ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

একজন নিপীড়ক শমসেরের কথা

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯১৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৪, ২০১৬
একজন নিপীড়ক শমসেরের কথা ছবি: শমসের আলী

ঢাকা: একটি বেসরকারি স্কুলের শিক্ষিকার ওপর নির্যাতন চালিয়ে ব্যাপক ‘পরিচিতি’ পেয়েছেন তিনি। তার এ অপকর্মের খবর নিতে গিয়ে ‘কেঁচো খুঁড়তে সাপ’ বেরিয়ে আসছে।

নিপীড়ক হিসেবে পরিচিতি পাওয়া ওই ব্যক্তির নাম শমসের আলী। তিনি একজন অবসরপ্রাপ্ত কৃষি প্রকৌশলী।

সম্প্রতি রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় প্রকাশ্যে এক স্কুল শিক্ষিকাকে মারধর করে গ্রেফতার হন শমসের আলী। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোক দাবি করলেও গোপনে তিনি জামায়াতের অনুসারী। কর্মজীবনে অনৈতিক উপায়ে কোটি কোটি টাকা আয় করেছেন, গড়েছেন অবৈধ সম্পদ। ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডে (ডিপিডিসি) কর্মরত এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের প্রতিপত্তির জোরে তিনি সবার সঙ্গে অসদাচরণ করে চলছেন।

বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার সি ব্লকের বাসিন্দারা তার কর্মকাণ্ডে অতিষ্ঠ। কয়েকজন প্রতিবেশী অভিযোগ করেছেন, শিক্ষিকার মতো নিরীহ আরও অনেকের ওপর চড়াও হওয়ার চেষ্টা করেছেন শমসের আলী। শিক্ষিকার অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। তবে দুই দিন পরই জামিনে ছাড়া পান। বাড়ি ফিরেই শিক্ষিকাকে হুমকি দিতে শুরু করেন তিনি। মামলা করে এখন আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন ওই শিক্ষিকা।

পুলিশ জানায়, শমসের আলীর বিরুদ্ধে স্কুল শিক্ষিকাকে নির্যাতনের অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া গেছে। তার জামায়াত ও জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ভাটারা থানার ওসি নুরুল মোত্তাকিন বলেন, প্রকৌশলী শমসের আলীর বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।

মামলার সূত্রে ও সরেজমিন ঘুরে জানা যায়, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার সি ব্লকের ৫ নম্বর রোডের ১৪৬ নম্বর প্লটের মালিক ছিলেন শমসের আলী ও তার ভায়রা ডিপিডিসির নির্বাহী পরিচালক (অপারেশন) হারুনুর রশিদ। সরকারি কর্মকর্তা হয়েও গাড়ি-বাড়ির মালিক হয়েছেন তারা। জমিটি তারা কেনেন তাদের স্ত্রীদের নামে। ডেভেলপার দিয়ে বাড়ি তৈরি করে তারা দুই ভায়রা চারটি ফ্ল্যাট নিজেদের জন্য রাখেন। ওই বাড়িতেই গত ১৭ ডিসেম্বর শিক্ষিকার ওপর হামলার ঘটনা ঘটে।

একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের শিক্ষিকা ওই বাড়ির একটি ফ্ল্যাটের মালিক। ঘটনার দিন স্কুল থেকে ফিরে তিনি বাড়ির দারোয়ান বাচ্চু ও সাজ্জাদকে দোকান থেকে নুডলস এনে দিতে বলেন। কেন তিনি দারোয়ানকে নির্দেশ দিলেন- এ কারণে শমসের আলী তাকে গালিগালাজ করেন। প্রতিবাদ জানাতেই কিল-ঘুষি মেরে তাকে মেঝেতে ফেলে দেন তিনি। এরপর তাকে টেনে-হিঁচড়ে লাঞ্ছিত করার চেষ্টা করেন। গুরুতর আহত হন শিক্ষিকা। চিত্কার শুনে বিশ্ববিদ্যালয়-পড়ুয়া ছেলে ছুটে এসে মাকে উদ্ধার করেন। দারোয়ান বা অন্য কেউ ‘হায়েনারূপী’ শমসেরের কাছ থেকে শিক্ষিকাকে বাঁচাতে এগিয়ে যায়নি। পরে নির্যাতিত শিক্ষিকা ভাটারা থানা পুলিশ ও বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা কর্তৃপক্ষকে ঘটনাটি জানান। সংশ্লিষ্টরা দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। বসুন্ধরা গ্রুপের পক্ষ থেকে শিক্ষিকার নিরাপত্তা এবং ঘটনার তদন্তের ব্যাপারে পুলিশকে সর্বাত্মক সহায়তা দেওয়া হয়।

ওইদিন রাতেই নির্যাতনের শিকার শিক্ষিকা ভাটারা থানায় দণ্ডবিধির ৩২৩/৩৫৪/৫০৬ ধারায় মারধর ও শ্লীলতাহানির অভিযোগে মামলা করেন। পুলিশ শমসের আলীকে গ্রেফতার করে। মামলা না নিতে এবং শমসেরকে গ্রেফতার না করতে পুলিশের ওপর প্রভাবশালী মহলের চাপ ছিল। তবে নারীর ওপর অমানবিক নির্যাতনের ঘটনা ধামাচাপা দিয়ে পুলিশ বিতর্কিত হতে চায়নি। গ্রেফতারের পরদিনই আদালত থেকে জামিন পেয়ে যান শমসের আলী। বাড়ি ফিরে খোশ হালেই আছেন।

