ঢাকা, বুধবার, ১৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

রাজনীতির পুরোনো কাগজে বর্তমান প্রসঙ্গ

প্রণব সাহা, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৪০ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৫, ২০১৪
রাজনীতির পুরোনো কাগজে বর্তমান প্রসঙ্গ

ফেসবুকে এখন সবাই পুরোনো ছবি আপলোড করছেন। লোভে পড়ে আমিও বসলাম পুরোনো ছবি খুঁজতে।

পেলাম কিছু। তবে সঙ্গে আরো পেলাম পুরনো কাগজ। আর তা খুবই প্রাসঙ্গিক মনে হলো বর্তমান রাজনীতির জন্য।

লক্ষ্য করছি, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ আর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মীর্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের মধ্যে বাদানুবাদ চলছে। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন এরশাদ। তিনি এখন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা- যাকে দলের নেতা-কর্মীরা ‍‘স্বাধীনতার ঘোষক’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চান, সেই জিয়াউর রহমান বীরউত্তমকে রাজাকার পুনবার্সনকারী হিসেবে অভিহিত করেছেন। যাকে সেনাপ্রধান বানিয়েছিলেন জিয়াউর রহমান নিজেই।

স্বাধীনতার ঘোষক, মুক্তিযুদ্ধে এইচ এম এরশাদের ভূমিকা এসব অবশ্য এই লেখার বিষয় নয়। বরং দৃষ্টি আর্কষণ করতে চাই গত দুই যুগে বিএনপি-জাতীয় পার্টির সম্পর্কের ব্যাপারে। পুরনো কাগজ হিসেবে পেয়েছি ১৯৯৯ সালের ৬ জানুয়ারির ‍‘বিরোধী দলসমূহের ঘোষনা’।

এ ঘোষণায় স্বাক্ষর আছে খালেদা জিয়া ও এইচ এম এরশাদের। আরেকটি স্বাক্ষর ঠিক বোঝা যাচ্ছে না, সেটা কার ? আরেকটি কাগজ পেলাম। সেটা ১৯৯৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান চৌধুরীর লিখিত বক্তব্য।

বিস্ময়কর হলো- এ দুটি কাগজেই জাতীয় পার্টির অবস্থান বিরোধীদলে। কখনও তারা আওয়ামী লীগের সাথে লিয়াজোঁ করে বিএনপির বিরুদ্ধে (১৯৯১-৯৬), আবার কখনো যৌথ ইশতেহারে সই করে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বিএনপির সাথে (১৯৯৯-২০০১ )।

১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তিন দফায় সরকারের অংশীদার হয়েছে জাতীয় পার্টি। ১৯৯৬ সালে জাতীয় পার্টির মহাসচিব আনোয়ার হোসেন মঞ্জু হয়েছেন শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভার সদস্য, সুবিধা পেয়েছেন এরশাদ। কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন। আবার জাতীয় পার্টি দুইভাগ করে বিএনপির সাথে গাঁটছড়া বেঁধেছেন ১৯৯৯ সালে। মহাসচিব আনোয়ার হোসেন মঞ্জু মন্ত্রিত্ব ছাড়েননি বরং আলাদা জাতীয় পার্টি-জেপি গড়েছেন। এখনো আছেন মহাজোটের সরকারে।

এখনকার মন্ত্রিসভায় আছেন জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, আছেন জাপা নেতা মুজিবুল হক চুন্নু। আর গত দুই যুগে জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেত্রীর আসন ছিল হয় খালেদা জিযার অথবা শেখ হাসিনার, সেই আসন এখন রওশন এরশাদের করায়ত্ব। এইচ এম এরশাদ যেভাবে আ স ম রবকে ১৯৮৮ সালে বিরোধীদলীয় নেতা বানিয়েছিলেন, এবার সেভাবেই তার স্ত্রী ও জাপা প্রেসিডিয়াম সদস্য বিরোধীদলের নেতা হয়েছেন।

