ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

মুজিবনগর সরকারকে গার্ড অব অনার দেওয়া জীবিত মাত্র ২ জন

জুলফিকার আলী কানন, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭৪৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৭, ২০২৪
মুজিবনগর সরকারকে গার্ড অব অনার দেওয়া জীবিত মাত্র ২ জন

মেহেরপুর: ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারের শপথগ্রহণ। এদিন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ১২ জন আনসার সদস্য সরকারকে গার্ড অব অনার প্রদান করেছিলেন।

তাদের মধ্যে সেই দিনের দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে জীবিত আছেন মাত্র দুইজন আনসার সদস্য।

তারা হলেন, আনসার সদস্য সিরাজুল ইসলাম ও আজিমুদ্দীন শেখ।

শপথগ্রহণের দিন পুলিশ ও ইপিআরের সদস্যরা ভয়াবহ পরিণতি চিন্তা করে গার্ড অব অনার দিতে রাজি না হলেও জীবনের মায়া ত্যাগ করে শপথ অনুষ্ঠানে মন্ত্রিপরিষদ সদস্যদের গার্ড অব অনার প্রদান করেন ১২ জন আনসার সদস্য।

আনসার সদস্য আজিম উদ্দীন স্মৃতি চারণ করতে গিয়ে বলেন, সেদিন মা, মাটি আর মানুষের মুক্তির কথা ভেবে স্বাধীনতার অকুতোভয় সূর্য সৈনিক ১২ জন আনসার জীবনের মায়া ত্যাগ করে মন্ত্রী পরিষদকে গার্ড অব অনার প্রদানে রাজি হয়েছিলেন।

তৎকালীন মেহেরপুরের পুলিশ অফিসার মাহবুবুর রহমানের (এসপি মাহবুব) নেতৃত্বে পিসি ইয়াদ আলী, আনসার সদস্য আজিমুদ্দিন শেখ, সিরাজুল ইসলাম, অস্থির মল্লিক, হামিদুল ইসলাম, সাহেব আলী, লিয়াকত আলী, নজরুল ইসলাম, ফকির মোহাম্মদ, মহিউদ্দিন, কেসমত আলী ও মফিজ উদ্দিন অস্থায়ী সরকারের মন্ত্রী পরিষদের সদস্যদের গার্ড অব অনার প্রদান করেন।

তিনি আরও বলেন, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ মুজিবনগরের ভবরপাড়ার ইপিআর ক্যাম্পের সদস্যরা পাকিস্তানি সেনাদের প্রতিরোধ করতে কুষ্টিয়া চলে যান। সে সময় ঐ ক্যাম্পের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পান স্থানীয় ১২ আনসার সদস্য। ভারত থেকে যে সব খাদ্য সামগ্রী ও অস্ত্র—গোলাবারুদ, জ্বালানি তেল এদেশে আসতো সেগুলো সংগ্রাম কমিটির সদস্যরা একত্র করে মেহেরপুরের তৎকালীন এসডিও তৌফিক এলাহীর (বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা) হাতে তুলে দিতেন আনসার সদস্যরা। পরে এ সব সামগ্রী দেশের বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে সরবরাহ করা হতো।  

১৬ এপ্রিল সকালে তৌফিক এলাহি ১২ আনসার সদস্যকে ডেকে বলেন, বৈদ্যনাথ তলার আম্র কাননে কিছু মেহমান আসবেন। আপনার আয়োজন সম্পন্ন করেন। সেই কথা মতে গ্রামবাসীদের সহায়তায় বর্তমান মুজিবনগর স্মৃতিসৌধের স্থানে পরিষ্কার—পরিচ্ছন্ন করে কয়েকটি চৌকি এনে একটি মঞ্চ তৈরি করা হয়। পরে এদিন রাতেই ভারতীয় ফোর্স এসে সেখানে অবস্থান নেয়। পরদিন সকালে ভারতের সীমানা পেরিয়ে বৈদ্যনাথ তলায় আসেন জাতীয় চার নেতা। সঙ্গে আসেন দেশি—বিদেশি সাংবাদিক। সেখানে জাতীয় চার নেতা শপথ নেন এবং ১২ জন আনসার সদস্যে তাদের গার্ড অব অনার প্রদান করেন। এরপর গার্ড পরিদর্শন করে তারা চলে যান।

