ঢাকা, রবিবার, ১৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

সবাই যেন এর কঠোর নিন্দা করতে পারি ।। হাসান মামুন

... | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৪৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৫, ২০১৪
সবাই যেন এর কঠোর নিন্দা করতে পারি ।। হাসান মামুন

অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ কেন ওভাবে আক্রান্ত হলেন, এটা আমরা কেউ বলতে পারছি না। বিএনপি নেত্রী অবশ্য চটজলদি বলে দিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশেই চালানো হয়েছে এ হামলা।

এটাও বলেছেন, এজন্য দায়ীদের ধরা না হলে বোঝা যাবে তিনি বা তারা রয়েছেন এর নেপথ্যে।

লক্ষণীয়, ড. মাহবুব উল্লাহ তেমন কিছু বলেননি। বরং বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছেন, কোনো ব্যক্তি বা দলকে আক্রমণ করে তিনি কখনো কিছু বলেন না। ঘটনার জন্য দায়ীদের বিচার চেয়েছেন তিনি। এটাও বলেছেন যে, এভাবে চলতে থাকলে দেশে কোনো ভদ্রলোকের পক্ষে বাস করা অসম্ভব।

হালে বিএনপিপন্থী হলেও মাহবুব উল্লাহ একদা তুখোড় বাম বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। বামপন্থী থেকে অনেকেই বিএনপিপন্থী হয়েছেন। আওয়ামীপন্থীও কম হননি। ধর্মীয় রাজনৈতিক ধারার অনুসারীও হয়েছেন কেউ কেউ। এতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। মানুষের রাজনৈতিক মত বা অবস্থান বদলাতেই পারে। না বদলানোই বরং কিছুটা অস্বাভাবিক। বিশ্বের অন্যান্য দেশেও বামপন্থীদের অবস্থানে নানা রকম বদল দেখা গেছে।

ড. মাহবুব উল্লাহকে তাই আলাদাভাবে দোষ দেয়া যাবে না। আর রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে কেউ কোনোভাবে আক্রান্ত হওয়ার কথা তো চিন্তাই করা যায় না। আমরা অবশ্য জানি না, ঠিক কী কারণে তিনি আক্রান্ত হয়েছেন বা কারা ওই ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়েছে। ঘটনা ঘটে যাওয়ার একদিন পরও ওই বিষয়ে দায়েরকৃত মামলায় কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি। সুপ্রিমকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এ বিষয়ে কড়া অভিযোগ তুলেছেন। ঘটনার পরদিন বিএনপিকে অবশ্য আর তেমন উচ্চবাচ্য করতে দেখিনি।

বিএনপির মধ্যে একটা হতাশা আর অস্থিরতা চলছে বলেই মনে হয়। কোনো ইস্যুতেই তারা স্থির থাকছেন না। ‘জনগণের সমস্যা’ নিয়ে জোরালো কোনো বক্তব্য দিচ্ছেন না বলেও অভিযোগ রয়েছে। এ অবস্থায় তাদের সমর্থক এক বুদ্ধিজীবী আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা দলটির কাছে গুরুত্ব না পেলে অবাক হওয়া যাবে না। ড. মাহবুব উল্লাহও হয়তো বেশি কিছু প্রত্যাশা করবেন না।

বর্তমান শাসনামলে বিএনপির কিছুসংখক নেতা গুম হয়েছেন। তাদের বিষয়েও দলটি তেমন কঠোর অবস্থান নিতে পারছে না। ড. মাহবুব উল্লাহ তো তার সমর্থক বুদ্ধিজীবী মাত্র। তিনি তেমন সোচ্চারও নন। তার চেয়ে দলবাজ বুদ্ধিজীবী বিএনপির রয়েছে। এদের কেউ আক্রান্ত না হয়ে মাহবুব উল্লাহ কেন হলেন, সেটি অবশ্য ভেবে দেখার বিষয়। কথায় বলে, ‘নরম মাটি কোপাতে মজা’। এটিও ঘটে— ভদ্র গোছের কাউকে আক্রমণ করে বুঝিয়ে দেয়ার চেষ্টা হয় বাকিদের।

বিএনপি-জামায়াত শাসনামলে সাবেক অর্থমন্ত্রী শামস কিবরিয়ার ওপর গ্রেনেড হামলা চালিয়ে তাকে হত্যা করা হয়েছিল। আওয়ামী লীগ থেকে তখন বলা হয়েছিল, এটি হল দলের বাকিদের মনে ভয় ধরিয়ে দেয়ার চেষ্টা। সেই তুলনায় মাহবুব উল্লাহর ওপর হামলার ঘটনা সামান্য বৈকি। তবে ‘সামান্য’ এ ঘটনাও বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবীদের জন্য হতে পারে অসামান্য বার্তা।

