ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

চাঁদ তুমি ফিরে যাও!

ফারুক ওয়াহিদ, ক্যানেটিকাট যুক্তরাষ্ট্র থেকে | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৪৯ ঘণ্টা, জুলাই ২৭, ২০১৪
চাঁদ তুমি ফিরে যাও!

চাঁদ তুমি ফিরে যাও … দেখো মানুষের খুনে খুনে রক্তিম বাংলা, রূপালি আঁচল রাখবে কোথায় বলো! -হ্যাঁ শাওয়ালের খুশির ঈদের রূপালি বাঁকা চাঁদকে এভাবেই ফিরে যেতে বলেছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী শব্দ সৈনিক রূপা ফরহাদ।

চাঁদ রাতে এবং ঈদুল ফিতরের দিন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে সারাদিন ধরে বেজে উঠেছিল অত্যন্ত আবেগময় এ গানটি- যা’ শুনে সেদিন চোখে পানি ধরে রাখতে পারিনি।

সেই অগ্রহায়ণে হেমন্তের ঈদুল ফিতরের কান্নার দিনটি ছিল ১৯৭১-এর ২০ নভেম্বর শনিবার-পাকিস্তানি হানাদারদের অত্যাচার আর নিপীড়নে বিপর্যস্ত সারা বাংলা।

স্বাধীনতার জন্যে পাকিস্তানি নরপশুদের সঙ্গে লড়াই করছে বীর বাঙালি- পাকিস্তানি ঘৃণিত সেনাবাহিনী ও তাদের নরাধম দোসর রাজাকার-আলবদর, আলশামস, আল মুজাহিদ বাহিনী বাঙালির ওপর চালিয়ে যাচ্ছে নির্মম নির্যাতন। সেই মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বর্ষপুঞ্জির স্বাভাবিক নিয়মে বাঙালির জীবনে একটি অনাকাঙ্ক্ষিত অপ্রত্যাশিত ঈদ এসেছিল- যে ঈদের চাঁদ ছিল বেদনার্ত নীল রংয়ের-এরকম বেদনার্ত ঈদের চাঁদ বাংলার মানুষ কখনো দেখেনি। সেদিন আমি যুদ্ধে ছিলাম। সামনে বড় আকারের চার পকেটওয়ালা শার্টের পকেটে গ্রেনেড এবং গুলির ম্যাগজিন-মাথায় সবুজ রংয়ের হেলমেট এবং কাঁধে ঈদের চাঁদের মতো চকচকে বেয়োনেটসহ রাইফেল। পায়ে জলপাই রংয়ের জঙ্গলবুট- কতদিনের তেল না দেওয়া উস্কো-শুস্কো চুল- ঠিক এ অবস্থাতেই মেঘনা-তিতাসের শাখা ডোলভাঙা নদীর তীরে ঈদের নামাজে শরিক হয়েছি- কিন্তু চোখ ছিল নদীর দিকে- কারণ ঈদের দিনেও হানাদার পাকিস্তানিরা গানবোট নিয়ে হামলা করতে পারে।
Filistiny_
এ কেমন ঈদ! ঈদ অর্থ খুশি- কিন্তু ঈদের দিন চোখে পানি কেন! তাহলে কি ঈদ অর্থ কান্না! আর মা-বাবা, ভাই-বোন থেকে আজ ঈদের দিন আমি বিচ্ছিন্ন কেন? ঢাকায় তারা কেমন আছেন- কোথায় আছেন- তারা কি বেঁচে আছেন? কিছুই জানি না। এ কেমন ঈদ! বাংলার মানুষ কি ভুলে গেছে একাত্তরের সেই নীল চাঁদ উঠা বেদনার্ত ঈদের কথা!

একাত্তরের মতো ফিলিস্তিন ভূখণ্ডেও আজ নীল বাঁকা ঈদের চাঁদ উঠেছে- বেদনার্ত ঈদ এসেছে- গাজা উপত্যকায় ইসরাইলের হামলা ও বর্বরতার শিকার হচ্ছে নিরীহ মানুষ বিশেষ করে শিশু-মহিলারা। ফিলিস্তিনিদের পক্ষে মুখ খুলে কথা বলছে না কেউ- অথচ মুক্তিযুদ্ধে ফিলিস্তিনের জনগণ বাংলাদেশের পক্ষে ছিল- পিএলও তথা ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফাত ছিলেন বঙ্গবন্ধুর অন্তরঙ্গ বন্ধু। ফিলিস্তিনে ইসরাইলের বর্বরতার সঙ্গে একাত্তরে বাংলাদেশে পাকিস্তানি বর্বরতার অনেক মিল রয়েছে।

বিশ্বের মুসলিম দেশেগুলো ইসরাইরের এ বর্বরতা বা হামলার জন্য চুপ কেন? ওআইসি বা মুসলিম বিশ্ব এর প্রতিবাদ করছে না। একাত্তরে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সময়ও পাকিস্তানি বর্বরতার বিরুদ্ধে আরব বিশ্বের জনগণ বাংলাদেশের পক্ষে থাকলেও সেদেশের সরকারগুলো ছিল চুপ।
Filistiny_2
আজ ২০১৪ সালের শাওয়ালের ঈদের চাঁদ দেখে মনে হচ্ছে এযেন একাত্তরের বাংলার সেই বেদনার্ত নীল বাঁকা চাঁদ আবার ফিরে এসেছে- ঈদের দিন একাত্তরের মতো বলতে ইচ্ছে হচ্ছে ‘চাঁদ তুমি ফিরে যাও!’

