ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

এসআই জহির আমার কলিজাটারে কেড়ে নিল

মিরাজ মাহবুব ইফতি, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৩৮ ঘণ্টা, জুলাই ২৬, ২০২৩
এসআই জহির আমার কলিজাটারে কেড়ে নিল

ঢাকা: ওরা আমার মেয়েরে মেরে ফেলছে। আমার মেয়ে আত্মহত্যা করতে পারে না।

পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) জহির তাকে মারধর না করলে আমার মেয়ের কিছু হতো না। ওরা আমার কলিজাটারে কেড়ে নিল। আমি এই হত্যার বিচার চাই।  

মঙ্গলবার (২৫ জুলাই) রাজধানী পল্লবীর কালশী এলাকার আদর্শ নগর মহল্লার বাসার সামনে এভাবেই আহাজারি করছিলেন আত্মহত্যা করা তরুণী বৈশাখীর মা লাভলী আক্তার।

এদিন বাদ মাগরিব কালশী কবরস্থানে বৈশাখীর দাফন সম্পন্ন হয়। বিকেলে মেয়ের জন্য লাভলী আক্তারের আহাজারি দেখে এলাকাবাসীরা বলেন, মায়ের শাস্তি মেয়ে কেন পাবে? মা তো বছরখানেক আগেই মাদক ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছে।

সোমবার (২৪ জুলাই) রাতে পল্লবী থানার আদর্শনগর এলাকায় ‘মাদকবিরোধী অভিযান’ চলাকালে লাভলী আক্তারের বাসা থেকে তার মেয়ে বৈশাখীর মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।  

কি হয়ে ছিল ওই রাতে? জানতে চাইলে লাভলী আক্তার বাংলানিউজকে বলেন, বিকেলে হঠাৎ পুলিশের দুই সোর্স এসে আমাকে বলতে থাকেন- পল্লবী থানার এসআই জহির ও ফেরদৌস আমার বাসার দুইপাশে অবস্থান করছে। আমাকে আজ (সোমবার) ধরে থানায় নিয়ে যাবেন তারা। এর কিছুক্ষণ পর জহিরের সঙ্গে আমার তর্ক বাঁধে।  

লাভলী আক্তার আরও বলেন, থানাকে ম্যানেজ করতে আমি প্রতি মাসে ৩০ হাজার করে টাকা দেই। রোববার (২৩ জুলাই) এসআই জহির আমার কাছ থেকে ৭০ হাজার টাকা নিয়ে গেছেন। কিন্তু সোমবার এসে যখন আমাকে আবারও গ্রেপ্তারের ভয় দেখানো হয়, তখন এসআই জহিরের সঙ্গে তার তর্ক হয়। ওই সময় এসআই জহির আমার কাছে ২ লাখ টাকা দাবি করেন। একপর্যায়ে টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে মেয়ে বৈশাখী সামনে আমাকে মারধর করা হয়।  

পুলিশের মারধরের বিষয়ে ভুক্তভোগী লাভলী বলেন, পুলিশের মারধরে আমার কাপড় ছিঁড়ে যায়। এ অবস্থায় আমার কাছে থাকা ৭০ হাজার টাকা এসআই জহির ও ফেরদৌস নিয়ে যায়। এরপরে আমাকে হেরোইনের মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়ার ভয়ভীতি দেখিয়ে নারী পুলিশ দিয়ে জোর করে থানায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়। তবে তাদের কাছ থেকে পালিয়ে যেত সক্ষম হই। পরে বাসা থেকে পালিয়ে পাশে থাকা ভাইয়ের বাসায় আশ্রয় নেই। কিন্তু মেয়ে বৈশাখী তৃতীয় তলায় আটকা পড়ে যায়। এরপর কি ঘটেছে আমি জানি না। প্রায় আড়াই ঘণ্টা পরে জানতে পারি আমার মেয়ে বৈশাখী আত্মহত্যা করে।

এই ঘটনার পর সোমবার রাতে পুলিশের পাঁচ সদস্য ও তিন সোর্সকে আটক করেন এলাকাবাসী। এ নিয়ে এলাকায় হয় ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া। পরে রাত সাড়ে ১২টায় মিরপুর জোনের এডিসি পুলিশ সদস্যদের দিয়ে উপস্থিত লোকজনকে মারধর করে জোর করে সেই বাসায় প্রবেশ করেন। পরে আটক পুলিশ সদস্যদের ছাড়িয়ে নিয়ে যান বলে জানায় এলাকাবাসী। তবে সেদিন থেকেই পুলিশের কাছে আটক ছিলেন লাভলী। মঙ্গলবার বিকেলে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

