ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

বিষ প্রয়োগে অতিথিদের হত্যা

নিউজ ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৪৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ৩, ২০২৩
বিষ প্রয়োগে অতিথিদের হত্যা কথাসাহিত্যিক ও কলামিস্ট আলম শাইন

প্রাকৃতিক নিয়মের হেরফের না ঘটলে আর কিছুদিনের মধ্যেই শীতের আগমন ঘটবে দেশে। আগমন ঘটবে শীতের পরিযায়ী পাখিদেরও।

শুধু ভরা শীতেই নয়, অক্টোবরের মধ্যেও কিছু পরিযায়ী প্রজাতির পাখি এসেছে দেশে।  

মূলত এই পরিযায়ী পাখিরা আমাদের দেশে আসে একটু উষ্ণতার খোঁজে আর খাবারের সন্ধানে। এরা দেশের অধিকাংশ মানুষের কাছে অতিথি পাখি নামে পরিচিত। আসলে এরা অতিথি নয়, পরিযায়ী পাখি।  

শব্দ দুটির মধ্যে বিস্তর ফারাক থাকলেও পাখি শিকারিরা দুটি শব্দের অর্থকে এক করে ফেলেন। এতে করে ওদের লাভ বই লোকসান হয় না। কারণ রসনাবিলাসিরা অতিথি পাখির মাংসের প্রতি খুবই দুর্বল থাকেন সবসময়। তাদের এই লোভের কারণে নির্মমতার শিকার হচ্ছে অসংখ্য পরিযায়ী পাখি।  

সত্যি বলতে কী, হাওর—বাঁওড় কিংবা বিল এলাকায় দিনে-দুপুরেই অবাধে পাখি নিধন চলছে। পত্রপত্রিকায় প্রায়ই আমরা সেই সংবাদ দেখি। পত্রিকায় এ ধরনের দুষ্কর্মের হোতাদের নাম দেওয়া হয় শিকারি।  

কিন্তু আমাদের চোখে এরা দুষ্কৃতকারীই; কখনো শিকারি নন। শিকারি অমন ছিঁচকে স্বভাবের হতে পারেন না। ফাঁদ পেতে বা বিষটোপ প্রয়োগ করে যারা পাখি নিধন করেন, তারা কোনোদিনও শিকারির কাতারে পড়েন না।  

শিকারি হচ্ছেন বীরত্বসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব; সরকার ঘোষিত শ্বাপদসংকুল অরণ্যে যিনি হিম্মত দেখিয়ে বাঘ—সিংহ শিকার করেন, তিনি হচ্ছেন প্রকৃত শিকারি। কিংবা জনসাধারণের জন্য হুমকি এমন হিংস্র প্রাণী যিনি নিধন করেন তিনিই হচ্ছেন শিকারি। সেক্ষেত্রে অবশ্যই সরকারের অনুমতির প্রয়োজন।  

অথচ যারা পাখি মারছেন আমরা তাদের বলছি শিকারি! এই তথাকথিত শিকারিদের জন্য আজ বালিহাঁস মহাবিপন্নের তালিকায় এসেছে। যেখানে আমাদের দেশে ‘বালিহাঁস’ মহাবিপন্নের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে, সেখানে চলনবিল এলাকায় কয়েক বছর আগে এক জোড়া বালিহাঁস মাত্র ৪০০—৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে! যা অত্যন্ত দুঃখজনক সংবাদ।  
এছাড়াও ফেসবুক এবং ইউটিউব মারফত জানা গেছে, বকপাখিসহ বিভিন্ন প্রজাতির জলচর পাখি ধরার অভিনব কৌশল। পাখ—পাখালি হত্যা করে তারা যে খুব বেশি অর্থকড়ি উপার্জন করছেন তা কিন্তু নয়। এই ছিঁচকে স্বভাবের অলস মানুষ যদি ঠিকমতো কাজকর্ম করতেন তাহলে এরচেয়ে ঢের উপার্জন করতে সক্ষম হতেন। অথচ সেই কাজটি না করে প্রকৃতির বন্ধুদের তারা বিষ প্রয়োগে হত্যা করছেন।

আমরা জানি, পাখি শুধু পরিবেশের ভারসাম্যই রক্ষাই করছে না, ওরা প্রকৃতির কঠিন পরিবেশে খাপ খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখতে সহায়তা করছে আমাদের। অভিযোগ রয়েছে, পাখিরা আমাদের ফল—শস্যাদি খেয়ে ফেলছে। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, ওই ফল খেয়ে দূরে কোথাও গিয়ে মলত্যাগের মাধ্যমে বনায়ন সৃষ্টির ফলে অক্সিজেন ফ্যাক্টরি তৈরি করছে। আরও অবাক করা তথ্য হচ্ছে, হাওর অঞ্চলের মানুষের ধারণা পরিযায়ী পাখিরা শুধু তাদের ফসল খেয়েই বিনষ্ট করছে।  
অথচ সেই পরিযায়ী পাখিরা হাওরেই প্রতিদিন একটনের বেশি বিষ্ঠা ত্যাগ করছে। যার ফলে ফসলের গাছ—গাছালি ও মাছেরা পাচ্ছে উপযুক্ত খাবার। সেই উপকারী বন্ধু পরিযায়ী পাখিসহ অন্যান্য পাখি নিধন করা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না।  

