ঢাকা, রবিবার, ১৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

সোহাগী তনু: ফরেনসিক মেডিসিনের অহংকার না অভিশাপ

অধ্যাপক মোহাম্মদ নাসিমুল ইসলাম, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩২৩ ঘণ্টা, মে ২০, ২০১৬
সোহাগী তনু: ফরেনসিক মেডিসিনের অহংকার না অভিশাপ

তনু মরে গিয়ে বাংলাদেশের মেডিকোলিগ্যাল সার্ভিসের দীনতা একেবারে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো। মৃত্যুর আগে তিনজন অমানুষ তাকে ধর্ষণ করলেও ময়নাতদন্তকারীরা তা বুঝতেই পারলেন না! এখন তারা অপেক্ষা করছেন ডিএনএ প্রতিবেদনের, যা দেখে দ্বিতীয় পক্ষের ময়নাতদন্তকারীরা তাদের প্রতিবেদন প্রস্তুত করবেন।

এই হলো আমাদের দেশের ‘অর্ধশিক্ষিত’ ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের মান!

তাদের ‘দৃঢ়তায়’ আমরা বাইরে থেকে দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েছিলাম তনু হত্যার বিচার নিয়ে। দ্বিতীয় ময়নাতদন্তও করা হলো একই স্থানে। অতীতের মতো ফলাফল এক রকমই হওয়ার কথা। কিন্তু ডিএনএ পরীক্ষার ফল সমস্ত দুর্ভাবনাকে দূরে ঠেলে প্রকাশ করলো ওইসব অসাধু, ভুয়া, ‘জ্ঞানী’ বিশেষজ্ঞদের। ধিক নিজেকে একজন ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ হিসেবে! এই চিত্র শুধু ফরেনসিক মেডিসিনেই নয়, দেশের চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রতি শাখাই আজ অরক্ষিত। এমন কি মৃত মানুষ নিয়ে যে শাখাটা মতামত দেয় সেটিও।

উচ্চশিক্ষায় ভর্তি থেকে পদায়ন আর পদোন্নতিতে যোগ্যতার মূল্যায়ন সঠিকভাবে না করায় চিকিৎসা বিজ্ঞানের বড্ড ক্ষতি করে ফেলছেন। আর তাই নব্য বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে এর চেয়ে বেশি কি-ই বা আশা করার আছে! অবাক করা ব্যাপার, প্রতিটি ক্ষেত্রে আমাদের বিশেষজ্ঞরা কি স্বাধীনতাই না ভোগ করেন! হাসপাতালে ডাক্তারের ভুলে রোগী মারা যায়, ভাঙচুর হয় দু’চারটি জানালা। তারপর দিন শেষে ক্রস আর ব্যালেন্সের অভাবে ওই মৃত্যুটাকেই মানানো হয় অনিবার্য হিসেবে। দায়মুক্তির মাধ্যমে ডাক্তার হয়ে যান ধোয়া তুলসি পাতা।

তনুর ঘটনায় ডিএনএ পরীক্ষা (ক্রস আর ব্যালেন্স) না করা হলে প্রথম ময়না তদন্তের ফলাফলই টিকে যেত। অবিশ্বাস্য হলেও তা মেনে নিতে হতো সবাইকে। নিভৃতে তনুকে কাঁদতে হতো অনন্তকাল। শুধু কি তাই, শাস্তি ফাঁকি দিয়ে বিজয়ী দুর্বৃত্তরা সময়ের ব্যবধানে নতুন কোনো তনুকে আমাদের সামনে হাজির করতো।

বড় জানতে ইচ্ছা করলো! এমন স্পর্শকাতর মামলায়
১। প্রথম ময়নাতদন্তে কেন ডিএনএ পরীক্ষা এড়িয়ে যাওয়া হলো!
২। পরবর্তীতে কে সেই মহৎ ব্যক্তি যিনি এখানে ডিএনএ পরীক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন?
৩। দ্বিতীয় ময়নাতদন্তের প্রভিশনাল প্রতিবেদন কেন দেওয়া হচ্ছে না। মেঘ দেখে বৃষ্টির পূর্বাভাস দিতে কি বিশেষজ্ঞের কোনো প্রয়োজন আছে?

দেশে দ্বিতীয় ময়নাতদন্তের হার কিন্তু কম নয়। কিন্তু ফল পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে ক্রস আর ব্যালেন্সের অভাবে দ্বিতীয় ময়নাতদন্তটি প্রথম ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনকেই প্রতিষ্ঠিত করেছে। ফলে বিচারের বাণী যে তিমিরে ছিলো সেখানেই পড়ে থাকছে। দ্রুত অগ্রসরমান যুগে স্থবির থাকা মানে যে পিছিয়ে পড়া সেই বোধদয় কি আমাদের আসবে না।

(২)
যে ডিএনএ পরীক্ষার প্রতিবেদনের জন্য দ্বিতীয় পক্ষের ময়নাতদন্তকারীরা অপেক্ষায় আছেন সেই প্রতিবেদনে চমক ছাড়া আশার কিছু আছে বলে আমি মনে করি না।

যে তিনজনের ডিএনএ শনাক্ত করা হয়েছে তার একটি যদি প্রথম ময়নাতদন্তকারীর হয়ে থাকে, তাতে আমি মোটেই অবাক হবো না। ভ্যাজাইনাল সোয়াবের ডিএনএ পচে গেছে, প্যান্টিতে ডিএনএর উপস্থিতি মানেই তো আর ধর্ষণ নয়। বিখ্যাত বক্সার মাইক টাইসন যে বিছানায় একজন বিউটি প্যাজেন্টকে ধর্ষণ করেছিলেন সেই বিছানার চাদরে দুই শতাধিক মানুষের সিমেন শনাক্ত হয়েছিল, তাই বলে ওই দু’শত মানুষ তো আর ধর্ষক ছিলো না!!

(৩)
উপদেশ: বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ্য শিক্ষক দিয়ে ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ খুলে জনগুরুত্বপূর্ণ মামলার ময়নাতদন্ত করা যেতে পারে।   এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য সেক্টরের দুই স্তম্ভ উপাচার্য অধ্যাপক কামরুল হাসান খান এবং বিএমএ নেতা অধ্যাপক ইকবাল আরসালানকে বিনয়ের সঙ্গে অনুনয় করেছি। তনুর মৃত্যুতে তাদের মন নাড়া দিলে, অনুনয়ের বাস্তবতায় এই তনুই একদিন ফরেনসিক মেডিসিনের অহংকার হয়ে যেতে পারে।


লেখক: সাবেক বিভাগীয় প্রধান, ফরেনসিক মেডিসিন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ। বর্তমানে ইউনিভার্সিটি টেকনোলজি মারা [UiTM] মালয়েশিয়ায় অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ফরেনসিক মেডিসিন হিসেবে কর্মরত।
ইমেইল: [email protected]

বাংলাদেশ সময়: ১৩০০ ঘণ্টা, মে ২০, ২০১৬
এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।