ঢাকা, রবিবার, ১৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

রূপসী রুই-তেলাপিয়ায় রঙিন স্বপ্ন

এস.এস শোহান, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৫৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৮, ২০২০
রূপসী রুই-তেলাপিয়ায় রঙিন স্বপ্ন মাছচাষি হাফিজুর রহমান। ছবি: বাংলানিউজ

বাগেরহাট: রূপসী রুই ও রঙিন তেলাপিয়ায় নতুন করে স্বপ্ন সাজাচ্ছেন মাছচাষি হাফিজুর রহমান। মাত্র দুই বছরেই সহস্রাধিক মা তেলাপিয়া ও ১০ হাজারের বেশি রূপসী রুই তৈরি করে সাড়া ফেলেছেন স্থানীয়দের মধ্যে।

 

নতুন প্রজাতির এই মাছ দেখে ইতোমধ্যে অনেকের মধ্যে চাষের আগ্রহ জমেছে। ব্যাপকভাবে এই মাছের চাষ করা গেলে দেশিয় বাজারের পাশাপাশি বিদেশেও রপ্তানি করা সম্ভব বলে দাবি করেন তিনি।

বাগেরহাট সদর উপজেলার সুন্দরঘোনা-কাঁঠালতলা গ্রামে দুই একর জমিতে হাফিজুর রহমানের আধুনিক মাছের খামার। এর সঙ্গে রয়েছে ৫০ হাজার লিটারের বায়োফ্লক প্লান্ট। ১৭ বছর ধরে দেশি কঈ, শিং, মাগুর, গুলিশা ও পাবদা মাছের পোনার রেনু পোনা নার্সিং করে চাষিদের কাছে বিক্রি করেন তিনি।  

দুই বছর আগে রঙিন মাছ চাষে উদ্যোগ নেন হাফিজুর। ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিসারিজ ডিপার্টমেন্টের কাছ থেকে রঙিন তেলাপিয়া ও রূপসী (লাল, হলুদ) রুইয়ের রেনু পোনা এনে বায়োফ্লক ও আধুনিক পদ্ধতিতে নার্সিং শুরু করেন তিনি। পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকায় প্রথম বছরেই সফলতা পান।

পুকুরে রঙ্গিন মাছচাষ।  ছবি: বাংলানিউজ

গতানুগতিক পোনার ব্যবসার পাশাপাশি ব্যাপকভাবে রঙিন তেলাপিয়া ও রূপসী রুই চাষ বৃদ্ধি করতে চান তিনি। তবে মানসম্মত খাবার ও নতুন বাজার সৃষ্টি নিয়েও উৎকণ্ঠা রয়েছেন এই স্বপ্নবাজ মাছ চাষি হাফিজুর রহমানের।

হাফিজুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, রঙিন রুই ও তেলাপিয়া চাষের সুবিধা অনেক। এটা ছোট থেকে যেকোনো সাইজ বিক্রি করা যায়। এই মাছ এক বছরের মধ্যে প্রতি এক কেজির উপরে হতে পারে। অ্যাকুরিয়ামের জন্য অপেক্ষাকৃত ছোট সাইজ এবং খাওয়ার জন্য বড় সাইজের মাছগুলো বিক্রি হয়। সাধারণ তেলাপিয়ার থেকে এই তেলাপিয়া স্বাদ ও চেহারা অনেক সুন্দর। মনোসেক্স তেলাপিয়া উৎপাদনের জন্য এক ধরনের গ্রোথ হরমোন ব্যবহার করা হয়। রঙিন তেলাপিয়া উৎপাদনে কোনো প্রকার হরমোনের ব্যবহার করা হয় না। এটা প্রাকৃতিক মাছের মতো উৎপাদন হবে। আর এই তেলাপিয়া যেকোনো পুকুরে চাষ করা যাবে। দেশি তেলাপিয়ার মত বাচ্চা দিবে এবং বংশ বৃদ্ধিও হবে।

রূপসী রুইয়েরও রূপের পাশাপাশি গুনও অনেক। রূপসী রুইটি মূলত অস্ট্রালিয়ান জাতের রুই। মাছটি সাইজে ছোট অবস্থায় অ্যাকুরিয়াম প্রেমিকদের কাছে খুব চড়া দামে বিক্রি হয়। আবার অন্য মাছের সঙ্গে এই মাছ চাষ করা যায়। এক কেজি ওজনের রঙিন রুই সাড়ে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকাও বিক্রি করা যায়। রঙিন তেলাপিয়া ও রূপসী রুই কৃষি ভিত্তিক রিসোর্টের মালিকরা দর্শণার্থীদের দেখানোর জন্য চড়া দামে ক্রয় করে থাকেন বলে জানান তিনি।

