ঢাকা, রবিবার, ১৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

প্রবারণা পূর্ণিমার প্রেক্ষাপটে গৌতম বুদ্ধের বিশ্বমানবতার ধর্ম

দিলীপ কুমার বড়ুয়া, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬১৮ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৫, ২০১৫
প্রবারণা পূর্ণিমার প্রেক্ষাপটে গৌতম বুদ্ধের বিশ্বমানবতার ধর্ম

প্রবারণা পূর্ণিমা। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ধর্মীয় এ উৎসব শীল, সমাধি, প্রজ্ঞার অনুশীলনের মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি ও আত্মপরিশীলতায় আত্মদীপ প্রজ্জ্বলনের আলোকময় দিন।

আষাঢ়ী পূর্ণিমা থেকে আশ্বিনী পূর্ণিমা পর্যন্ত তিনমাস বৌদ্ধ ভিক্ষুসংঘ বর্ষাব্রত পালন করেন এবং ধর্মপ্রাণ উপাসক-উপাসিকারা প্রতি পূর্ণিমা অমাবস্যায় অষ্টশীল গ্রহণ, উপবাসব্রত পালন করেন। বুদ্ধের ধর্মবাণী গুলো যথাযথভাবে ধারণ করে শীলে, ধ্যানে, বিদর্শন ভাবনায় আত্মনিমগ্ন হয়। বর্ষাব্রত সমাপনে আশ্বিনী পূর্ণিমার প্রথম দিবসে আসে প্রবারণার স্নিগ্ধ অমিয়ধারা, পূর্ণিমার পূর্ণতায় বোধিতে প্রবারিত হওয়ার দিন। দৈনন্দিন জীবনাচারের দোষ-ক্রটিকে বর্জন করে আত্মবিশ্লেষণের মাধ্যমে বিশুদ্ধ বিনয়বিধানে জীবনকে সঁপে দেওয়ার শুভক্ষণ।

শুভ আষাঢ়ী পূর্ণিমার পূণ্য তিথিতেই তথাগত বুদ্ধ তাবতিংশ স্বর্গে বর্ষাবাস গ্রহণ করেছিলেন। এ বর্ষাবাসের কারণ তার মাতৃদেবীকে নির্বাণ লাভের হেতু উৎপন্ন করা।   মহামানব বুদ্ধ প্রবারণা পূর্ণিমায় মাতৃদেবীকে ধর্মদেশনার পর তাবতিংস স্বর্গ হতে সাংকস্য নগরে অবতরণ করেন। এ দিন শ্রাবস্তীর জেতবনে অবস্থানকালে বুদ্ধ ভিক্ষুসংঘকে প্রবারণার তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেন এবং এ দিনেই সর্বজ্ঞ বুদ্ধ সারনাথে তিনমাস বর্ষাব্রত শেষে ষাটজন ভিক্ষুকে তার সাধনালদ্ধ মহাসত্যের অমোঘবাণী প্রচারের নির্দেশ দেন।

তিনি ভিক্ষুসংঘকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, ‘বহুজনের হিতের জন্য, বহুজনের সুখের জন্য, জগতের প্রতি অনুকম্পা প্রদর্শনের জন্য, দেব-মানুষের হিতের জন্য তোমরা দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ো এবং ধর্মসুধা বিলিয়ে দাও। যার আদিতে কল্যাণ (শীল), যার মধ্যে কল্যাণ (সমাধি) এবং যার অন্তে কল্যাণ (প্রজ্ঞা), যা অর্থযুক্ত ও ব্যঞ্জনযুক্ত। ’ বুদ্ধের এই বাণী চিরন্তন এবং চিরশ্বাশ্বত। এখানে বুদ্ধ সকল সম্প্রদায়ের সুখ ও মঙ্গলের কথা বলেছেন। সকলের কল্যাণের কথা বলছেনে। এই বাণীতেই বুদ্ধের মহত্ব, উদার মানসিকতা ও বিশাল হৃদয়ের মৈত্রী, করুণার বহিঃপ্রকাশ।