খাবারে বিষ মাখিয়ে, বিভিন্ন ধরনের ফাঁদ পেতে পাখি শিকার করছে দুষ্কৃতকারীরা। কী জঘন্য কাজই না করছে তারা! এ ধরনের ন্যক্কারজনক ঘটনার কারণে আজ দেশ থেকে অনেক প্রজাতি পাখি হারিয়ে গেছে।  

যেমন হারিয়েছে ফ্লোরিকান ময়ূর, পিংক মাথা হাঁস ও রাজ শকুন। আর হারিয়ে যেতে বসেছে ভাদিহাঁস, বালিহাঁস, দিগহাঁস, কালো তিতির, চন্দনা, বাংলা শকুনসহ আরও অনেক প্রজাতির পাখি। এছাড়াও ১৯ প্রজাতির পাখি মহাবিপন্নের তালিকায় স্থান পেয়েছে।

বিষয়টা ভাবতে কেমন লাগছে? কেমন লাগছে পরিবেশটা ভারসাম্য হারিয়ে পঙ্গু হতে দেখে? এ নিধন দ্রুত বন্ধ না হলে অদূর ভবিষ্যতে বিপন্নের দিকে ঠেলে নিয়ে যাবে পরিযায়ী পাখি প্রজাতিকে। তাই আমাদের উচিত প্রকাশ্যে—অপ্রকাশ্যে বন্যপ্রাণীদের ওপর যেন অত্যাচার—নিপীড়ন আর না ঘটে, তার প্রতি সজাগ দৃষ্টি দেওয়া।  

কাজটি কিন্তু ইচ্ছে করলেই করতে পারি আমরা। শুধু একটু সচেতন হলে আর প্রচার—প্রচারণা বাড়িয়ে দিলেই হয়। তাতে করে অন্তত প্রকাশ্য দিবালোকে কেউ বন্যপ্রাণী নিধন করতে সাহস পাবে না আর।  

ইতোমধ্যে দেশে বন্যপ্রাণী রক্ষার্থে ‘বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন ২০১২’ পাশ হয়েছে। উক্ত আইনের এক নম্বর ও দুই নম্বর তপশিলে ৬৫০ প্রজাতির পাখিকে ‘প্রোটেক্টেড বার্ড’ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। পরিযায়ী পাখি শিকারের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ এক বছরের কারাদণ্ড অথবা সর্বোচ্চ ১ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে।  

সুন্দরবন ও টাঙ্গুয়ার হাওরকে ‘রামসার সাইট’ ঘোষণা করেছে ইউনেস্কো। অন্যদিকে টাঙ্গুয়ার হাওর, হাইল হাওর, হাকালুকি হাওর, নিঝুম দ্বীপ ও সোনাদিয়া দ্বীপকে ‘ফ্লাইওয়ে সাইট’ ঘোষণা করেছে।  

শকুনের প্রাণঘাতী ওষুধ ‘ডাইক্লোফেনাক’ উৎপাদন নিষিদ্ধ করা হয়েছে দেশে। এসব এলাকায় বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে পরিচালিত ‘স্ট্রেংদেনিং রিজিওনাল কো—অপারেশন ফর ওয়ার্ল্ডলাই প্রোটেকশন’ প্রকল্পের আওতায় বন বিভাগ—এনজিও—বিশ্ববিদ্যালয় যৌথভাবে কার্যক্রম গ্রহণ করেছে।  

এছাড়াও বন্যপ্রাণী প্রেমীদের উৎসাহিত করতে বিভিন্ন ধরনের অ্যাওয়ার্ড প্রদান করা হচ্ছে। উদ্ধারকৃত ও আহত পাখির সেবাদানে সারা দেশে চারটি অঞ্চলে ‘বন্যপ্রাণী উদ্ধারকেন্দ্র’ স্থাপন হয়েছে। পাখিসমৃদ্ধ এলাকাকে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় ‘ইকোলজিক্যাল ক্রিটিক্যাল এরিয়া’ ঘোষণা করেছে।  

শকুনের মরণঘাতী ওষুধ ‘ডাইক্লোফেনাক’ উৎপাদন নিষিদ্ধ করেছে সরকার। এ ছাড়াও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন ২০১২—তে উল্লেখ আছে বাঘ বা হাতি হত্যা করলে সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা জরিমানা ও সাত বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। অন্যসব বন্যপ্রাণী শিকার করলে অথবা আইন লঙ্ঘনকারীকে সর্বোচ্চ ১ লাখ টাকা জরিমানা ও এক বছর কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। বন্যপ্রাণীদের জন্য সহায়ক এই আইনটি বাস্তবায়ন অথবা প্রয়োগ হলে অনেক বিপন্ন বন্যপ্রাণী রক্ষা পাবে বলে আমাদের বিশ্বাস রয়েছে। অথচ আইনটি কাগজে কলমে থাকলেও তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। যদি হতোই, তাহলে প্রকাশ্যে দিবালোকে বন্যপ্রাণী নিধন করার সাহস কেউ পেত না।

লেখক: আলম শাইন, কথাসাহিত্যিক ও কলামিস্ট

বাংলাদেশ সময়: ১২৪৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৩, ২০২৩
এসএএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।