ছবি: বাংলানিউজ

তিনি আরও বলেন, ১৯৯০ সালের দিকে আমি মাছ চাষ শুরু করি। এখন পর্যন্ত মাছ চাষের সঙ্গে আছি। মাছ চাষের জন্য ভাল পোনা খুবই দরকারি। অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে দুর্বল পোনায় প্রান্তিক মাছ চাষিরা অনেক সময় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ কারণে ২০০৩ সালের দিকে ‘নাইম মৎস্য খামার’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলি। যেখানে বিভিন্ন হ্যাচারি থেকে বাছাইকৃত দেশি কঈ, শিং, মাগুর, গুলিশা, পাবদা, ভিয়েতনামী পাঙ্গাসের রেনু এনে নার্সিং করে বিক্রি করা শুরু করি। আমার মাধ্যমে বাগেরহাট, পিরোজপুর, খুলনার রপুসাসহ বিভিন্ন এলাকায় ৫ শতাধিক মাছচাষি দেশি কই, শিং, মাগুর, গুলিশা ও পাবদার চাষ শুরু করেন। এদের আমি পোনা সরবরাহ থেকে শুরু করে সব ধরনের কারিগরি সহযোগিতা করে থাকি।

আগামী বছর থেকে রঙিন মাছের পোনা বিক্রি শুরু করব। দেশের যেকোনো স্থানের চাষিরা আমার কাছ থেকে মাছ সংগ্রহ করতে পারবেন। রঙিন তেলাপিয়া ৩ টাকা পিস এবং রূপসী রুইয়ে দাম পড়বে ১০ টাকা পিস। চাইলে আমার (০১৭৪৩-৯০৫৭৭৯) নম্বরে ফোন করেও পোনা নিতে এবং চাষাবাদ সম্পর্কে খোঁজ খবর নিতে পারবেন চাষিরা।

বাংলাদেশের পানি ও জলবায়ু যেকোনো মাছ চাষের উপযোগী হওয়া সত্ত্বেও রঙিন মাছ চাষে বেশকিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। মান সম্মত খাদ্য ও বিদ্যুৎ সংকটের মধ্যে অন্যতম। এরফলে আধুনিক পদ্ধতিতে মাছ চাষের জন্য আমাদের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিদেশি কোম্পানির খাবারের উপর নির্ভর করেন চাষিরা। যার ফলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়, লাভ হয় সীমিত।

পুকুরে রঙ্গিন মাছচাষ।  ছবি: বাংলানিউজ

চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে হাফিজুর রহমান বলেন, আমি মূলত বিভিন্ন হ্যাচারি থেকে রেনু নিয়ে আসি। রেনুগুলোকে প্রথমে পটাশের পানি দিয়ে শোধন করি। বিভিন্ন জীবানুনাশক ব্যবহার করে বায়োফ্লকের ট্যাংকি ও পুকুরের পানিকে রেনু ছাড়ার উপযোগী করে তুলি। এরপরেই রেনু ছেড়ে দেই। সার্বক্ষণিক অক্সিজেন সরবরাহ করে থাকি। মাঝে মধ্যে পানিও পরিবর্তনের প্রয়োজন হয়। রেনুর মর্টালিটি হ্রাস ও বৃদ্ধিকে তরান্বিত করার জন্য উচ্চ প্রোটিন সম্মৃদ্ধ খাবার ব্যবহার করে থাকি। আর্থিক সহযোগিতা পেলে আরও বড় পরিসরে রঙিন মাছ চাষের আশাব্যক্ত করেন তিনি।

বাগেরহাট সদর উপজেলার সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা ফেরদাউস আনসারী বাংলানিউজকে বলেন, আমরা গতানুগতিক চাষিদের পাশাপাশি উদ্বাবনী চিন্তার মৎস্য চাষিদের একটু বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকি। হাফিজুর রহমানসহ বাগেরহাট সদর উপজেলায় দুইজন রঙিন মাছ চাষি রয়েছে তাদের আমরা সবধরনের কারিগরি সহযোগিতা ও পরামর্শ দিয়ে থাকি। তাদের উৎপাদিত মাছ কোনো প্রকার মধ্যসত্ত্ব ভোগী ছাড়া সরাসরি ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছানোর জন্য বাজার ব্যবস্থা উন্নতকরণ করার জন্য আমরা চেষ্টা করছি। গুলিশা, কই, এবং রঙ্গিন তেলাপিয়া ও রুই মাছ রপ্তানির জন্য আমরা সবধরণের যোগাযোগ করছি। ইতোমধ্যে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে আমাদের গুলিশা, কই, এবং রঙ্গিন তেলাপিয়া ও রুই মাছ রপ্তানি শুরু হয়েছে। এই বাজারটিকে বড় করার জন্য আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি।

বাংলাদেশ সময়: ০৮৫৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৮, ২০২০
এনটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।