মহাবর্গে উল্লেখ আছে, বুদ্ধ এ দিন থেকেই তার ধর্মবাণী সাধারণের কল্যাণে প্রচার শুরু করেছিলেন। তিনি বলেছেন, ‘তোমরা এই সত্য ধর্ম প্রচারের জন্য জগতময় ছড়িয়ে পড়ো এবং এমন ধর্ম প্রচার করো, যা সর্ব প্রাণীকূলের জন্য কল্যাণকর। তবে এমন ধর্ম প্রচার করবে  না, যা মানবের জন্য হিতকর নয়। ’ সত্যমার্গকে বরণ করার সম্যক প্রচেষ্ঠা এবং লোভ, মোহ, হিংসা, দ্বেষ ইত্যাদিকে বর্জন বা বারণের মধ্যদিয়ে কুশলকর্ম সম্পাদনের প্রত্যয়ে প্রবারণার আলোকিত নবজাগরণ বিশ্বের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের মননে, বোধিতে, প্রজ্ঞায় ও চেতনার শুচিশুভ্র প্রাণিত সাধনায়।

মহাকারুণিক বুদ্ধের নির্দেশে অনুপ্রাণিত ভিক্ষুসংঘ প্রবারণা পূর্ণিমার পরদিন থেকে একমাস পর্যন্ত বিশ্বের বৌদ্ধদেশে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে, নগরের বিভিন্ন বৌদ্ধমন্দিরে দানোত্তম কঠিন চীবর দানোৎসবে ছুটে চলেন বুদ্ধের অমিয় ধর্মবাণী বিশ্বমানবতার কল্যাণে ছড়িয়ে দিতে, যে বাণীতে অহিংসার বীজমন্ত্র, সাম্য ও মহামৈত্রীর আহবান, জাগতিক দুঃখ থেকে মুক্তির পথনকশা।

সত্যসন্ধানী মানবপুত্র বুদ্ধ জন্ম-জন্মান্তরের দশবিধ পারমী পূর্ণ করে পৃথিবীর সমস্ত প্রাণিজগতকে মুক্তির পথের সন্ধান দিতে আড়াই হাজার বছরেরও আগে আর্বিভূত হয়েছিলেন। মানুষের অন্তঃজীবনের রহস্য সন্ধানে সংসার ত্যাগ করে অনন্ত সম্ভাবনার অংকুরিত স্বপ্ন থেকে সুদীর্ঘ ছয় বছরের কঠোর সাধনায় অর্জন করেছিলেন পরম সম্বোধি বা বোধিজ্ঞান। নিজের অভিজ্ঞতা, প্রাজ্ঞ দিয়ে আলোর সন্ধানী দৃপ্ত সংকল্পে খোঁজেন মানবজন্মের রহস্যের উত্তর, ঋদ্ধিতে আবিষ্কার করেন দুঃখমুক্তির পথচারী আর্যসত্য ও আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ।

বুদ্ধের জীবন ও দর্শনের মূল বাণী হল করুণা- মৈত্রী ও অহিংসা। তিনি আজীবন মানুষের দুঃখ-মুক্তিরই সাধনা করেছেন। এই মহাজ্ঞানীর জীবন দর্শনে শীল, সমাধি ও প্রজ্ঞার আলোয় অহিংসা, সাম্য ও বিশ্বমানবতার অপরিমেয় মৈত্রীর হিরন্ময় প্রকাশ, যুক্তি আর বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে প্রমাণিত সত্য আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ। তার সাধনালদ্ধ মহাসত্যগুলোর মধ্যে কোনো অলৌকিকত্ব নেই, ঈশ্বর কিংবা দেবতার করুণায় অর্জিত হয়নি আধুনিক বিজ্ঞান মনস্ক ধর্ম। সম্পূর্ণ নিজের যোগ্যতা ও সাধনায় বুদ্ধ অর্জন করেছেন বোধি, যেখানে অন্ধবিশ্বাসের অনুপস্থিতি ও যুক্তিনির্ভর বৈজ্ঞানিক তত্ত্বজ্ঞানের বিশ্লেষণ। তার ধর্মে আছে যুক্তি, আত্মোপলদ্ধি-আত্মজিজ্ঞাসা-আত্মত্যাগ, নিজেকে জানার, নিজেকে বিচার করার অনন্য শিক্ষা।

