ঢাকা, রবিবার, ১৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

ড্রিলিং অ্যাসিস্ট্যান্ট ফাহিমকাণ্ডে সিসিকে তোলপাড়

নাসির উদ্দিন, করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৫৮ ঘণ্টা, মার্চ ৩, ২০২৪
ড্রিলিং অ্যাসিস্ট্যান্ট ফাহিমকাণ্ডে সিসিকে তোলপাড় অভিযুক্ত সিসিকের ড্রিলিং অ্যাসিস্টেন্ট জাহিদ আল ফাহিম

সিলেট: ব্যাংক রশিদে স্বাক্ষর ও সিল জালিয়াতি করে রাজস্বের প্রায় কোটি টাকা লুটপাটের ঘটনায় তোলপাড় চলছে সিলেট সিটি করপোরেশনে (সিসিক)।

এই অনিয়মে জড়িত সিসিকের ড্রিলিং অ্যাসিস্টেন্ট জাহিদ আল ফাহিম।

কিন্তু নগর কর্তৃপক্ষ তাৎক্ষণিক তাকে আইনের আওতায় না নিয়ে ছেড়ে দিয়েছে।  

এরপর থেকে ফাহিম গা-ঢাকা দেওয়ায় ভুক্তভোগী সেবাগ্রহীতাদের ব্যাংক চালানের টাকা ফেরত পাওয়া নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। যদিও সিসিকের পূর্ত শাখার কর্মকর্তারা বলছেন, ফাহিমের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

জাহিদ আল ফাহিম ২০১৯ সালে তার মামা জুনেল আহমদের সুবাদে প্রধান প্রকৌশলীকে ধরে নগর ভবনে কার্যসহকারী পদে অস্থায়ী ভিত্তিতে চাকরি নেন।  

পরে ড্রিলিং অ্যাসিস্টেন্টের দায়িত্ব পেয়ে চাকরির ৪ বছর মেয়াদে ঢের অনিয়ম করেছেন। অন্তত হাজার খানেক গ্রাহকের ভবনের অনুমোদন ফাইল নিয়ে টাকা নয়-ছয় করেছেন। টাকা হাতিয়ে নিতে সোনালী ব্যাংক সিটি করপোরেশন শাখার কর্মকর্তার সিল ও স্বাক্ষর জাল করতেন ফাহিম। গ্রাহককে বুঝিয়ে দিতেন ভুয়া ব্যাংক চালান কপি।

গত জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ে ঘটনাটি ধরা পড়ে। এরপর থেকে পলাতক ফাহিম। কিন্তু তার বিরুদ্ধে এখনও কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি সিসিকের সংশ্লিষ্ট দফতর।

সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নুর আজিজুর রহমান বাংলানিউজকে ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, ব্যাংক রশিদে স্বাক্ষর ও সিল জালিয়াত করা ২৭টি ফাইল তার হাতে এসেছে। আরও থাকলে সেগুলো খতিয়ে দেখা হবে। এসব ফাইলগুলোর টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। এই ঘটনায় ফাহিমের সঙ্গে রাঘব বেয়ালরা জড়িত।

ফাহিম জড়িত থাকার পরও তাকে ছেড়ে দেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। প্রয়োজনে মামলা করব। ঘটনাটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।  

সিসিক সূত্র জানায়, ড্রিলিং অ্যাসিস্টেন্টদের নির্দিষ্ট ওয়ার্ডের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তবে প্রধান প্রকৌশলীর দফতরের সহকারী জুনেলের ভাগ্নে হওয়াতে অবাধে কাজ করতে পারতেন ফাহিম। নির্দিষ্ট ওয়ার্ডের বাইরেও অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দিয়ে কাজ করাতেন তিনি। গত ১৫ জানুয়ারি ৩টি ফাইলে ব্যাংকের সিল ও স্বাক্ষর জালসহ ধরা পড়েন ফাহিম। এরপর বেরিয়ে আসতে থাকে তার অনিয়ম। এতোদিন ধরে চলে আসা অনিয়মের ঘটনায় সংশ্লিষ্ট শাখা প্রধানের দায়িত্ব নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।  

সিসিক সূত্র জানায়, ভবন নির্মাণে টিউবওয়েল বাধ্যতামূলক। কিন্তু টিউবওয়েলের কাগজ করিয়ে দেওয়ার কথা বলে পানি শাখায় আবেদন না করে ওয়ার্কঅর্ডার ও ব্যাংক রশিদ জালিয়াতি করার অভিযোগও রয়েছে। এছাড়া ভবনের ফাইলগুলো নিয়ে পূর্ত শাখায় জমা দিলে ড্রিলিং অ্যাসিস্টেন্টরা সেগুলো তদারকির পর সংশ্লিষ্ট শাখায় জমা দেন। নিয়ম মাফিক গ্রাহকের টাকা ব্যাংকে জমা হওয়ার পর রশিদ দিতে হয়। গ্রাহকের সেই সরলতার সুযোগ কাজে লাগিয়ে ড্রিলিং অ্যাসিস্টেন্ট ফাহিম টাকা হাতিয়ে নিতেন।

