বাড়বাড়ন্তের বাজারে নতুন যোগ সয়াবিন তেল। প্রতি লিটারে বেড়েছে আরো আট টাকা।
বাণিজ্য উপদেষ্টা সেখ বশির উদ্দিন ভোজ্য তেল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠকের পর এই দাম ঘোষণা করেছেন। বলেছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম ২০ শতাংশ বেড়েছে। এর ফলে স্থানীয় ছোট ব্যবসায়ীরা মজুদদারি করেছে। সামনে দাম আরো বাড়বে—এমন উদ্বেগের পরিপ্রেক্ষিতে এই মজুদদারি হয়েছে।
তাই সয়াবিন তেলের নতুন এই দাম ধরে দেওয়া হয়েছে। ভোজ্য তেলের দামে লাগাম টানতে অন্তর্বর্তী সরকার দুই দফায় আমদানি শুল্ক-কর কমালেও এর সুফল মেলেনি। প্রতি কেজি ভোজ্য তেল আমদানিতে শুল্ক-কর ১০ থেকে ১১ টাকা কমালেও আমদানি বাড়েনি। বরং সংকট তৈরি হয়েছে।
শেষে গত সোমবার সয়াবিন তেলের দাম উল্টো লিটারপ্রতি আরো আট টাকা বাড়ানো হয়েছে।
আলুতে চূড়ান্ত অস্থিরতার কথাও স্বীকার করেছেন তিনি। চাল, ডিম, চিনি, পোলট্রি মুরগির বাজার স্বাভাবিক দাবি করেন বাণিজ্য উপদেষ্টা সেখ বশির উদ্দিন। পণ্য বলতে সচরাচর খাদ্যপণ্যকেই বোঝার একটা প্রবণতা রয়েছে। চিকিৎসা, ওষুধ-পথ্য, গাড়িভাড়া-বাড়িভাড়া, শিক্ষা উপকরণসহ আরো কত নিত্য খরচের বিষয় আলোচনার বাইরেই থেকে যাচ্ছে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতির তোড়ের কারণে।
খাদ্যপণ্যের গুরুচরণ দশা এই সরকার উত্তরাধিকারসূত্রেই পেয়েছে সত্য। লাগাম টানার যারপরনাই চেষ্টাও করছে। কিন্তু সেই দৃষ্টে ফল নেই। বরং মুখ ভেংচানোর মতো বাজার চড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। এতে কমবেশি আক্রান্ত সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। মাথাপিছু আয়ের অঙ্ক ভুলে মাথার সামনে তারা দেখছে টিসিবির ট্রাক। মাস্কে মুখ ঢেকে মধ্যবিত্তরাও লাইন ধরছে সেখানে।
বিগত সরকারের লুটতরাজ, পাচার, দুর্নীতিতে বাজারের এই অবস্থা বা মূল্যস্ফীতি বাড়ছে সত্য হলেও এসব কথা শুনতে শুনতে কাহিল অবস্থা মানুষের। তারা মাগনা বা ফ্রি কিছু চায় না। কন্ট্রোল রেটেও চায় না। চায় সাধ্যের মধ্যে কেনাকাটায় জীবন নির্বাহ করতে। সেখানেই চরম খরার টান। আর আঙুল দেখায় চার মাসের সরকারের দিকে। বাস্তবটা সরকারের জন্য বড় নিদারুণ। গেল সাড়ে ১৫ বছর দেশে চলা অকল্পনীয় লুটপাটের জেরে অর্থনীতির ক্ষত শিগগিরই শুকাবে না—অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের এই বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত-ভিন্নমত কেউ করছেন না। কিন্তু প্রশ্ন ঘুরছে, মূল্যস্ফীতির লাগামে কি টান দেওয়া সম্ভবই না? সম্ভব না হয়ে থাকলে শ্রীলঙ্কা পেরেছে কিভাবে? শ্রীলঙ্কায় মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৭০ শতাংশে গিয়ে পৌঁছেছিল। এখন তা মাইনাস ৫ শতাংশ। তাদের শেয়ারবাজারের ইনডেক্স বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। তারা পারলে আমরা পারছি না কেন? তারা সরকার পরিচালনাকে প্রশাসনিক কাজের চেয়ে বেশি ভেবেছে ব্যবস্থাপনার কাজ হিসেবে। সেই ব্যবস্থাপনার সারথি করেছে দেশটির ব্যবসায়ীদের। কিন্তু আমাদের এখানে বাস্তবতা একেবারে ভিন্ন। নানা কাজে ও আচরণে বিজনেস কমিউনিটিকে প্রতিপক্ষ করে ফেলা হচ্ছে।