বৈশাখীর মা লাভলী আক্তার বাংলানিউজকে বলেন, আমি এই হত্যার বিচার চাই। আমার মেয়ের আত্মহত্যার পেছনে দারোগা জহির ও ফেরদৌস দায়ী। আমি তাদের বিচার চাই।

তিনি আরও বলেন, পুলিশ সদস্য এসআই জহির যখন আমাকে গ্রেপ্তারের হুমকি দিতে থাকেন, তখন আমার মেয়ে বৈশাখী বলে- মা’র কাছে ঠিকই তো টাকা নেন। লোভ পাইয়া গ্যাছেন গা। আশপাশে অনেকে এ ব্যবসা করে তাদের ধরেন। বৈশাখীর এই কথা শেষ না হতেই এসআই জহির আমার মেয়েকে মারধর করা শুরু করেন। সময় চড়-থাপ্পড় মারে তাকে। তখন আমি বলি ‘আপনি আমারে মারেন, আমার মেয়েকে মারেন কেন। আমার মেয়ে তো দোষ করে নাই। আর আপনি তো আমগোর (আমাদের) কাছ থাইক্যা কিছু পান নাই।

ওই সময় তার মেয়ে বৈশাখী বলেন, আপনি আমগোরে (আমাদের) মারলেন আবার থানাতেও নিয়া যাইতে চান।  

এসআই জহির বৈশাখীকে উদ্দেশ্য করে বলেন তুই ঘরে গিয়া ফাঁসি দিয়া মর গা, তারপরও তোর মায়েরে নিয়া যামু।

বর্তমানে মাদকের কারবার করি না জানিয়ে লাভলী বলেন, হেই ব্যবসা করি না বইলাই তো গতকাইল আমারে ধরবার আসছিল। তারা আইসা আমার কাছে টাকা চায়। এসআই জহির ও ফেরদৌস দারোগা আমার কাছ থাইক্যা ২ লাখ টাকা চাইছিল। দিবার পারি নাই। ঘরে কিছু টাকা আছিল, আর পাশের থাইক্যা আইনা ৭০ হাজার টাকা দিছি।  

লাভলী বলেন, ‘দারোগা জহির, ফেরদৌস ও পুলিশের সোর্স দুই ওয়াহিদ আমারে মাদক দিয়া যাইতো। এখন ব্যবসা করি না বলেই তো সোমবার এই অবস্থা করছে। তাগোরে মাসে ৩০ হাজার টাকা দেই। এই টাকা জহির ও ফেরদৌস দারোগায় নেয়। পরশু দিনকা ৭০ হাজার দিছি। তার আগের ৫০ হাজার দিছি। এর আগের দিন ৩০ হাজার দিছি। তারা গত চাইর-পাঁচ দিন থাইক্যা টাকা নিয়া যাইতেছে। তারা আমার থাইক্যা দুই-তিন বছর হইলো টাকা নেয়।

লাভলীর ভাই সুজন বাংলানিউজকে বলেন, আড়াই ঘণ্টা পর তারা আমার ভাগ্নির মরদেহ নামাইলো। আমার বোন অপরাধ করতে পারে, কিন্তু সে (বৈশাখী) তো অপরাধ করে নাই। তাইলে তারা আমার ভাগনিরে শাস্তি দিলো কেন?’

প্রতিবেশীদের অভিযোগ- এসআই জহির ও এসআই ফেরদৌস প্রতি মাসে এসে লাভলীর কাছ থেকে মাসোহারা নিয়ে যেতো। এসআই জহির মূল ভূমিকা পালন করেন। তিনি এলাকায় লাভলীকে দিয়ে মাদকের ব্যবসা করাতেন। এর আগে লাভলীকে ধরতে এসে ঘরের দরজায় ধাক্কা ও চাপ দিলে লাভলীর বাবার হাতের চারটি আঙুল কেটে যায়। পরে সেই যন্ত্রণা ভুগে কিছুদিন পরই মারা যান।  

এসব বিষয়ে জানতে এসআই জহির বলেন, আমি আপনাকে দুই মিনিট পর কল দিচ্ছি। এরপর তার সঙ্গে আর যোগাযোগ করা যায়নি। এবং এসআই ফেরদৌসের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয়। তাকেও পাওয়া যায়নি।

এসব বিষয়ে জানতে ডিএমপির মিরপুর বিভাগের ডিসি জসিম উদ্দিন মোল্লার সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তাকেও পাওয়া যায়নি।

বাংলাদেশ সময়: ১০৩৭ ঘণ্টা, জুলাই ২৬, ২০২৩
এমএমআই/এসএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।