জানা যায়, তার ঘনিষ্ঠজনরা শিক্ষিকাকে সমঝোতার জন্য চাপ দিচ্ছেন। এতে ভয়ে আছেন নির্যাতিত ওই শিক্ষিকা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শমসেরের বিরুদ্ধে নারী নির্যাতনের ধারায় মামলা নেয়নি পুলিশ। প্রমাণ পেয়েও অজানা কারণে ওই ধারা যুক্ত করেনি তদন্তকারীরা। এ কারণেই শমসের জামিনে ছাড়া পেয়েছেন। পুলিশের এ ভূমিকায় স্থানীয়দের মনে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

ওই বাড়িতে গিয়ে খোঁজখবর নিয়ে জানা যায়, শমসের আলী ও তার ভায়রার মানসিক নির্যাতনের শিকার ফ্ল্যাট মালিকরাসহ বাড়ির সব বাসিন্দা। এখনো তিনি নিজেকে পুরো ভবনের মালিক মনে করেন। বাসিন্দাদের ওপর খবরদারি করেন, ইচ্ছামতো সিদ্ধান্ত নেন। ২০১২ সালে ফ্ল্যাটে ওঠেন ওই শিক্ষিকা। একদিন জানালায় গ্রিল লাগাতে গেলে তাকে মারতে যান শমসের। তার উগ্র আচরণের কারণে বাড়ির অন্য বাসিন্দারা ভয়ে ভয়ে থাকেন।

বাসিন্দাদের অভিযোগ, শমসেরের ভায়রা হারুনুর রশিদও প্রায়ই প্রতিবেশীদের সঙ্গে অশোভন আচরণ করেন। তিনি রাতে মদ্যপ অবস্থায় বাড়িতে ফিরে মাতলামি করেন। বিভিন্ন ফ্ল্যাটের দরজায় ধাক্কা দিয়ে গালমন্দ করেন। নারীদেরও উত্ত্যক্ত করেন তিনি। মান-সম্মানের কথা ভেবে তারা তটস্থ থাকেন।

পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন প্রতিবেশী বলেন, সি ব্লকের ৫ নম্বর রোডের মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ার সময়ও অসংযত কথা বলেন শমসের আলী। জামায়াত ও জঙ্গি সংগঠনের প্রতি তিনি অনুরক্ত। তার চলাফেরা রহস্যজনক।

ভায়রা হারুনের দুটি গাড়ির একটির চালক মাহবুব খণ্ডকালীন চালক হিসেবে তার গাড়ি চালান। বাড়ির নিচতলায় একটি কক্ষ দখল করে মাহবুবকে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন শমসের আলী। বাড়ির দুই বাসিন্দা বলেন, মাহবুব জেএমবির জঙ্গি বলে সন্দেহ হয়। মাঝেমধ্যে তিনি হাওয়া হয়ে যান। কয়েক দিন পর ফিরে আসেন। তার কক্ষে প্রায়ই অপরিচিত লোকজন আসা-যাওয়া করে। শমসের আলীর সঙ্গে তার সম্পর্ক রহস্যজনক।

এলাকাবাসী বলেন, জেএমবির মতো উগ্রবাদী সংগঠনের মতাদর্শে বিশ্বাসীরা যে ধরনের আচরণ করেন শমসের আলীর আচরণ তেমনই। তিনি ভিন্নমতাদর্শীদের মর্যাদা দেন না। আচরণের কারণে তার জেএমবি কানেকশন আছে বলে সন্দেহ সবার। ১৫৬ নম্বর ভবনের এক বাসিন্দা বলেন, ‘মাহবুব (গাড়িচালক) অন্য চালকদের ভয় দেখিয়ে বলেছে, সে জেএমবির সদস্য। বিষয়টি গভীরভাবে খতিয়ে দেখা দরকার। ’

শমসের আলীর ব্যক্তিগত জীবনের খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিনি ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনে (বিএডিসি) সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। পাবনা, নাটোর ও সিরাজগঞ্জ (পানাসি) প্রকল্পের প্রকৌশলী ছিলেন। ২০০৯ সালে ঢাকায় কৃষি ভবনের প্রধান সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে অবসরে যান।

শিক্ষিকাকে নির্যাতনের ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে শমসের আলী বলেন, ‘এটা এক দিনের ঘটনা নয়। এর পেছনে কারণ আছে। ঝামেলা আছে। ’ তাই বলে একজন নারীকে মারধর করবেন- এ প্রশ্ন করা হলে তিনি প্রসঙ্গ এড়িয়ে যান।

জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকার ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি জামায়াত করতাম। এখন কোনো রাজনৈতিক দল করি না। ’  ভাটারা থানার মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই শওকত আলী মিয়া বলেন, তদন্তে তুচ্ছ কারণে শিক্ষিকার ওপর অতর্কিত হামলার প্রমাণ পাওয়া গেছে। আসামি শমসের আলী জামিন নিয়েছেন। তার বিরুদ্ধে আরও অনেক অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। এগুলোও তদন্ত করা হচ্ছে। প্রমাণ পেলে আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নেবো।

বাংলাদেশ সময়: ০৯১৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৪, ২০১৫
জেডএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।