ঢাকা, বুধবার, ১৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

ল লাইক লাভ

এস.এম মাসুম বিল্লাহ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১১৭ ঘণ্টা, জুন ১১, ২০১৪
ল লাইক লাভ ছবি: প্রতীকী

তখন সবে আইনবিজ্ঞানের পাঠ নিচ্ছি। আইনের তত্ত্বের মারপ্যাঁচে মাথা খারাপ হবার যোগাড়।

দেখি এক বাগানে পানি দিচ্ছে মালি। তাকে জিজ্ঞেস করি, বলতে পারবেন আইন মানে কী? সূর্যের বিপরীতে হাত দিয়ে মুখ সুরক্ষা করে মালি বলল, মামা, আইন হলো রোদের মতো! প্রাকৃতিক! মানতেই হবে। রোদ হওয়া না হওয়ার ওপর বাগানের পরিচর্যার ধরন নির্ভর করে। পরে বুঝেছি মালি যে কথা বলেছিল, সেটাই হুগো গ্রসিয়াসের ন্যাচারাল ‘ল থিওরি’!

একদিন শাহবাগে কিছু সঞ্জীবিত মানুষ জড়ো হলো। কিছু বৃদ্ধ বিড়বিড় করে গালমন্দ করলেন। উদ্দীপ্ত মানুষগুলোর শ্লোগানে বৃদ্ধদের দুর্বল কথা হারিয়ে গেল। আইন পরিবর্তিত হয়ে অপরাধীদের বিচারের পথ উন্মুক্ত হলো। বুঝলাম আইন হলো নতুন-পুরাতনের দ্বন্দ্ব। সবুজের অভিযান’। তারুণ্যের ইচ্ছাশক্তি— ল’ ইজ দ্য সেন্সেস অব দ্য ইয়ং!

‘মোল্লা-পুরুতরা’ তা চেয়ে দেখবেন কেন? তারা বললেন, কিতাবের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। আইন হলো ধর্মীয় মতবাদ, বিশ্বাস, ভজনালয়। আইন হলো ‘বেলাল্লাপনা’র বিরুদ্ধে ওয়াজ!

বিচারকবৃন্দ নাকের চশমার নীচ দিয়ে তাকালেন। তারা বললেন, আইন কি তাতো আপনারা জানেন। এবং আদালত ইতোমধ্যে রাষ্ট্র বনাম মিস হোয়াট হার নেম’ মামলায় বিষয়টা সাব্যস্ত করে দিয়েছেন। বুঝেন নাই? তাহলে খোলসা করেই বলি ‘আইন হলো আইন’!

টকশোতে হাজির নিরপেক্ষ ভাবমূর্তির আইনচিন্তক। তিনি উপস্থাপককে ধন্যবাদ দিয়ে শুরু করেন, দেখুন, ঠিক-বেঠিক দিয়ে আইনের চেহারা ধরতে পারবেন না। এটা একটা সামাজিক মানস। সমাজে কত আপরাধ হলো তা প্রকাশের সূচক। তবে অপরাধের ধরনের একটা কালচারাল ‘রিলেটিভিটি’ আছে। নৈতিকতার যোগ আছে। অনেকটা পিন্দনের কাপড়ের মত। শুভ সকাল, গুড মর্নিং-এর মতো। বিভিন্ন সংস্কৃতিতে বিভিন্ন। যেমন অনেক দেশে অপাংক্তেয় মানুষ গুম হওয়া ব্যাপার না, লঞ্চ ডুবে মানুষ মরা অদৃষ্টতা, আবার অনেক দেশে একটা বিড়াল ঝড়ের কবলে পড়ে গাছে আটকে কেন মারা গেল তারও তদন্ত হয়।

চায়ের দোকানে টকশো দেখতে থাকা মানুষগুলোর একজন আফসোস ও খেদ নিয়ে বলে, বুঝলেন, সবই ভাগ্য, দ্যাশের রাজা যে তার কথাই আইন। পাশে বসে থাকা প্রৌঢ় চায়ে আরেকটু চিনির ফরমায়েশ দিয়ে মুখ খিস্তি করে বলে ওঠেন, বিচার (আইন) নাইরে ভাই। আইনের মা কবে মারা গ্যাছে। মুরব্বির মান নাই, গাছে ফল নাই, নলকূপে পানি নাই, মরিচে ঝাল নাই’। সামনে কর্তব্যরত চা-ছোকড়া কেটলি থেকে কাপে চা ঢালতে ঢালতে বলে ওঠে, আইন ঠিকই আছেরে ভাই, আইন হচ্ছে বড়লোকদের জন্য, ও তোমার আমার জন্য না’।

