ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

সুষ্ঠু পরিকল্পনা ছাড়াই শুরু হচ্ছে লক্কড়-ঝক্কড় বাসের বিরুদ্ধে অভিযান

নিশাত বিজয়, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৪৭ ঘণ্টা, জুন ৩০, ২০২৪
সুষ্ঠু পরিকল্পনা ছাড়াই শুরু হচ্ছে লক্কড়-ঝক্কড় বাসের বিরুদ্ধে অভিযান ফাইল ছবি

ঢাকা: রাজধানীর সড়ক থেকে রংচটা ও লক্কড়-ঝক্কড় বাস সরাতে হঠাৎই ঘোষণা দেন সড়ক ও সেতু মন্ত্রণালয়ের টানা চারবারের মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তার ঘোষণার পরই নড়েচড়ে বসে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)।

রোববার (৩০ জুন) ছিল বেঁধে দেওয়া সময়সীমার শেষ দিন। মে মাসের সেই ঘোষণার পরে ওই মাসেই ৩৪৮, আর পরবর্তী মাস জুনে ৪৭৫- মোট ৮২৩টি যানবাহন ফিটনেস নবায়ন করে।

বিআরটিএ ঢাকা সার্কেলের ইঞ্জিনিয়ারিং শাখা জানায়, বিআরটিএর গণবিজ্ঞপ্তি জারির পর সাড়ে ছয় হাজার গাড়ির মধ্যে মাত্র ৮২৩টি যানবাহন নবায়ন করেছে। সে হিসাবে রাজধানীর মোট গণপরিবহনের খুব কম অংশই ফিটনেস নবায়ন করে নিয়েছে।  

ফোনকলে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সহ-সভাপতি মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘ঢাকার সড়কে কোন কোম্পানির কতগুলো বাস চলে, কতগুলো গাড়ি ওয়ার্কশপে আছে, আমরা বিআরটিএকে সে তালিকা দিয়েছি। ’ 

রংচটা ও ফিটনেসবিহীন গাড়ির তালিকা জমা দিয়েছেন কি না, জানতে চাইলে তিনি কল কেটে দেন।  

বিআরটিএর কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে রংচটা ও ফিটনেসবিহীন গাড়ির তালিকা সংগ্রহ করতে গেলে মিরপুরের বিআরটিএ অফিসে খোঁজ নিতে বলা হয়। কিন্তু মিরপুর অফিসে সহকারী পরিচালক সেই তালিকা তৈরির বিষয়ে কোনো তথ্য দিতে পারেননি।  

এদিকে আঞ্চলিক পরিবহন কমিটির (আরটিসি) তথ্য অনুযায়ী, রাজধানী সড়কে ৩৮৪টি কোম্পানির প্রায় সাড়ে তিন হাজার বাস চলাচল করে, যা বিআরটিএর রুট পারমিট শাখায় নিবন্ধিত।  

প্রায় ৭৭ ভাগ বাস ফিটনেস নবায়ন না করায় সড়ক থেকে লক্কড়-ঝক্কড় বাস তুলে নেওয়ার উদ্যোগ কতটা বাস্তবায়িত হবে, এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন পরিবহন খাতের বিশেষজ্ঞরা।  

বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. হাদিউজ্জামান বলেন, ‘বিআরটিএর হিসাবেই দেখা যাচ্ছে কত সংখ্যক বাস ফিটনেস নবায়ন করে নেয়নি। এখন এ ফিটনেসবিহীন বাসগুলো সড়কে তো আর চলতে পারবে না চলতি অভিযানে। এতে রাজধানীর সড়কে গণপরিবহন সংকট দেখা দেবে। রাজধানীর যাত্রীরা বিভিন্ন গন্তব্যে যেতে তখন ছোট ছোট যানবাহনে ভরসা করবেন। এই সুযোগে সিএনজি ও রাইড শেয়ারিং সার্ভিস ইচ্ছেমতো ভাড়া বাড়িয়ে নেবে। নগরে গণপরিবহন ব্যবস্থায় বড় সংকট দেখা দেবে। ’ 

বিআরটিএর এনফোর্সমেন্ট বিভাগ আগামীকাল (সোমবার) থেকে চার জন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে রাজধানীর সড়কে অভিযান পরিচালনা করবে বলে জানিয়েছেন বিভাগের উপপরিচালক মো. হেমায়েত উদ্দিন। বাস্তবতা বুঝতে পেরে অভিযানে বাস আটক করার মতো কঠোর সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসছে বিআরটিএ। বরাবরের মতো জরিমানা আদায় করে বাসচালকদের ছেড়ে দেওয়া হবে।  

সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নূরী বলেন, ‘বিআরটিএ যে নির্দেশিকা জারি করেছিল, তার মেয়াদ ফুরিয়েছে আজ। আমরা এখন অভিযানে নামব। তবে তার আগে সর্বশেষ আরও একবার আমরা বাসমালিকদের সঙ্গে বসব। কারা কথা রেখেছে, কারা কতটা বাস ফিটনেস করে নিয়েছে, নতুন করে তার তালিকা আমরা নেব। যারা কথা রাখেনি, আমরা তাদের বিরুদ্ধে অভিযানে যাব। ’ 

