্য ইসরায়েলি হুমকি মোকাবিলায় ভারসাম্যসূচক। জর্ডান তার যুদ্ধবিমান পাকিস্তানকে দিলে ইসরায়েল সুযোগ নিতে পারে।  

এ প্রেক্ষাপটে নিক্সন বলেন, আমরা সম্ভবত ইসরায়েলের কাছে থেকে এ ব্যাপারে একটি অঙ্গীকার আদায় করতে পারি। কিসিঞ্জার বিষয়টির সঙ্গে একমত হন। তিনি ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী গোল্ডামায়ারের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলারও পরামর্শ দেন। নিক্সন বলেন, “হেনরি, আপনি তাকে (গোল্ডামায়ারকে) বলবেন-এটা রুশ চক্রান্ত, তাহলেই কাজে দেবে । ” কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের আইনে এ বিকল্পও সমর্থন করেনি।

নিক্সন ও কিসিঞ্জার পাকিস্তানকে সাহায্য করার উপায় নিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মিশেলের সঙ্গে আলাপও করেন। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক জনমত বাংলাদেশের পক্ষে থাকায় তারা জাতিসংঘে কিংবা নিরাপত্তা পরিষদকে তাদের নিজেদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারেরও অক্ষম হয়ে পড়েন।

বিভিন্ন নথিপত্র থেকে এটা স্পষ্ট যে, এই দুই নেতাই (নিক্সন-কিসিঞ্জার) জানতেন, তাদের পক্ষে পাকিস্তানের জন্য ‘মুখের কথা’ বা ‘লিপ সার্ভিস’ ছাড়া সামরিক সাহায্য করা সম্ভব নয়। কিন্তু এই সরল সত্য তারা ইয়াহিয়াকে কখনো জানাতে পারেননি। এমনকি এই সীমাবদ্ধতার কথা তারা নিজেদের একান্ত সংলোপেও এড়িয়ে গেছেন। ফলে, ইয়াহিয়া পুরো নয় মাস অযথাই নিক্সনের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন- যদি কিছু সামরিক সাহায্য আসে!

রাশিয়া-ভারতকে দমাতে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যায়, তা নিয়ে নিক্সন-কিসিঞ্জার আরও বিস্তারিত আলোচনা করেন। কিসিঞ্জারের মতে, তাদের কাছে দু’টো বিকল্প ছিল, যতদূর সম্ভব পশ্চিম পাকিস্তানের ওপর হামলা থেকে ভারতকে বিরত রাখতে ভয় দেখাতে হবে। আর দ্বিতীয়ত, রাশিয়ার বিরুদ্ধে একটি কড়া হু‍ঁশিয়ারি দিতে হবে।

নিক্সন-কিসিঞ্জার ভারতকে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে, পরিস্থিতি কিন্তু খারাপের দিকেই যাচ্ছে। আর সোভিয়েত ইউনিয়নকে বলেছেন, তোমাদের কিন্তু মূল্য দিতে হবে। কিন্তু কিসিঞ্জারই আবার ভাবেন যে, এতে কাজ হবে বলে মনে হচ্ছে না।

এভাবে আইনগত বাধা ও কৌশলগত বিষয়াদি বিবেচনায় নিয়ে রাশিয়া ও ভারতকে শুধু ভয় দেখানো এবং চীন, জর্ডান ও ইরানকে উৎসাহিত করতেই বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌবহর পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয় যুক্তরাষ্ট্র। কিসিঞ্জার স্বীকার করেন, যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে হস্তক্ষেপ করার কার্যকর হাতিয়ার নেই। নিক্সন বলেন, আমরা তো চীনা সাহায্য ছাড়া এমন কিছুই করতে পারি না।

কিসিঞ্জার সেসময় নিক্সনকে উদ্দেশ্য করে এক আলাপে মন্তব্য করেন, ‘মি. প্রেসিডেন্ট, আমার অবশ্য আপনাকে হুঁশিয়ার করে দেওয়া উচিৎ যে, আমাদের এই ধাপ্পা যদি ধরা পড়ে, তাহলে কিন্তু আমরা বিপদে পড়বো। ’

নিক্সন ও কিসিঞ্জার উভয়ে জর্ডানের যুদ্ধবিমান প্রেরণ, চীনের সেনা মোতায়েন ও বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌবহর পাঠানোর সম্ভাব্য উদ্যোগকে ‘ড্রেস রিহার্সেল’ বা যুদ্ধ নাটকের মহড়া হিসেবে বর্ণনা করেছেন পরবর্তীতে। প্রাপ্ত নথিপত্র অনুযায়ী, এ রকমের একটি প্রতারণার্পূণ সামরিক কৌশলের অংশ হিসেবে বঙ্গোপসাগরে নৌবহর পাঠানোর ধারণাটির উদ্ভব হয় বলে কিসিঞ্জারের বক্তব্যে পাওয়া যায়।

বাংলাদেশ সময়: ১২৩৪ ঘণ্টা, মার্চ ২২, ২০১৭
এইচএ/

আরও পড়ুন
** ইন্দিরা গান্ধীকে সাফল্যের নিশ্চয়তা জেনারেল মানেক শ’র
** নিক্সনের কাছে ইয়াহিয়ার নালিশ

** টিক্কা বললেন, আমরা আগে গুলি চালাইনি
** ‘টাইগার নিয়াজী’ হয়ে গেলেন ‘বাংলার শৃগাল’
** ইয়াহিয়াকে নিকোলাইয়ের হুমকি, সমর্থন চৌ এনলাইয়ের
** ভারতীয় সংসদে বাংলাদেশ নিয়ে উদ্বেগ​
** স্বাধীনতার রক্ত-কথন
** ২৫ মার্চ অধিবেশন! অন্তরালে অপারেশন সার্চ লাইট
** ‘পাকিস্তান রক্ষা’র জন্য হানাদারদের ভুট্টোর আগাম অভিনন্দন
** শক্তির ভারসাম্য খেলায় দৃষ্টি যখন বাংলাদেশে
** স্বাধীনতার পথের বন্ধুরা

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।