রাজনীতিটাই এমন যে, জামায়াতের হরতালের কারণে বিএনপি চেয়ারপারসন বাংলাদেশ সফরে আসা ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সাথে সাক্ষাত করেন নি। তিনিই আবার ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রী সুষমা স্বরাজের সাথে হোটেলে গিয়ে দেখা করেছেন। আর বিরোধীদলীয় নেতার প্রটোকল থাকায় সুষমা স্বরাজ রওশন এরশাদের সাথে দেখা করেছেন সংসদ ভবনে গিয়ে।

রাজনীতির এই উত্থান-পতন আর ডিগবাজির খেলায় এখন পরস্পরের বিরুদ্ধে বলছেন এইচ এম এরশাদ ও মীর্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

আমি অবশ্য ফিরে যেতে চাই পুরনো কাগজে। ১৯৯৯ সালের যৌথ ঘোষণায় ৩০ দিনের মধ্যে প্রধান নিবার্চন কমিশনারের পদত্যাগসহ চারটি দাবি মানার জন্য আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি আহবান জানানো হয়েছিল। ঘোষণায় বলা হয়েছিল, ‘গত আড়াই বছর এই ফ্যাসিবাদী সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে বিরোধী দলসমূহের সকল পযার্য়ের নেতা-কর্মীদের কারাবন্দী করেছে। ’

আরো পুরনো কাগজ ১৯৯৪ সালের মিজান চৌধুরীর লিখিত বক্তব্য। জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বিএনপি সরকারের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘রাজনীতির এই শ্বাসরুদ্ধকর কঠিন ক্রান্তিকাল থেকে উত্তরনের একমাত্র উপায় হচ্ছে অবিলম্বে সংসদ ভেঙ্গে দিয়ে সরকারের পদত্যাগ এবং একটি নিদর্লীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সাধারণ নিবার্চন করা’।

আমরা জানি, তখনকার প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এ দাবি মানেন নি।   ১৯৯৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর সংসদ থেকে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি এবং যাদের সমথর্নে বিএনপি সরকার গঠন করেছিল সেই জামায়াতের সংসদ সদস্যরা পদত্যাগ করার পরও সংসদ ভেঙ্গে দেননি। একদলীয় সংসদ চলেছে আরো ১৪ মাস। তারপর ১৫ ফেব্রুয়ারি বিতর্কিত এবং একতরফা নিবার্চনের পর অবশেষে বিএনপি সরকার গনআন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিল ১৯৯৬ সালের ৩০ মার্চ। প্রেসক্লাবের সামনে তখন জনতার মঞ্চ।

জাতীয় পার্টির সেদিনের সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি সরকার সম্পর্কে বলা হয়েছিল, ‘গত চারবছরে তাদের সীমাহীন দুনীর্তি বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের ওপর নিযার্তন, নিপীড়ন বিচার বিভাগ থেকে শুরু করে প্রশাসন দলীয়করন, অযোগ্যতা, অদক্ষতা, তথা সাবির্কভাবে দেশ পরিচালনায় তাদের ব্যার্থতার কারণে জনগণ যে তাদেরকে প্রত্যাখ্যান করেছে.......। ’

একইভাবে ১৯৯৯ সালে বিএনপি-জাতীয় পার্টির যৌথ ঘোষণায় আওয়ামী লীগ সরকারকে উদ্দেশ্য করা বলা হয় ‘.... দেশে আজ স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার পরিবেশ ধ্বংসের পথে এবং গণতন্ত্র এক চরম হুমকির সম্মুখীন হয়েছে”।

আসলে এসব উদাহরণ দিচ্ছি এ কারণে যে, সাবির্কভাবেই আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো তাদের পুরনো ঐতিহ্যের রাজনৈতিক ধারা থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না। এখন বরং লিখিত বক্তব্য কম। ২৪টি টেলিভিশনের মাইক্রোফোন সামনে থাকে, রাজনীতিবিদরা যাই বলছেন, বেশীরভাগ সময় কোনোরকম প্রশ্ন না তুলেই তা প্রচার করছি আমরা। সাথে আছে ‌‘সরাসরি সম্প্রচার’।