ব্যবসায়ীরা এর মাঝে কিছুটা দেড় যুগ আগে এক-এগারো পটপরিবর্তন পরবর্তী ছাপ দেখছেন। ওই সময় দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ীদের ধরে আটকে রাখা, অনৈতিকভাবে অর্থ হাতিয়ে নেওয়া এবং ব্যাবসায়িক পরিবেশ বিপন্ন করে দেশের ঘাড়ে বেকারত্বের বোঝা বাড়িয়ে দেওয়ার দুঃসহ স্মৃতি এখনো তাদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। ৫ আগস্ট স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিপুলসংখ্যক ব্যবসায়ীর নামে হত্যা মামলাসহ নানা হয়রানি সেই ঘায়ে টোকা দিচ্ছে, যা তাদের জন্য পূর্ণিমা-অমাবস্যায় পুরনো ব্যথা-যন্ত্রণা চাগাড় দেওয়ার মতো। ড. ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২১৬ জন বড় শিল্পোদ্যোক্তা ও রাজনীতিককে কারাগারে আটক রাখা হয়। সে সময় ব্যবসায়ীদের জরিমানার নামে শুধু হয়রানি নয়, শারীরিক-মানসিক নির্যাতনও করা হয়েছে। জোর করে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে এক হাজার ২৩২ কোটি টাকা। এক-এগারোর পর ১৭-১৮ বছরেও সেই টাকা ফেরত পাননি ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা। সেই ধকল এখনো টানতে হচ্ছে। ব্যবসায়ীদের একটা প্রত্যাশা ছিল, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ দিকে নানা কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যে চেপে বসা স্থবিরতা একটু একটু করে কাটানোর ব্যবস্থা হবে। বাস্তবে হয়েছে বিপরীত। শিল্প-কারখানায় হামলা-ভাঙচুর, ব্যবসায়ীদের নামে হত্যা মামলার আপদ নেমেছে। এ দেশে বরাবরই কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া প্রায় সব শিল্পঋণ ঝুঁকিপূর্ণ। ব্যাংকগুলো স্বল্প মেয়াদে ঋণ নেয় তিন থেকে পাঁচ বছরের হিসাবে। এর বিপরীতে শিল্পঋণের মেয়াদকাল ১৫-২০ বছর হয়। যথাযথভাবে জামানত নেওয়া সম্ভব হয় না। তা ছাড়া ঋণ দেওয়া-নেওয়ার কালে বড় অঙ্কের অবৈধ অর্থের লেনদেন হয়। এরাই ইচ্ছাকৃত খেলাপি হয়।
ইচ্ছাকৃত ছাড়াও ব্যাবসায়িক মন্দা, বিভিন্ন প্রতিকূল অবস্থা, সরকারের অসামঞ্জস্যপূর্ণ নীতির কারণে অনেকে খেলাপি হয়। এর বিপরীতে ক্ষুদ্র ও মাইক্রো লেভেলের শিল্প ব্যবসায় ঋণ আদায়ের হার ৯৮ শতাংশের ওপরে। শিল্পঋণের বিকল্প হতে পারত ভাইব্র্যান্ট ক্যাপিটাল মার্কেট গঠন। পৃথিবীর সব দেশ যে কারণে এমন শেয়ার মার্কেট গঠনে উদ্যোগী হয়। শ্রীলঙ্কা এটা বুঝেছিল। তাই অর্থনীতির চেহারা ফেরাতে তাদের বেশি সময় লাগেনি। আর এখানে ১৮ লাখ বিনিয়োগকারীর ৭০-৮০ শতাংশ পুঁজিই হাওয়া। যার কারণে পুঁজিবাজারের যাচ্ছেতাই অবস্থা। ব্যাংক খাত ও রাজস্ব আদায়ও চ্যালেঞ্জের মুখে। তার ওপর পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কারখানায় হামলা, হয়রানিমূলক মামলা, ব্যাংক হিসাব জব্দ, বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞাসহ নতুন যন্ত্রণায় তারা ভীতসন্ত্রস্ত। আত্মরক্ষায় কেউ ধীরে চলছেন।
