ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

বাঁকখালী নদীতে ‘কল্প জাহাজ ভাসা’ উৎসব, সম্প্রীতির মিলনমেলা

সুনীল বড়ুয়া, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১১১ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩০, ২০২৩
বাঁকখালী নদীতে ‘কল্প জাহাজ ভাসা’ উৎসব, সম্প্রীতির মিলনমেলা

কক্সবাজার: পানিতে ভাসছে পঙ্খীরাজ, ড্রাগন, বিহার-মন্দির, বিশাল হাঁসসহ আরও কত কিছু! এগুলো মূলত বাঁশ, কাঠ, বেত ও রঙিন কাগজের কারুকাজে তৈরি কল্প জাহাজ। আর আকর্ষণীয় নির্মাণ শৈলী আর বৈচিত্র্যে ভরা প্রতিটি জাহাজই বেশ দৃষ্টিনন্দন।

এ গুলো ভাসতে ভাসতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে নদীর এপার থেকে ওপারে। সঙ্গে নেচে গেয়ে জাহাজের ওপরে চলছে বৌদ্ধ কীর্তন। এভাবে প্রতিবছর চলে আসছে কক্সবাজারের রামুতে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের শত বছরের ঐতিহ্যবাহী জাহাজ ভাসা উৎসব।  

বৌদ্ধদের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব শুভ প্রবারণা পূর্ণিমা উপলক্ষে রোববার (২৯ অক্টোবর) দুপুরে কক্সবাজারের রামুর বাঁকখালী নদীতে কল্প জাহাজ ভাসা উৎসবের আয়োজন করা হয়। এ উৎসবকে ঘিরে নদীর দুকূলে উৎসবের আনন্দে মেতেছে নানা ধর্ম-বর্ণের হাজারো নারী-পুরুষ ও শিশু-কিশোরেরা। যা পরিণত হয় অসাম্প্রদায়িক মিলন মেলায়।

আয়োজকরা জানান, এবার হাইটুপি-শ্রীকুল, পূর্ব মেরংলোয়া, উত্তর মিঠাছড়ি, হাজারীকুল, দ্বীপ শ্রীকুল, পূর্ব রাজারকুলসহ আটটি ‘কল্প জাহাজ’ নদীতে ভাসানো হয়েছে।

কক্সবাজার শহর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে রামু উপজেলা সদর পার হয়েই বাঁকখালী নদীর চেরাংঘাট। বিকেল ৪টায় এ ঘাটে গিয়ে দেখা যায়, লোকে লোকারণ্য নদীর দুই পাড়। গান-বাজনা,কীর্তন ও ফানুস ওড়াউড়িতে মেতে উঠেছে বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ। পাঁচ থেকে ছয়টি কাঠের নৌকার ওপর বসানো হয়েছে একেকটি কল্প জাহাজ। রঙ-বেরঙয়ের কাগজ, বাঁশ-কাঠ ও বেতের অর্পূব কারুকাজে তৈরি প্রতিটি জাহাজই নজর কাড়ছে। এসব জাহাজের মাইকে বাজছে বুদ্ধ কীর্তন- ‘বুদ্ধ ধর্ম, সংঘের নাম সবাই বলো রে’ বুদ্ধের মতো এমন দয়াল আর নাইরে’।

চট্টগ্রাম শহর থেকে উৎসব দেখতে আসা হেমা তঞ্চঙ্গা বলেন, সত্যিই অসাধারণ এক উৎসব। এখানে না এলে বুঝতে পারতাম না, এ উৎসব কতটা দৃষ্টিনন্দন ও প্রাণবন্ত।

কলেজছাত্রী প্রেরণা বড়ুয়া স্বস্তি বলেন, এটি আমাদের প্রাণের উৎসব। এ উৎসব মূলত বৌদ্ধদের হলেও প্রতি বছর এটি অসাম্প্রদায়িক মিলন মেলায় পরিণত হয়।  

যুগ যুগ ধরে আমরা এ উৎসব উদ্‌যাপন করে আসছি। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের হলেও প্রতিবছর এ উৎসব হয়ে ওঠে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মিলনমেলা। প্রতিবছর আমরা বাঁকখালী নদীতে জাহাজ ভাসানোর আনন্দে মেতে উঠি। এ যেন আমাদের প্রাণের সম্মেলন। এভাবেই অনুভূতি ব্যক্ত করেন উৎসবে আসা সংগীত শিল্পী মিনা মল্লিক।