দেশের রাজনীতির মাঠে একই রকম বক্তৃতা চলছে আজো। দুই মেরুতে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি। গত দুই যুগের রাজনৈতিক পরিক্রমায় দেশের দুই প্রধান রাজনীতিক শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়ার মধ্যে ব্যবধান বেড়েছে আরো, কমেছে পতাকার সংখ্যা। ১৯৯১ সাল থেকে শুরু করে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের আগপযর্ন্ত আওয়াআমী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা এবং বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দুজনই হয় প্রধানমন্ত্রী অথবা সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা। দুজনের গাড়ীতেই জাতীয় পতাকা কমন ছিল। ক্ষমতায় থাকা না থাকার ওপর নির্ভর করতো প্রধানমন্ত্রীর পতাকা অথবা দলীয় পতাকা কোনটা লাগানো হবে। সেদিন দেখলাম বিএনপি চেয়ারপারসন শুধু দলীয় পতাকা গাড়িতে উড়িয়ে গেলেন দুর্নীতি মামলার হাজিরা দিতে।

জাতীয় পার্টিই বরং আছে অন্যরকম এক আরামের জায়গায়। এখন বিরোধীদলীয় নেত্রী রওশন এরশাদের গাড়িতে উড়ে জাতীয় পতাকা। যুবলীগ কর্পোরেট কালচারে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন করে, নূর হোসেন দিবস নিয়ে তাদের কোনো আগ্রহ নেই। বরং বিবৃতি দেন এরশাদ।

আর রাডার কেনার দুনীর্তি এবং মঞ্জুর হত্যা মামলায় এখন এইচ এম এরশাদ আদালতে হাজিরা দিতে যান জাতীয় পতাকা উড়িয়ে মন্ত্রীর পদমযার্দা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হিসেবে। কোন দেশে কি দূতিয়ালী করছেন তা নিয়ে অবশ্য তেমন কোনো সংবাদ নেই গণমাধ্যমে।  

পুরনো কাগজের বর্তমান প্রাসঙ্গিতায় শেষ করতে চাই এই লেখা। জোটের শরিকদল জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আজমের জানাজায় না যাওয়া এবং আনুষ্ঠানিক শোক প্রকাশ না করায় ক্ষুব্ধ হয়েছেন তার ছেলে অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আজমী। তিনি দম্ভের সাথেই বলেছেন, জামায়াতের সমর্থন ছাড়া বিএনপি ক্ষমতায় যেতে পারবে না। হয়তো এটা তার ব্যক্তিগত মত। কিন্তু দেখি জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান চৌধুরী ১৯৯৪ সালেই তেমন মূল্যায়ন করেছিলেন বিএনপি সম্পর্কে। তিনি বলেছিলেন ‘বিএনপি জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত সরকার নয়, জামায়াতে ইসলামীর সমর্থনপুষ্ট একটি টেকনিক্যাল সরকার। সেদিন (১৯৯১) জামায়াত যদি বিএনপিকে সরকার গঠনে সমর্থন না দিতো তাহলে দেশের ইতিহাস অন্যভাবে লিখিত হতো। ’

১৯৯৬ সালের নিবার্চনের আগেই জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামী সংসদ ভবনের সংবাদ সম্মেলনে বিরোধীদলীয় নেতা আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার পাশে নিজের জায়গা করে নিয়েছিলেন। আর সেকথা ভুলে খালেদা জিয়া নিজের মন্ত্রিসভায় ঠাই দিয়েছিলেন শুধু নিজামীকেই নয়, জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুজাহিদকেও।

এখন আবার জামায়াত-বিএনপির মধ্যেও একটি অঘোষিত টানাপড়েন দেখছি। আর মিলিয়ে দেখছি, বিগত দিনের রাজনীতির সাথে বর্তমান রাজনীতির উত্থান-পতন। কোন দল কার সাথে গাঁটছড়া বাধবে, ক্ষমতায় যাবে, গাছের খাবে, তলারটা কুড়োবে- নেতারাই তার সিদ্ধান্ত নেবেন।   আর জনগণ সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদে যাদেরকে সকল ক্ষমতার উৎস বলা হয়েছে তারা কি করবেন?   

প্রণব সাহা: এডিটর আউটপুট, এটিএন নিউজ, [email protected]

বাংলাদেশ সময়: ১৮২৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৫, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।