ঢাকা, রবিবার, ১৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

সাত ভাবির ৭ হোটেল, মাসে বিক্রি ৭০ লাখ টাকা

মো. মোস্তাফিজুর রহমান, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট   | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৫৩ ঘণ্টা, মে ১৩, ২০২৩
সাত ভাবির ৭ হোটেল, মাসে বিক্রি ৭০ লাখ টাকা ভাবির হোটেলে সুস্বাদু হাঁসের মাংস দিয়ে ভাত খেতে দূর-দূরান্ত থেকে এসেছেন অনেকে।

দিনাজপুর: দিনাজপুরের বোচাগঞ্জ উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকা ভাবির মোড়। ভাবির মোড়ের নাম শুনে হয় তো মনে একটু প্রশ্ন জাগতেই পারে।

ওই এলাকার প্রকৃত নাম রানীরঘাট। পাশেই  টাঙ্গন নদ ও রাবার ড্যাম। নদী পার হলেই ঠাঁকুরগাওয়ের পীরগঞ্জ সীমান্ত।  

তবে রানীরঘাট এখন লোকমুখে পরিচিতি পেয়েছে ভাবির মোড় নামে। এখানে কয়েকজন নারী হোটেল করে আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেন। স্থানীয় লোকজন তাদের ভাবি বলেই সম্বোধন করতেন। ভাবিদের হাতে তৈরি মজাদার হাঁসের মাংসের রান্নার খবর বিভিন্নভাবে দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়ে। লোক মুখে রানীরঘাট পরিচিতি পায় ভাবির মোড় নামে।

দিনাজপুরের ভাবির মোড় বর্তমানে এতোটাই প্রসিদ্ধ যে, এখানে প্রতিদিন গড়ে দুই শতাধিক হাঁস রান্না করা হয়। মাসে যা ৬ হাজারের বেশি। এতে মাসে এসব দোকানের গড় বিক্রি ৭০ লাখ টাকা হয়।

রানীরঘাট তথা ভাবির মোড়ে প্রথম দিকে দুই থেকে তিনটি হোটেল থাকলেও বর্তমানে এখানে সাতজন ভাবি সাতটি হোটেল করেন। তাসলিমা, মাসতারা, মেরিনা ছাড়াও এখানে রাজিয়া, বেলি, লিপি ও কুলসুম নামে সাতজন নারী হোটেল দিয়েছেন। যারা লোকমুখে ভাবি বলেই সমাদৃত।  

এই নারীরা যেমন পাল্টে দিয়েছেন জায়গার নাম, তেমনি পরিবর্তন করেছেন নিজেদের ভাগ্যও। অনেকইে তাদেরকে দেখে হচ্ছেন অনুপ্রাণিত।

রানীরঘাট এখন পরিচিত ভাবির মোড় নামে।  এখানেই সাত ভাবির সাত হোটেল

কেন এসব গৃহিণী হোটেল খুলে বসলেন আর ওই এলাকা কীভাবে ভাবির মোড় নামে এতোটা পরিচিত পেয়ে গেল।  

সে কথাই জানালেন ভাবির মোড়ের অন্যতম ব্যবসায়ী তাসলিমা খাতুন।  

কথা হলে তিনি বলেন, আমার স্বামী আগে মানুষের কাজ করে খাইত। এখন আল্লাহ দিলে আর মানুষের ওখানে কাজ করতে হয় না। আমরা হোটেল দেওয়ার পর এখন দুই-তিন জন মানুষ আমাদের এখানে কাজ করে। তাদের সংসার চালায়। তারাও এখন আমাদের মকো সুখী। কিন্তু এই সুখের জন্য প্রথম দিকে আমাদেরকে অনেক কষ্ট করতে হইছে। প্রথমে এই মোড়ে একটা দোকান দিলাম। চা –পান, ছোলা বুট, পরোটা বিক্রি করতাম। এখানে আর কোনো দোকানপাট ছিলো না। কাস্টমাররা তখন ভাত খাইতে চাইত। তারপর একটু একটু করে ভাত রান্না করতাম। তখন তরকারি থাকত ডিম, নদীর মাছ, মুরগির মাংস। পরে ওদের (ক্রেতা) অনুরোধে দুই-চারটা করে হাঁস রান্না করতে লাগলাম। এখন বর্তমানে প্রতিদিন ২০ থেকে ৩০ টা হাঁসের মাংস বিক্রি হয়। যা থেকে দৈনিক ২০ হাজার থেকে ৪০ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি করি।  

তিনি বলেন, সামনে তো আম, লিচু, ভুট্টা আসতেছে। এই সময়টাতে বেশি বিক্রি হয়। আর অন্য সময়ে ১০ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা বিক্রি হয়। শুক্রবার ও শনিবার আর সরকারি ছুটির দিনে বেশি লোকজন আসে দূর-দূরান্ত থেকে।

তিনি আরও বলেন, আগে আমাদের খুব অভাব ছিল। এক কেজি চাল কেনার মতো টাকা থাকতো না। বর্তমানে এ হোটেল করে অনেক কিছু করতে পারছি। দুই মেয়েকে লেখা পড়া শিখিয়ে বিয়ে দিয়েছি। বাড়ি ঘর ঠিক করতে পারছি। এখন আল্লাহ দিলে হোটেল করে সুখে-শান্তিতে দিন কাটাতে পারছি।