নতুন বিনিয়োগের চিন্তায় না গিয়ে বিনিয়োগ যা আছে সেটা টেকানোর চেষ্টা করছেন। জাত ব্যবসায়ীদের অনেকে হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করে দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প-কারখানা গড়ে তুলেছেন। দীর্ঘ পরিশ্রমে ব্যবসার প্রসার ঘটিয়েছেন। এতে বিপুলসংখ্যক কর্মসংস্থান হয়েছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পর অনেক কারখানায় হামলা ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। হামলার ভয়ে অনেক প্রতিষ্ঠানে উৎপাদন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা না থাকলেও অনেক ব্যবসায়ীকে হত্যা মামলার আসামি করা হয়েছে। অনেকের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে। নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় আমদানি-রপ্তানি বা বিনিয়োগসংক্রান্ত জরুরি কাজেও অনেক ব্যবসায়ী বিদেশে যেতে পারছেন না। ৫০ বছর ব্যবসা করেও যিনি ঋণখেলাপি হননি, নানাভাবে চাপের মুখে ফেলায় তারও ব্যাংকের কাছে ঋণখেলাপি হওয়ার উপক্রম।
আগের সরকারের দোসরদের মধ্যে বড় বড় ব্যবসায়ী ছিলেন-আছেন, তা-ও সত্য। তাদের অনেকে আগেভাগে পালিয়েছেন। যারা কোনোমতে টিকে আছেন, তারাও বুঝতে পারছেন না আগামী এক-দেড় বছরে রাজনীতি কোন দিকে যাবে। কারা ক্ষমতায় আসীন হবে, সেই হিসাবও করতে হচ্ছে। তাদের এই পেরেশানি থেকে মুক্ত করতে হবে। নিশ্চয়তা দিতে হবে—সরকারে যে-ই থাক, যে-ই আসুক, তাদের কোনো সমস্যা হবে না। এ দায়িত্ব অবশ্যই সরকারের। ব্যবসায়ী নয়, ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির নির্ভরযোগ্য ও নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহও নিশ্চিত করতে হবে। জ্বালানি খাতের দুর্নীতির কারণে মূল্য বৃদ্ধি পায়, যা ভোক্তা বা ব্যবসায়ীর ঘাড়ে পড়ে।
আর্থিক খাতের দুর্দশাগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশে দাঁড়াতে হবে। করনীতিতেও সংস্কার জরুরি। কর প্রয়োগের ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও হয়রানি বন্ধ করতে হবে। ব্যবসা শুরুর নিয়ম-কানুনও সহজ করতে হবে। ব্যবসা শুরু করতে বিভিন্ন দপ্তরে নিবন্ধন নিতে গিয়ে উদ্যোক্তাদের পদে পদে হয়রানির লাগাম টানতে হবে। ব্যবসায়ীদের মুখস্থ গাল দেওয়া সহজ। টানা পরিশ্রম এবং বিপুল বিনিয়োগে ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প-কারখানা গড়ে তোলার মাধ্যমে তারা যে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন, গাল দেওয়ার সময় তা মনে থাকে না। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) মতে, দেশে মোট কর্মসংস্থানে সরকারি চাকরির অংশ ৩.৮ শতাংশ, বেসরকারি চাকরির অংশ ১৪.২ শতাংশ এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগে নিয়োজিত ৬১ শতাংশ কর্মী। এখন সেখানে নতুন কর্মসংস্থান দূরে থাক, কর্ম আরো যায় যায়।