১৯৪৮ সালে প্যালেস্টাইন দখল করে ইসরাইলী রাষ্ট্র গঠনের ঘোষণার পর থেকে এ অঞ্চলের মুক্তিকামী মানুষকে যেভাবে তাদের ভিটেমাটি ছাড়া করা হচ্ছে, যেভাবে হত্যা, নির্যাতন, লাঞ্ছনা প্রাত্যহিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে- বিশ্বের ইতিহাসে বাঙালি এবং ফিলিস্তিনি জনগণ ছাড়া অন্য কোনো জাতিকে এতো দীর্ঘ সময় এ দুর্যোগ-দুর্ভোগের মধ্যে পড়তে হয়নি।

সেই একাত্তরের বাংলাদেশ ২০১৪-তে এসে সবাই এখন নানা আয়োজনে ঈদ উৎসবের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সম্প্রতি পত্রপত্রিকায় খবর বেরিয়েছে ৫৫ হাজার কোটি টাকার ঈদ উৎসবে মেতে উঠেছে সমগ্র বাংলাদেশ এবং লাখের অধিক লোক ঈদের শপিং করতে গেছেন দেশের বাইরে।
Filistiny_3
জানা গেছে, এবারের ঈদে ২২ হাজার ৩০০ কোটি টাকা বাজারে ছাড়ার পরিকল্পনা রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের- এর মধ্যে ১২ হাজার কোটি টাকাই নতুন নোট। এতে আমি আনন্দিত এই ভেবে যে যদি দেশ স্বাধীন না হতো তাহলে কি এটা সম্ভব হতো? তবে আরো আনন্দিত হতাম যদি আমরা এই ঈদের আনন্দ ষোলো কোটি লোক ভাগ করে নিতাম। স্বাধীনতার সুফল বা ঈদের আনন্দ কেউ একচেটিয়া ভোগ করুক বা লুফে নেক এটাতো হতে পারে না- এর জন্যতো আমরা একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ করিনি। ভবিষ্যতে যদি আমরা ঈদের আনন্দ ষোলো কোটি লোক ভাগ করে নিতে না পারি- তাহলে আবারো বলবো ‘চাঁদ তুমি ফিরে যাও!’ 

একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে আমরা ঈদের আনন্দ উপভোগ করছি। স্বাধীনতার জন্যে ত্রিশ লাখ শহীদ, চার লক্ষাধিক মা-বোন সম্ভ্রম হারিয়েছিল- আর কোটি কোটি শরণার্থীর মিছিলে একাত্তরেও নেমে এসেছিলো ঈদুল ফিতর। স্বাধীন রাষ্ট্রে আমরা যখন ঈদ উদযাপন করি, তখন কি একবারের জন্য মনে পড়ে সেই একাত্তরের ঈদুল ফিতরের কথা। আর ভুলে যাওয়ারই কথা- কারণ বাঙালি আত্মবিস্মৃত জাতি- তাই এতে অবাক হওয়ার কিছুই নেই।

মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বারবার বেজে উঠতো- ‘মোরা সারা বিশ্বের শান্তি বাঁচাতে আজকে লড়ি। ’ ৫৫ হাজার কোটি টাকার ঈদ উৎসবে মেতে উঠা সমগ্র বাংলাদেশ ঈদের আনন্দে সব ভুলে গিয়েছে!
Filistiny_
একাত্তরের মতো ফিলিস্তিনেও বেদনার্ত ঈদ এসেছে- একাত্তরের ঈদের কথা স্মরণ করে আমাদের ফিলিস্তিনি ভাই-বোন ও শিশুদের জন্য কি কিছুই করার নেই? একাত্তরের ঈদে রূপা ফরহাদ সবাইকে কাঁদিয়ে ছিলেন- ফিলিস্তিনিদের বেদনার্ত ঈদ দেখে স্বাধীন বাংলাদেশে ৫৫ হাজার কোটি টাকার ঈদ উৎসবে মেতে উঠার দেশে রূপা ফরহাদ-দের কি এখনো সময় হয়নি নতুন করে গানটি গাওয়ার জন্য-‘চাঁদ তুমি ফিরে যাও/ ফিরে যাও, ফিরে যাও, ফিরে যাও/ চাঁদ তুমি ফিরে যাও/ দেখো বাংলার ফিলিস্তিনের মানুষের হাহাকার!’

লেখক: যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী লেখক, মুক্তিযোদ্ধা


বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।