এই মোড়ের অপর এক ভাবি মাসতারা বেগম। কথা হলে তিনি বলেন, হোটেল করার আগে আমি কিছুই করতাম না। আমার স্বামী মানুষের বাসায় কাজ করতেন। গ্রাম থেকে তখন এই জায়গায় এসে বাড়ি করি। তারপর ছোটখাটো একটা দোকান দেই। সেই দোকানে লোকজন বাড়তে থাকে। পরে রাস্তা পাকা করতে লাগল। রাবার ড্যাম তৈরির কাজ শুরু হলো। যারা এখানে কাজ করতেন তারা তখন নাস্তার পাশাপাশি ভাতও খেতে চাইত। অল্প করে ভাত রান্না করতাম তখন। মাছ, ডিম আর হাঁসের মাংসের তরকারি বিক্রি করতে ধরি।  ধীরে ধীরে কাজের মানুষ ছাড়াও আশেপাশের এলাকা থেকে হাঁসের মাংস খাইতে আসত। দুই-চারটা করে হাঁসের মাংস রান্না করতে করতে এখন ২০ থেকে ৫০টা হাঁসের মাংস রান্না করছি। ধীরে ধীরে এই জায়গার নাম এখন ভাবির মোড় নামে লোকজনের কাছে পরিচিত।

চলছে রান্নার প্রস্তুতি

কথা হয় এ মোড়ের আরেক দোকানদার মেরিনা ভাবির সঙ্গে। তিনি বলেন, সকাল ৭টায় হাঁস জবাই করার পর সেগুলো পরিষ্কারের কাজ শুরু হয়। তারপর মাংস কাটাকাটি শেষ করে রান্না করি। রাত ১২টা পর্যন্ত দোকান খোলা থাকে। এখানকার হাঁসের মাংসের সুস্বাদু রান্না, দাম আর পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা দেখে দূরের লোকজন আসে। একদম বাড়ির মতো করে খাওয়ানো হয়। ১৫০ থেকে ২৫০ টাকা পর্যন্ত। কেউ কেউ আবার স্পেশালভাবে ৩৫০ থেকে ৫০০ টাকারও খায়। যে যে রকম খাইতে চায় তাকে সেভাবে খাওয়ানো হয়। শুধু মাংস আর ভাতের দাম নেওয়া হয়। শাক-সবজি বা সালাত এগুলো ফ্রি থাকে।

তিনি আরও বলেন, আগে তো ডাল-ভর্তা আর ভাজি ভাত দিয়ে। তারপর ডিম, মাছ আর হাঁসের মাংস । দুই-তিনটা থেকে করে এখন ১৫-২০ টা পর্যন্ত হাঁসের মাংস রান্না করি।  এখন ধীরে ধীরে দোকানের সংখ্যা বাড়ছে। লোকজনের সংখ্যাও বাড়ছে। দিনাজপুর ছাড়াও ঠাঁকুরগাও, রংপুর পঞ্চগড় থেকেও লোক আসে। অনেকে ঢাকা থেকে এদিকে কোথাও কাজে বা ঘুরতে আসলে এখানে তখন খাইতে আসে। এসব দেখে বসুন্ধরা কোম্পানি আমাদেরকে অনেক কিছু দিছে। হোটল রঙ করে দিছে, টেবিলে স্টিকার্ড দিছে, সাইনবোর্ড দিছে, ভাত-তরকারি রাখার জন্য  বড় একটা রেকও দিছে। আগের চেয়ে এখন আমরা অনেক ভালো আছি।

সুস্বাদু হাঁসের মাংস রান্নায় ব্যস্ত একজন ভাবি

ভাবির মোড়ের কথা জানতে পেরে বন্ধুদেরকে নিয়ে লালমনিরহাট থেকে খেতে এসেছেন সুজানুর রহমান সুজন। কথা হলে তিনি জানান, ভাবির মোড়ের কথা শুনে অনেক দিন থেকেই আসার পরিকল্পনা করছিলাম। আজকে এখানে বন্ধুদেরকে নিয়ে আসছি। সকাল থেকে ভাবিদের মাংস কাটা, রান্না করা দেখেছি । রান্না খেয়ে অনেক ভালো লাগল। শহরের তুলনায় দাম ও অনেক কম। এখানকার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও পরিবেশন একদম ঘরোয়া। পাশেই নদী ও রাবার ড্যাম আছে। সব মিলিয়ে অনেক ভালো লাগল।

কাস্টমারদের হাঁসের মাংস সরবরাহে ব্যস্ত এক ভাবি

ভাবিদের দেওয়া তথ্য মতে, সাতটি হোটেলে দৈনিক গড়ে দুই শতাধিক হাঁসের মাংস রান্না করা হয়। প্রতি জোড়া হাঁস তারা ক্রয় করেন ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৪০০ টাকা পর্যন্ত। প্রতিমাসে তাদের প্রায় ছয় হাজার থেকে সাত হাজার টি হাঁস রান্না করা হয়। যার বাজার মূল্য প্রায় ৩৬ লাখ থেকে ৪০ টাকা। তাদের দৈনিক গড় বিক্রি প্রায় দুই লাখ টাকারও বেশি। আর প্রতি মাসে তাদের বিক্রি হয় প্রায় ৬৫ থেকে ৭০ লাখ টাকা। প্রতিদিন দিনাজপুর ছাড়াও আশেপাশের বেশ কয়েকটি জেলা থেকে ভাবির হোটেলে আসেন হাঁসের মাংসের স্বাদ গ্রহণ করতে।

 

বাংলাদেশ সময়: ০৮৩৫ ঘণ্টা, মে ১৩, ২০২৩
এসএএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।