উৎসবে আসা রামু সরকারি কলেজের শিক্ষক মানসী বড়ুয়া বলেন, শত বছর ধরে চলে আসা এই উৎসব আমাদের অসাম্প্রদায়িক চেতনার তাগিদ দেয়। এই উৎসব বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের হলেও সবার অংশগ্রহণে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মিলনমেলায় পরিণত হয়।

রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহারের আবাসিক প্রধান প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু বাংলানিউজকে বলেন, মহামতি বুদ্ধ রাজগৃহ থেকে বৈশালী যাওয়ার সময় নাগলোকের মহাঋদ্ধিমান (অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন) নাগেরা চিন্তা করলেন বুদ্ধপূজার এই দুর্লভ সুযোগ তারা হাতছাড়া করবে না। সঙ্গে সঙ্গে নাগলোকের পাঁচশত নাগরাজ বিমানের (জাহাজের) মত পাঁচশত ঋদ্ধিময় ফণা বুদ্ধপ্রমুখ পাঁচশত ভিক্ষুসংঘের মাথার ওপর বিস্তার করল।

এইভাবে নাগদের পূজা করতে দেখে দেবলোকের দেবতারা, ব্রহ্মলোকের ব্রহ্মরা বুদ্ধকে পূজা করতে এসেছিলেন। সেইদিন মানুষ, দেবতা, ব্রহ্মা, নাগ সবাই শ্বেতছত্র ধারণ করে ধর্মীয় ধবজা উড্ডয়ন করে বুদ্ধকে পূজা করেছিলেন। বুদ্ধ সেই পূজা গ্রহণ করে পুনরায় রাজগৃহে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন। সেই শুভ সন্ধিক্ষণ ছিল শুভ প্রবারণা দিবস। মূলত এই হৃদয়ছোঁয়া চিরভাস্বর স্মৃতিকে অম্লান করে রাখার জন্য বাংলাদেশের বৌদ্ধরা বিশেষ করে রামুর বৌদ্ধ সম্প্রদায় প্রবারণা পূর্ণিমায় বাঁকখালী নদীতে দৃষ্টিনন্দন কারুকার্য খচিত স্বর্গের জাহাজ ভাসিয়ে প্রবারণা উদ্‌যাপন করে।

তিনি আরও বলেন, প্রায় দুইশ বছর আগে থেকে এ জাহাজ ভাসা উৎসবের প্রচলন হয় পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমারে। সে দেশের মুরহন ঘা নামক স্থানে একটি নদীতে মংরাজ ম্রাজংব্রান প্রথম এ উৎসবেরর আয়োজন করেন। শতবছর ধরে রামুতে মহাসমারোহে এ উৎসব হয়ে আসছে।

রোববার বিকেল তিনটার দিকে প্রধান অতিথি হিসেবে অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান।  

উৎসব কমিটির সভাপতি অর্পণ বড়ুয়ার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন- অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক তাপ্তি চাকমা, রামু উপজেলা চেয়ারম্যান সোহেল সরওয়ার কাজল, রামু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফাহমিদা মোস্তফা, রামু থানার অফিসার ইনচার্জ আবু তাহের দেওয়ান, কক্সবাজার সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক জাহেদ সরওয়ার সোহেল, রামু উপজেলা যুবলীগ সভাপতি পলক বড়ুয়া আপ্পু, রামু প্রেসক্লাব সভাপতি নীতীশ বড়ুয়া, কক্সবাজার পৌর যুবলীগের সভাপতি ডালিম বড়ুয়া।

জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান বলেন, আমার মনে হয়েছে বৌদ্ধদের কল্প জাহাজ ভাসা উৎসব সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য দৃষ্টান্ত। এ ধরনের উৎসব উদ্‌যাপনের মধ্যদিয়ে দেশের মানুষ উদ্বুদ্ধ হবে অসাম্প্রদায়িক চেতনায়।

বাংলাদেশ সময়: ১১১১ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩০, ২০২৩
এসবি/এসএম
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।