ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

কোরআন পড়বে বলে বাতাসা নিয়ে মক্তবে যায় মারিয়া, ফিরল লাশ হয়ে

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১২৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৩০, ২০২৪
কোরআন পড়বে বলে বাতাসা নিয়ে মক্তবে যায় মারিয়া, ফিরল লাশ হয়ে একসঙ্গে দুই মেয়েকে হারিয়ে মা ও স্বজনদের আহাজারি

কুষ্টিয়া: তানজিলা আগে থেকেই কোরআন পড়তে পারত। বড় বোন নুসরাত ইসলাম মারিয়াও কোরআন পড়া শুরু করবে।

 

তাই রোববার (২৯ সেপ্টেম্বর) দুই বোন ফজরের নামাজের পর দুই কেজি বাতাসা নিয়ে মক্তবে যায়। মক্তব থেকে তারা বাড়ি ফেরে লাশ হয়ে। সড়কে এই দুই বোনের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে মাইক্রোবাস। একই দুর্ঘটনায় প্রাণ গেছে মিম ও জুথি নামে আরও দুই শিশুর।

রোববার সকাল সাড়ে ৬টায় মক্তবে পড়ে বাড়ি ফেরার পথে কুষ্টিয়াগামী মাইক্রোবাস চাপায় মারা যায় এই চার স্কুলশিক্ষার্থী। কুষ্টিয়া-রাজবাড়ী আঞ্চলিক মহাসড়কের খোকসার শিমুলিয়া কুঠিপাড়ায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। এই ঘটনায় আহত হয় আরেক শিক্ষার্থী। দুর্ঘটনায় পর পালিয়ে যান গাড়ির চালক।

কুঠিপাড়া মসজিদের ইমাম ও মক্তবের একমাত্র শিক্ষক আব্দুল হক জানান, সকাল সাড়ে ৬টায় মক্তবের প্রায় ১৩ জন ছাত্র-ছাত্রীকে ছুটি দেওয়া হয়। তিনি মসজিদের ভেতরে ছিলেন। হঠাৎ বিকট শব্দ পেয়ে তিনি বেরিয়ে এসে নিজের ছাত্রীকে মৃত অবস্থায় দেখতে পান।

স্থানীয়রা জানান, মক্তবের শিশুরা সড়কের ডান পাশ দিয়ে বাড়ি ফিরছিল। এ সময় ঢাকা থেকে আসা কুষ্টিয়াগামী মাইক্রোবাসটির চালক রাস্তার উল্টো দিকে এসে শিশুদের চাপা দেয়। পাঁচ শিশুই মাইক্রোবাসের নিচে চাপা পড়ে। ঘটনাস্থলেই একজন মারা যায়। হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যায় আরও তিনজন।

সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি তানজিলা ও মারিয়াকে বাড়ির পাশের মসজিদের মক্তবে পড়তে দিয়েছিলেন পলান মিয়া ও নাজমা খাতুন দম্পতি। এই কৃষক দম্পতির স্বপ্ন ছিল মেয়েরা লেখাপড়া শিখে বড় কিছু হবে। সব প্রত্যাশা নিমেষে ধুলায় মিশে গেল। এই দম্পতির তিন সন্তানের মধ্যে মারিয়া ও তানজিলা ছিল বড়। সবার ছোট ও একমাত্র ছেলে আশরাফ। ঘটনাস্থলেই মারা যায় পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী মিম।  

মিম তানজিলা ও মারিয়ার চাচাতো বোন। শিমুলিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী ছিল তানজিলা ও মারিয়া। আর মিম পড়ত গ্রামের পূর্বাসা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।  

নিহত আরেক শিক্ষার্থী জুথিও পড়ত পূর্বাসা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণিতে। এ ঘটনায় আহত ফাতেমাকে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। সেও একই বিদ্যালয়ের ছাত্রী। তাদের সবার বাড়ি শিমুলিয়া কুঠিপাড়ায়। বাড়িও পাশাপাশি।  

বেলা পৌনে ১টায় তিন ছাত্রীর লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্স বাড়ির সামনের সড়কে আসার পর স্বজনহারাদের আহাজারিতে চারপাশ ভারী হয়ে ওঠে। নিহতদের স্কুলের শিক্ষক, সহপাঠী, প্রতিবেশী, আত্মীয়রা কান্নায় বুক ভাসান।  

একসঙ্গে দুই মেয়েকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ নাজমা খাতুন। প্রতিবেশী ও স্বজনেরা তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। তিনি একনাগাড়ে বিলাপ করেই যাচ্ছেন। পাশেই নিহতের দাদি বারবার জ্ঞান হারাচ্ছেন। একটু দূরেই নিহতদের বাবা পালন বসে শুধু ঘামছেন। তিনি শোকে বাকরুদ্ধ!

কয়েক দফা চেষ্টার পর পালন ক্ষীণকণ্ঠে বলেন, ‘কার কাছে আর অভিযোগ দেব! আমার যা হওয়ার হয়ে গেছে। আমার আর কী করার আছে। আশা ছিল মেয়েদের মানুষের মতো মানুষ করার। মেয়েরা নিজের ইচ্ছাতেই কোরআন পড়তে যেত। বড় মেয়ে কোরআন ধরবে বলে আগের রাতেই মিষ্টি কিনে এনে রেখেছিলাম। সকালে মেয়েদের ডেকে আগের রাতে আনা মিষ্টি দিয়ে মক্তবে পাঠিয়েছিলাম। ’

শিমুলিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আশরাফুজ্জামান জানান, ছাত্রী হিসেবে নিহত দুই বোন বেশ ভালো ছিল। পড়ার প্রতি আগ্রহ ছিল। বাবা গরিব মানুষ হলেও মেয়েদের লেখাপড়ার ব্যাপারে তার চেষ্টা ছিল।  

একই দুর্ঘটনায় নিহত চার স্কুলছাত্রীর বাড়ি ও গ্রামজুড়ে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। বিকেলে শিমুলিয়া কুঠিপাড়া ঈদগাহ মাঠে জানাজার পর স্থানীয় কবরস্থানে পাশাপাশি তাদের দাফন করা হয়।

কুষ্টিয়া হাইওয়ে থানা পুলিশের ওসি আকুল চন্দ্র বিশ্বাস জানান, এ ঘটনায় এখনো মামলা হয়নি। পরিবার যদি মামলা না করে তাহলে বাদী হয়ে মামলা করবে পুলিশ।  

চালককে আটক করতে অভিযান চলছে বলে জানান তিনি।

বাংলাদেশ সময়: ১১১৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৩০, ২০২৪ 
এসএএইচ
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।