এক্ষেত্রে ভিন্ন সম্ভাবনার কথাও বলা হচ্ছে ড. মাহবুব উল্লাহ বা বিএনপির বিরোধী পক্ষ থেকে। সেটি হল, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদের বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে ‘বিতর্কিত’ বক্তব্য দেয়ায় বিএনপির একদল কর্মীই মাহবুব উল্লাহর ওপর আঘাত হেনে কেটে পড়েছে। তাহলে তো সরকারের উচিত ওই হামলাকারীদের ধরে প্রকৃত ঘটনা সবাইকে জানানো। ২০০১-পরবর্তী শাসনামলে আওয়ামী লীগের ওপর সংঘটিত ভয়ঙ্কর কিছু ঘটনার উপযুক্ত তদন্ত না করে বলা হয়েছিল, এটি তাদের দ্বারাই সংঘটিত! ড. মাহবুব উল্লাহর ওপর হামলার ঘটনায়ও তেমনটি বলা বা করে দেখানো হতে পারে।

মুশকিল হল, এমন একটি ঘটনার সঠিক তদন্ত হবে বলে আশাও করতে পারছি না। এটাও দেখতে পাচ্ছি, সরকারপন্থী বুদ্ধিজীবী বলে পরিচিতরা এর নিন্দা না করে এবং বিচার না চেয়ে নিশ্চুপ রয়েছেন। বিএনপি-জামায়াত আমলেও এমনটি ঘটেছিল। আওয়ামীপন্থী বুদ্ধিজীবী এবং সেক্যুলার বলে পরিচিত একাধিক লেখক তখন আক্রান্ত হন। ড. হুমায়ূন আজাদ তো মারাই গেলেন শেষ পর্যন্ত। এর কোনোটারই ন্যায্য প্রতিবিধান হয়নি এখনও। এগুলো আমাদের আর মনে হয় বিস্মিতও করছে না।

আমরা যেন ধরেই নিয়েছি, এমনি ধারার ঘটনা ঘটতে থাকবে। ভিন্নমতাবলম্বী বা প্রতিপক্ষ দলের বুদ্ধিজীবীদের বরং সতর্কভাবে থাকতে হবে। ড. মাহবুব উল্লাহ্ দৃশ্যতই সতর্ক ছিলেন না। তিনি বোধহয় নিরাপদ ভেবেছিলেন নিজেকে। তার কি তবে উচিত ছিল লোকজন নিয়ে চলাফেরা করা? এমনটি দেখেও আমরা কিন্তু বলে যাব ‘জ্ঞানভিত্তিক সমাজ’ গঠনে বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার কথা!

ড. মাহবুব উল্লাহর মতো জ্ঞানী ব্যক্তি কেন একটি ব্যক্তি ও গোষ্ঠীতান্ত্রিক দলের বুদ্ধিজীবী হবেন, এ নিয়ে দুঃখ রয়েছে। তা সত্ত্বেও বলতে কি পারি, এ অধিকার তার নেই? বাংলাদেশের প্রথম সরকারের আমলে প্রণীত বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশেই তো এর শিক্ষকদের এমনকি সরাসরি রাজনীতির সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। ড. মাহবুব উল্লাহ অবশ্য তা গ্রহণ না করলেও পারতেন। ‘সুশীল’ থাকতে পারতেন তিনি। তাহলেও কি নিরাপদ থাকতেন গালমন্দের শিকার ও আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থেকে?

আমি ক্ষুদ্র এক সাংবাদিক ও কলামিস্ট। ভাগাভাগির মধ্যে ফেলা হলে অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহর গোত্রে পড়ব বলে মনে হয় না। তা সত্ত্বেও তাকে আক্রমণ ও লাঞ্ছিত করার ঘটনায় আমি ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ। এটি (কারও কারও মতে) অন্য ধরনের ঘটনা হলেও দেশের এক বিশিষ্ট ব্যক্তি যখন এইভাবে আক্রান্ত হয়ে পড়েন, তখন বিবেকবান মাত্রই পীড়িত বোধ করি। অতীতের ঘটনাগুলোও তখন মনে পড়ে যায় আর আমরা বিপন্ন বোধ করতে থাকি সমষ্টিগতভাবে।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট



বাংলাদেশ সময় : ১৩৪৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৫, ২০১৪, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।