অন্যান্য সহকারী প্রকৌশলীরাও ফাহিমের মাধ্যমে পরিচিতদের কাজ করাতে গিয়ে ফেঁসে গেছেন। যদিও ভাগ্নের অনিয়মের ভাগীদার হতে চান না অফিস সহায়ক জুনেল।  

তিনি স্বীকার করেন, তার ভাগনে একটি ফাইল জালিয়াতি করেছে। ফাহিমকে দিয়ে জালিয়াতি করানো হয়েছে, দাবি তার।

এই অনিয়ম অনুসন্ধান করতে গিয়ে অন্তত শতাধিক ভুক্তভোগীর নাম উঠে এসেছে। যার কপি বাংলানিউজের কাছে সংরক্ষিত রয়েছে।  

এখনো ফাহিমের কাছে গ্রাহকের কন্ট্রাকের ৩০/৪০ লাখ টাকার ফাইল রয়েছে। তবে ভুক্তভোগীরা আপাতত প্রকাশ্যে আসতে চান না।

ফাহিম নগরের মিতালী ম্যানশনের চার তলায় একটি মেসে থাকতেন। তার রুমমেট সিসিকের কার্যসহকারী নুর আলম বলেন, ‘অস্থায়ী ভিত্তিতে আমার চাকরির মাত্র ৮ মাস হয়েছে। ভবনের ফাইল অনুমোদনে ব্যাংকের সিল ও স্বাক্ষর জাল করার ঘটনায় অফিসে ফাহিমকে নিয়ে সমালোচনার কথা শুনেছি। ভুক্তভোগীরা বাসায় এসে খোঁজ করেন। যে কারণে মাসখানেক ধরে ফাহিম এখান থাকছেন না।

একই মেসে ফাহিমের সঙ্গে থেকেছেন সিসিকের কার্যসহকারী রিফাত আহমদ। তিনিও ফাহিমের অনিয়মের কথা শুনেছেন বলে জানান।  

তিনি বলেন, ফাহিম মেসে থাকায় এবং আমাদের সঙ্গে চলাফেরা করায় তার মামা জুনেল আমাদের বকাবকিও করেছেন। গত জানুয়ারি মাসের প্রথম দিকে এক সহকারী প্রকৌশলীর ৩টি ভবন অনুমোদনের ফাইলও ব্যাংকের সিল-স্বাক্ষর জাল করতে গিয়ে ধরা পড়েন ফাহিম।  

সিসিকের স্থায়ী কার্যসহকারী আব্দুল খালিক বলেন, প্রধান প্রকৌশলীর অফিস সহায়ক জুনেলের ভাগনে হিসেবে ফাহিম আমার কক্ষে বসতো। তাকে অনেক বুঝিয়েছি সামনে তোমার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ রয়েছে। কিন্তু হাত পুড়বে জেনে কেউ আগুনে হাত দিলে কিছুই করার নেই।

সিসিকের আরেক কার্যসহকারী দীপক চন্দ্র দেব বলেন, ফাহিম মাস্টাররোলে কাজ করেন। তার বিরুদ্ধে ভবনের অনুমোদনের ব্যাংকের সিল ও স্বাক্ষর জালিয়াতির কথা শুনেছি। তবে ফাহিমকে দিয়ে নিজে কাজ করানোর কথা অস্বীকার করেন তিনি।

সিসিকের প্রধান প্রকৌশলীর সিএ (ভারপ্রাপ্ত ) জিহাদ হোসেন রাব্বী খান বলেন, ফাহিমের অনিয়মের বিষয়ে পুরোপুরি বলতে পারব না। আমি ছুটিতে ছিলাম। এসে দেখি সে বেশ কিছুদিন ধরে অফিসে আসছে না।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিসিকের ড্রিলিং অ্যাসিস্টেন্ট হিসেবে আরও আছেন  শরীফুল্লাহ (সাবেক চিফ ইঞ্জিনিয়ার সাইফুল ইসলামের সিএ)। তার চাকরি স্থায়ী হয়েছে অনেক আগেই। একই পদে স্থায়ী ড্রিলিং অ্যাসিস্টেন্ট নুরুজ্জামান নিরু কানাডা পাড়ি দিয়েছেন। তার স্থলাভিষিক্ত করে গেছেন ভাগনে জয়নাল আবেদীনকে।

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে জাহিদ আল ফাহিমের ৪টি মোবাইল নাম্বারে শনিবার থেকে একাধিক ফোন দিলেও বন্ধ পাওয়া যায়।

এ বিষয়ে সিসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, অনিয়মের অভিযোগ খতিয়ে দেখে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৪৪৬ ঘণ্টা, মার্চ ৩, ২০২৪
এনইউ/এসএএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।