জীবনের মায়া ত্যাগ করে এবং বুক ভরা আশা নিয়ে গার্ড অব অনার ও দেশ মাতৃকার মুক্তির সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তারা। এদের মধ্যে আটজন নিরাশায় প্রস্থান করেছেন পরপারে।

সূর্য সৈনিক মফিজ উদ্দিনের স্ত্রী সকিনা বেগম জানান, সংসারে এতোই অভাব ছিল, টাকার অভাবে নিজের বাড়ির জমির খাজনা না দিতে পারায় জমি খাস হয়ে যায়। দুই ছেলে ও এক মেয়ে রেখে তিনি ২০০৬ সালের ৪ অক্টোবর মৃত্যুবরণ করেন। বর্তমানে বড় ছেলে রিকশাভ্যান চালায়। সেই আয়ের টাকা দিয়ে সংসার চলে। সে দিনকার ঘটনার জন্য আমার স্বামী ১৯৯৫ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার হিসেবে রুপার একটি মেডেল পেয়েছিলেন।  

স্ত্রী সকিনা বেগম আক্ষেপ করে বলেন, যে মানুষটি সংসার ছেলে—মেয়ের কথা চিন্তা না করে জীবনের বাজি রেখে স্বাধীনতা যুদ্ধে গিয়েছিলেন। অথচ সেই যুদ্ধের পর টাকার অভাবে ঠিকমতো সংসার চলাতে পারিনি। এ জন্যই কি যুদ্ধ করেছিল? সরকারি অনুদান তেমন একটা পায়নি। তার মৃত্যুর পর পরিবারের লোকজন একটি দুই রুম বিশিষ্ট ঘর বুঝে পেয়েছেন। কাগজে কলমে ৫০ শতক খাস জমি বরাদ্দ পেলেও দখল পায়নি আজও।

মুজিবনগর কমপ্লেক্সের দক্ষিণ পাশে খাস জমিতে ১২ আনসার সদস্যকে জমি দেয় সরকার। এদের মধ্যে আনসার সদস্য হামিদুল ও সিরাজ এবং মৃত ফকির, নজরুল, মফিজ উদ্দীন, সাহেব আলী ও মহিম উদ্দীনের পরিবার আজও ঘর বুঝে পায়নি। স্থানীয় এক প্রভাবশালীর সঙ্গে মালিকানা দ্বন্দ্ব থাকায় এ সমস্যা সৃষ্টি হয়।

গার্ড অব অনার প্রদানকারী জীবিত তিন আনসার সদস্য আজিমুদ্দীন শেখ ও সিরাজুল ইসলাম বলেন, তখন করেছি স্বাধীনতাযুদ্ধ আর এখন জীবনযুদ্ধ। শরীরে তেমন শক্তি নাই। তারপরও অন্যের জমিতে শ্রম বিক্রি করতে হয়। জীবন প্রদীপ নিভে যাওয়ার আগ পর্যন্ত এই যুদ্ধ চালাতেই হবে। তবে আশার কথা হলো তারা সবাই মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বকৃতি পেয়েছেন। এতে প্রতি মাসে ভাতা পাচ্ছেন। তাই দিয়েই কোনোমতে চলছে সংসার।

অবিস্মরণীয় সাহসিকতার সঙ্গে তারা বাংলাদেশের প্রথম সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছিলেন, তাতে রাষ্ট্রীয় পদক তারা পেতেই পারেন। সরকার অনেককেই তো পদক, খেতাব দিচ্ছে। জাতির এই বীর সন্তানদের সম্মান দেওয়া উচিত।

জীবিত দুই জন আক্ষেপ করে বলেন, আমরা গার্ড অব অনার দিয়েছিলাম ১২ জন আনসার। অথচ মুজিবনগর কমপ্লেক্সের ভাস্কর্য বা মুর্যালে দেখানো হয়েছে আটজনকে। ছবি থাকা সত্ত্বে সেখানে সবার অবয়বও সঠিকভাবে তুলে ধরা হয়নি।

মুজিবনগর সরকারই দেশের প্রথম সরকার। এটি অস্থায়ী বা প্রবাসী সরকার নয়। এই সরকারের নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন হয়েছে। এদিন শপথগ্রহণ না হলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আন্দোলন বলে বিশ্বের বুকে দাড় করাতো পাকিস্তান।

বাংলাদেশ সময়: ০৭৪২ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৬, ২০২৪
এসএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।