বুদ্ধের মতে, জগতের প্রত্যেকটি জিনিস কার্যকারণ শৃঙ্খলাবদ্ধ। কোনো বস্তু স্বয়ং উৎপন্ন হয় না। একটি ঘটনা আরেকটি ঘটনা থেকে সংঘটিত হয় ও বিস্তার লাভ করে। সবকিছুর উৎপত্তি কোনো ঘটনা থেকে। তিনি তার আবিষ্কৃত ধর্ম ‘প্রতীত্য সমুৎপাদ নীতি’ বা কার্যকারণ নীতির মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক উপায়ে ব্যাখ্যা করেছেন, যেখানে কোনো অস্পষ্টতা নেই। এ নীতির প্রেক্ষাপটে বুদ্ধ তার সত্য-সন্ধানীর দৃষ্টিতে জীবন জগতকে অবলোকন করেছেন। তিনি দুঃখের স্বরূপ নিরূপণ করতে গিয়ে বলেছেন-‘জীবন দুঃখময়, এ দুঃখের কারণ আছে, এ দুঃখ থেকে মুক্তির উপায়ও আছে। তার মতে, জগতে সবকিছু পরিবর্তনশীল, বিশ্ব আবর্তিত হচ্ছে বস্তুর বিরামহীন পরিবর্তন ও
 রূপান্তরে এবং জীবন এক অবিরাম নদীর চিরন্তন বয়ে চলা অন্তহীন স্রোত, যেখানে আর্বিভাব ও তিরোভাব জাগতিক নিয়মে ঘটে। এ জগত অনিত্য, এ জীবন অনিত্য এবং কোনো কিছুই অবিনশ্বর নয়। ’

হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ পদার্থ বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন বলেছিলেন, ‘পৃথিবীতে এ পর্যন্ত যত ধর্ম-মত-পথের অবতারণা হয়েছে, তার মধ্যে গৌতমবুদ্ধ সৃজিত জীবন পরিচালনার রীতি-নীতি ও আদর্শের ধর্মেই রয়েছে আগামী দিনের ‘কসমিক রিলিজিয়াস’র নির্যাস। ’ আইনস্টাইন আরও বলেছেন, ‘আধুনিক বৈজ্ঞানিক মনের গ্রহণীয় যদি কোনো ধর্ম থাকে, তা বৌদ্ধধর্ম। ’ যেখানে রয়েছে, পৃথিবীর সৃষ্টি, আদি এবং অন্তের বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যাখ্যা। গৌতম বুদ্ধের শিক্ষা মানুষকে নিজের চিত্তের নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ধীরে ধীরে নির্বাণের পথে নিজেকে নিয়ে যেতে শেখায়। বুদ্ধ বলেছেন, ‘আমার শিক্ষা জ্ঞাণীদের জন্য। তুমি যদি নিজের মন দ্বারা বিভ্রান্ত না হয়ে সেগুলো সঠিকভাবে পড়তে জানো তবে তুমি এই মহাবিশ্বের প্রকৃত শিক্ষা পাবে। ’

বৌদ্ধধর্ম প্রাকৃতিক এবং আত্মিক দু’টি ধারণাকেই অর্থপূর্ণভাবে একীভূত করতে পেরেছে, যা প্রাকৃতিক ও আত্মিক দু’ক্ষেত্রেই অভিজ্ঞতালদ্ধ জ্ঞান থেকে তৈরি ধর্মীয় অনুভূতির ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। অর্থাৎ সকল প্রাণীর প্রতি মৈত্রী প্রদর্শন হচ্ছে সমগ্র প্রকৃতিকে ভালোবাসারই একটি নামান্তর। অন্যদিকে ধ্যান এবং বুদ্ধের নীতি অনুশীলনের মাধ্যমে নিজেকে বা নিজের চিত্তকে জয় করা, অজ্ঞানতাকে দূর করে নিজের মাঝে লুকায়িত পরম জ্ঞান বিশালতাকে আবিষ্কার করা হচ্ছে আত্মিক ক্ষেত্র। মানবমুক্তির দুঃসাহসিক অভিযানে মহামানব বুদ্ধের গয়ার বোধিদ্রুমমূলে বুদ্ধত্ব লাভ, সারনাথে ধর্মচক্র প্রবর্তন সূত্রের দেশনার মাধ্যমে জ্ঞানীর ধর্মের সূচনা, অপার মৈত্রী, করুণা, অপ্রমেয় বিশ্বপ্রেম ও মানব কল্যাণের বাণীর প্রচার একটি বর্ণিল মহাকাব্য, একটি ইতিহাস, একটি অনন্য বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল ধর্মের গোড়াপত্তন। বুদ্ধ বলেছেন, ‘অপ্রমত্ত হও, আত্মদীপ হয়ে বিহার করো। ’ আত্মদীপ প্রজ্জ্বলিত করে নিজের মুক্তির জন্য কুশলকর্ম সম্পাদন করো, আত্মশরণ নাও, অন্যের ওপর নির্ভর করো না, নিজেই নিজের প্রদীপ হও। নিজের মুক্তির জন্য ঈশ্বর মুখাপেক্ষী না হয়ে নিজের কর্মসাধনায় আত্মনিয়োগ করো।