পাশ দিয়ে শ্রমিকদের মিছিল যেতে থাকে। একজন রিকশাওয়ালা সিগরেটে টান দিয়ে বলে, শ্রমিকদের ঘামের দাম না দিলে সুবিচার হয় না’।

টিভিতে ততক্ষণে খবর শুরু হয়েছে। মন্ত্রীমহোদয় ধান ভানার উৎসবে শীবের গান গাইছেন, আমরা সাংবিধানিকভাবে পাঁচবছরের জন্য নির্বাচিত। জনগণের মঙ্গলের জন্যই আমরা সবকিছু করছি। আইনের বাইরে আমরা যেতে পারি না। অবশ্য চা খেতে থাকা মানুষরা ধাক্কা খায় একটু পরে। সমর্থক পরিবেষ্টিত একজন নেতা টিভি মাইকে জোর গলায় বলতে থাকেন, এটি আমার এলাকা। এখানে আমার কথার বাইরে কিছু হতে দেবো না। ’

উপরের ধারণাগুলোর বাইরে আমার বা আমাদের আইন সম্পর্কে নতুন কোনো ধারণা নেই। আমরা শুধু জানি আইন আছে। কিন্তু তা আমরা দেখতে পাই না। পড়া যায়, অনুভব করা যায়, মানেও পাওয়া যায় হয়তো ছাড়া ছাড়া, কিন্তু বোঝা যায় না । তবে একটা বিষয় পরিষ্কার, আসলে যার যার পক্ষপাত বা স্বার্থপরতা তার আইনের ধারণাকে তারই মতো আকার দেয়।

পদ হারিয়ে অনিশ্চিত অবস্থায় পতিত হওয়ার শঙ্কা নতুন আইনের জন্ম দেয়। এটাকে আপনি কিসের সঙ্গে তুলনা করবেন? ক্ষীণকণ্ঠ ভালবাসার’ সঙ্গে? অবাক হচ্ছেন? আইন ও ভালবাসা একসঙ্গে যায় নাকি? আইনের মতোই ভালবাসার উৎস অজানা। না হলে আমরা কেন গাইবো যে,  প্রেম স্বর্গ থেকে এসে জীবনে অমর হয়ে রয়!

আইনের মতই ভালবাসা দরকারি কিন্তু বেদনা উদ্রেককারী। না হলে আমরা কেন গাইবো— প্রেম কখনও মধুর, কখনও সে বেদনা বিধূর, কখনও সে দূর বহুদূর। কম মানুষই আইন ও ভালবাসার বাইরে যেতে পারে। কিন্তু কম মানুষই মানে! তেত্রিশ কিংবা তেতাল্লিশ বছর হলেও কেউ কথা রাখে না!

পূনশ্চঃ ইংরেজ কবি ডব্লিউ.এইচ. অডেন ‘ল লাইক লাভ’ নামে একটা কবিতা লেখেন ১৯৩৯ সনে। আমি যা লিখলাম তা অডেনের কবিতার ছায়া। অডেন কি ভীষণভাবে এখনকার বাংলাদেশে প্রাসঙ্গিক। ভালবাসা সম্পর্কে অডেনকে নৈরাশ্যবাদী শোনালেও হয়তো সবাই একমত হবেন যে, বাংলাদেশের এখনকার সংকট ভালবাসাহীনতার, দরদহীনতার, মনুষ্যত্বের প্রতি মর্যাদা বোধের অভাবের। মনুষ্যত্বহীনতাই আইনহীনতা।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে ভিক্টোরিয়া ইউনিভারসিটি অব ওয়েলিংটনে উচ্চশিক্ষারত।

বাংলাদেশ সময় ১১১২ ঘণ্টা, জুন ১১, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।