বর্তমান পরিস্থিতির ধরনটা ভিন্ন। মাস চারেকে দেশের অর্থনীতি পুরোপুরি বদলে যাবে—এমনটা কেউ প্রত্যাশা করে না। দেশের অর্থনীতির চেহারা পুরোপুরি পাল্টে যাবে—প্রত্যাশার পারদ এমনও নয়। কিন্তু কিছু দৃশ্যমান পরিবর্তন এই সময়ের মধ্যে প্রত্যাশা করা অমূলক নয়। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ নেতা ও তাদের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীর বেশির ভাগই আত্মগোপনে অথবা কারাগারে। ফলে তাদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো চাপে রয়েছে। দেশের বড় কিছু শিল্পগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অনুসন্ধান চলছে। অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিতের পাশাপাশি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো যাতে সচল থাকে, কর্মীরা বেতন-ভাতা পান, সে ক্ষেত্রে সরকারের একটি কৌশল থাকতে পারে। এটি হবে একটি কাজের কাজ।
এই কাজের কাজের দিকে না গিয়ে অনাবশ্যক ও বাড়তি কাজের নমুনা দেখা যায়। ১০টি খাতের করছাড় তুলে দিয়ে বাড়তি ভ্যাট বসানোর চরকা ঘোরানো হচ্ছে। নতুন করে চুনাপাথর, মোবাইল ফোন, সমুদ্রগামী জাহাজ, স্টেইনলেস স্টিল, স্যানিটারি ন্যাপকিন, ডায়াপার, ফোর স্ট্রোক থ্রি-হুইলার, ইপিজেড ও অর্থনৈতিক অঞ্চলের শিল্পে ভ্যাটছাড় তুলে দিয়ে রাজস্ব ঘাটতি কমানোর এই বুদ্ধি কে বাতলে দিচ্ছে? জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কী দরকার পড়ল এসব নিয়ে কচলাকচলি করার? এসব না করে বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারকে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মেলবন্ধনের বুদ্ধি বাতলানো যায় না? ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সরকারের নিয়মিত মুখদর্শন ও মতবিনিময় ঘটলে বাজার পরিস্থিতিতে এর ছাপ পড়তে বাধ্য। সরকারের বাজার নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনায় ব্যবসায়ীদের শরিক করা গেলে তা ম্যাজিকের মতো কাজে দেবে। ব্যবসায়ীরা শুধু ব্যবসায়ীদেরই চেনেন না, আড়ত, গুদাম, মজুদসহ বাজারসংশ্লিষ্ট সবাইকে চেনেন, জানেন। বোঝেনও। যেখান থেকে সঠিক তথ্যসহ করণীয় যাবতীয় সহায়তাও সরকার পাবে নিশ্চিত। রাজনীতির বাইরে দেশি-বিদেশি-প্রবাসীসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টাসহ অন্তর্বর্তী সরকারের শীর্ষ মহলের সঙ্গে ঘটা করে বৈঠক-সাক্ষাতের খবর গণমাধ্যমে আসছে প্রায়ই। দেখতে হচ্ছে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে নানা বায়নানামা নিয়ে ঘোরা মহলের দেখা-সাক্ষাতের খবরও। সেই অনুপাতে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সরকারের এক্সক্লুসিভ যোগাযোগের খবর অনেকটাই বেখবরে।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট, ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন
বাংলাদেশ সময়: ০৯৪০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১১, ২০২৪
এসআই