প্রাচীন যুগের মানুষ হয়েও বুদ্ধ ছিলেন কর্মবাদী, আধুনিক ও মুক্তচিন্তার মানুষ। কারণ, কোনো অলৌকিক শক্তির ওপর নির্ভর না করে কঠোর সাধনার মাধ্যমে লাভ করেছিলেন বোধিজ্ঞান। বুদ্ধ কখনও জন্মকে প্রাধান্য দেননি। জীবনকে পরিচালিত করার জন্য মানুষের স্বীয় কর্মই অন্যতম। তাই অদৃষ্টবাদ বা ঐশ্বরিক শক্তির ওপর কর্ম পরিচালিত হয় না। চারিত্রিক দৃঢ়তা, বিশুদ্ধ চিত্ত, নৈতিক বিবেচনায় জীবনের গতিপথকে সৎকর্ম সম্পাদনে উজ্জীবিত করা যায়। অশুভ কর্মকে বর্জন করে সৎকর্মকে পাথেয় করে মুক্তির পথ অন্বেষণে মনুষ্য জন্মকে দুর্লভ করার সার্থকতা। নিজ কর্মের দ্বারা মানুষ স্রোতাপত্তি, সকৃদাগামী, অনাগামী ও অরহত ফল লাভ করতে পারে এমনকি নির্বাণ সাক্ষাতের পথে আলোকময় অভিযাত্রায় সামিল হওয়া যায়।

বুদ্ধ মানুষের অসীম শক্তি, একাগ্রতা, অধ্যবসায় নিয়ে উদাত্ত কণ্ঠে বলেছেন, মানুষ নিজেই নিজের আশ্রয়, অন্য আশ্রয় আর কি থাকতে পারে? নিজেকে সুসংযত করলেই দুর্লভ আশ্রয় পাওয়া যায়। অর্থাৎ সুসংযত জীবন পরিচর্যা মানে বুদ্ধ নির্দেশিত একটি আলোকিত পথের সন্ধান, যা মধ্যম পথ বা পালিতে ‘মজঝিম পটিপদা’। মধ্যমপথ বলতে চরমসুখ ও চরম কৃচ্ছতা সাধন বা আত্মনিগ্রহের মাঝামাঝি পথ। বুদ্ধ কোনো চরমপন্থায় বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি মধ্যপন্থা অবলম্বনকেই সঠিক মনে করতেন। বোধিপ্রাপ্তির লক্ষ্যে কঠোর তপস্যাকালীন সময়েই এ জ্ঞান প্রাপ্ত হন তিনি এবং এই মধ্যমপথ অবলম্বনের মাধ্যমে বুদ্ধ আলোকপ্রাপ্ত হন। এই পথেই জীবন পরিচালনা করা উত্তম মঙ্গল।

বুদ্ধ দুঃখ মুক্তির জন্য আটটি পথ বা মার্গ অনুসরণ করতে আহবান জানিয়েছেন, যা তিনটি স্কন্ধের অর্ন্তগত- শীলস্কন্ধ, সমাধিস্কন্ধ এবং প্রজ্ঞাস্কন্ধ। আর্যঅষ্টাঙ্গিক মার্গের তিনটি মার্গকে শীলের মূল হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এই তিনটি হল- সম্যক বাক্য, সম্যক কর্ম ও সম্যক জীবিকা। তিনটি মার্গকে সমাধি হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। এই তিনটি হল- সম্যক প্রচেষ্টা, সম্যক স্মৃতি ও সম্যক সমাধি। দু‘টি মার্গকে ব্যাখ্যা করেছেন প্রজ্ঞা হিসেবে। প্রজ্ঞার এ দু‘পথ হল- সম্যক দৃষ্টি ও সম্যক সঙ্কল্প। তাই সৎ দৃষ্টি, সৎ সংকল্প, সৎ বাক্য, সৎ চিন্তা, সৎ কর্ম, সৎ জীবিকা, সৎ প্রচেষ্টা, সৎ স্মৃতি ও সৎ সমাধিকে অষ্ট বিশুদ্ধ পথ বলে অভিহিত করা হয়েছে। সুতরাং নীতি, আর্দশ, মানবিক মূল্যবোধের  জীবনাচরণে মানুষকে কর্মে, মননে, চিন্তাচেতনায় শীল, সমাধি ও প্রজ্ঞার অনুশীলনে নিজেকে সমর্পণ করে বুদ্ধ নির্দেশিত অষ্টমার্গে নিজেকে উৎসর্গ করলে জীবন সুন্দর ও পরিপূর্ণতা লাভ করে, অনির্বাণ চেতনায় জাগ্রত থেকে মানুষ পেতে পারে অমৃতের সন্ধান।