এক দশক আগেও রাজধানী ঢাকায় রুট অনুযায়ী গণপরিবহনের জন্য সুনির্দিষ্ট রং নির্ধারণ করত বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। সংস্থাটির নিয়ম অনুযায়ী, কোনো বাসের রং উঠে গেলে সেটি চলাচলের অনুপযোগী হবে। কিন্তু সেই নীতিমালার তোয়াক্কা করছেন না বাস মালিকরা।  

বিআরটিএর ইঞ্জিনিয়ারিং শাখার তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা মহানগরে চলমান বাস-মিনিবাসের মধ্যে প্রায় ৭৫ শতাংশেই দরজা-জানালা ভাঙা; বসার সিট ছেঁড়া। ৮০ শতাংশ বাস-মিনিবাসের সিটে স্টিল, ফোম, কাপড় নেই। আর যেসব বাসে স্টিলের কাঠামোর ভেতর ফোম বা কাপড়ের স্তর রয়েছে, সেগুলোর অধিকাংশও ছেঁড়া। অধিকাংশ বাসের পেছনের সিগন্যালিং লাইটগুলো অকেজো। কয়েকটি বাস-মিনিবাসে পাখা থাকলেও অধিকাংশই নষ্ট। বিআরটিএ কর্মকর্তারা জানান, রাজধানীতে চলাচলকারী বাসগুলোর অর্ধেকের বেশি বাসের অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল (২০ বছর) পেরিয়ে গেছে।  

গত মার্চ মাসে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় নির্দেশনায় বলা হয়, বায়ুদূষণ রোধে ঢাকা শহরে চলাচলকারী ইকোনমিক লাইফ পেরিয়ে যাওয়া ২০ বছরের বেশি বয়সী বাস প্রত্যাহার করতে হবে। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষকে ৮ এপ্রিলের মধ্যে ঢাকা শহরে চলাচলকারী ওই বয়সী বাসের তালিকা পাঠাতে নির্দেশনা দেওয়া হয়। পরিবহন মালিক সমিতিকে ২০ এপ্রিলের মধ্যে ২০ বছরের বেশি বয়সী বাস প্রত্যাহারের পরিকল্পনা দিতে বলা হয়। পুরোনো যানবাহন পুরোপুরি নিয়ম মেনে মেরামত করতেও বলা হয়। খবর নিয়ে জানা গেছে, বিআরটিএ এখনো সেই তালিকা পরিবেশ মন্ত্রণালয়ে দেয়ইনি।  

সে সময় এ নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করে বিআরটিএর সদ্যবিদায়ী চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার বলেন, ‘আর একদিনও সময় আর বাড়ানো ঠিক হবে না। ১ জুলাই থেকে সড়কে লক্কড়-ঝক্কড় বাসের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করা দরকার। সড়ক থেকে এসব বাস তুলে নিতে পরিবহন মালিকরা নিজেরা অনেক সময় নিয়েছেন। সড়ক পরিবহন উপদেষ্টা কমিটির সভায় বাসমালিকরা এক মাস সময় বাড়িয়ে নিয়েছিলেন। সময় না বাড়িয়ে এখন জোরদার অভিযান শুরু করা হবে। ’ 

ঢাকার সড়ক থেকে লক্কড়-ঝক্কড় বাস উঠিয়ে নেওয়ার আগে বিকল্প গণপরিবহনের যোগান নিশ্চিত করার প্রয়োজন ছিল বলে মনে করেন অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান। তিনি বলেন, ‘ঢাকার নগর পরিবহন ব্যবস্থা সমন্বয়ের লক্ষ্যে বাস রুট রেশনালাইজেশনের যে পরীক্ষামূলক প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল, সেটি তো শুরু থেকেই প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। তাতে যে ঘাটতি থেকে গেছে, তার মাশুল দিতে হবে এখন। ’

ঢাকার সড়কে গণপরিবহন সমন্বয়ের দায়িত্ব মূলত ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ)। বিআরটিএ ঢাকার সড়ক থেকে লক্কড়-ঝক্কড় বাস তুলে নিতে যে উদ্যোগ নিয়েছে, তাতে ডিটিসিএকে যুক্ত না করায় সরকারি দপ্তরের সমন্বয়হীনতার চিত্র আরও বড় আকারে ফুটে উঠেছে বলে মন্তব্য করেন অধ্যাপক হাদিউজ্জামান।  

রাজধানীর গুলশান, বনানী ও হাতিরঝিলের বাসের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, ‘ঢাকা শহরে বাস নামানোর জন্য এখন আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা উচিত সরকারের। ঢাকার সড়কে এত যাত্রী। অনেক কোম্পানি লাভের আশাতেই ঢাকার সড়কে উন্নতমানের বাস নামাবে, ভালো সেবা দিতে চাইবে। ঢাকার সড়ক ব্যবস্থাপনা উন্নয়নে এত এত কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে, কিন্তু পরিস্থিতির বদল হয়নি। আমি মনে করি, মাত্র পাঁচ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করলে ঢাকার সড়ক ব্যবস্থার চিত্র আমূল বদলে যাবে। এত বছর যে পরিমাণ টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে, সেখানে এ অঙ্কটা খুব বড় নয়। ’

বাংলাদেশ সময়: ২১৩১ ঘণ্টা, জুন ৩০, ২০২৪
এনবি/আরএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।