মহাকারুণিক বুদ্ধ সুদীর্ঘ ৪৫ বছর তার অহিংসা সাম্য, মৈত্রী ও বিশ্বপ্রেমের বাণী মানবতার কল্যাণে প্রচার করেছেন। তার মতে, মৈত্রী হচ্ছে বিশ্বের সমস্ত প্রাণীর কল্যাণ কামনায় ব্রতী হওয়া। তিনি বলেছেন, ‘মা যেমন সন্তানকে আপন জীবনের চেয়ে বেশি ভালবাসেন, তদ্রুপ জগতের সর্বজীবের প্রতি ও মৈত্রী প্রদর্শন করবে। ’ মানুষ হিসেবে তিনি সব প্রাণীকে সমভাবে, সমজ্ঞানে দেখেছেন। মৈত্রী ও করুণা বুদ্ধের মানবতাবাদের প্রকৃষ্ট দিক।

বুদ্ধের বাণীসমগ্র কোনো বিশেষ সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীর জন্য নয়। পৃথিবীর সমস্ত প্রাণীকূলের কল্যাণের জন্য এ ধর্ম। মৈত্রী ভাবনায় মহামানবতার মৈত্রীর সুর বিশ্বের সমস্ত প্রাণীকূলের মঙ্গল কামনায় অনুরণিত হয়। বুদ্ধ মানবতার মুক্তিসাধনে অজেয় এবং একজন শ্রেষ্ঠ মানবতাবাদী। তার মানবতাবাদী জীবন দর্শন সর্বমানবের হিত সাধনে এক উজ্জ্বল মাইলফলক। গ্রিকদার্শনিক সক্রেটিস ও কল্যাণমূলক দর্শন ব্যাখ্যা করেছিলেন। সক্রেটিসের দর্শন ছিল একটি আদর্শকে সামনে রেখে সৌহার্দ্যপূর্ণ, সম্প্রীতি ও শান্তির মোড়কে সমাজ প্রতিষ্ঠা। অন্যদিকে বুদ্ধ বিশ্ব শান্তি বির্নিমাণে মানুষের কল্যাণের পাশাপাশি সমস্ত প্রাণীসত্তার মঙ্গল কামনায় নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। জাতিভেদ ও বর্ণবাদকে তিনি ধিক্কার দিয়েছেন। ধনী, দরিদ্র, উঁচু, নীচু, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় সবাই তার সাম্যনীতির সুশীতল ছায়ায় ঠাঁই পেয়েছেন। বুদ্ধের আধুনিক, উদার চেতনা মানবসভ্যতার বৃহত্তর কল্যাণে বিশ্বব্যাপী উজ্জ্বল বাতিঘর হিসেবে আলোর পথ দেখাবে। হিংসা দ্বন্দ্বযুক্ত সমাজ ব্যবস্থার বিপরীতে একটি অহিংস সমাজ ব্যবস্থা, মৈত্রীময় সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ প্রতিষ্ঠায় মহামানব বুদ্ধের কালজয়ী-যুগান্তকারী মানবতাবাদী দর্শন বিশ্বে শান্তি ও কল্যাণ বয়ে আনুক, বুদ্ধের অহিংসার বাণী ছড়িয়ে যাক সবার মাঝে। অনাবিল, অকৃত্রিম, শর্তহীন প্রেম, শুচিশুভ্র পূর্ণতায় মানব চেতনাকে বিকশিত করুক। প্রবারণার প্রত্যাশা সর্বজীব সুখ লাভ করুক, সর্বমানবের হিত সাধন হোক, বিশ্বে শান্তি আসুক, চেতনা হোক প্রজ্ঞায় উদ্ভাসিত। মহামানব বুদ্ধের অমরবাণীর প্রভাবে ঋদ্ধ হোক সবার জীবন।



লেখক: দিলীপ কুমার বড়ুয়া, প্রাবন্ধিক ও গবেষক



বাংলাদেশ সময়: ১৬১৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৫, ২০১৫
এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।