ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

বাংলা ক্যালেন্ডারের উৎপত্তি বিষয়ক বিতর্ক

তারেক মাহমুদ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৫১ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৪, ২০২৩
বাংলা ক্যালেন্ডারের উৎপত্তি বিষয়ক বিতর্ক

বাংলা ক্যালেন্ডারের তিনটি অংশ রয়েছে: মাসের নাম, মাসগণণা পদ্ধতি এবং বর্ষ বা অব্দসংখ্যা। সত্যি কথা হচ্ছে সম্রাট আকবর এর একটিও প্রবর্তন করেন নি।

তবে বাংলা সনের অঙ্কটি আকবর প্রবর্তিত ইলাহী সন থেকে পরোক্ষভাবে আসতে পারে।

বাংলা মাসের নাম ও দিনগণনা পদ্ধতি এসেছে সনাতন ভারতবর্ষীয় ঐতিহ্য থেকে।

মাসের নামগুলো [অগ্রহায়ণ ছাড়া] পূর্নিমা তিথিতে চলমান নক্ষত্রকে নির্দেশ করে। যেমন বিশাখা নক্ষত্র থেকে বৈশাখ, জ্যেষ্ঠা নক্ষত্র থেকে জ্যৈষ্ঠ ইত্যাদি। নক্ষত্রগুলোর তালিকা প্রথম পাওয়া যায় ‘বেদাঙ্গ জ্যোতিষ’[১] গ্রন্থে [খ্রিষ্টপূর্ব ৭ম শতাব্দী আনুমানিক]; চৈত্র-বৈশাখ ইত্যাদি মাসের নামগুলোরও উদ্ভব ঘটে ওই যুগে।

মাসসূচক নক্ষত্র যেহেতু পূর্ণিমাকে নির্দেশ করে, তার মানে চৈত্র-বৈশাখ ইত্যাদি আসলে চান্দ্র মাসের নাম যা শুরু হয় প্রতিপদ তিথি থেকে। কিন্তু বঙ্গাব্দ একটা জেনুইন সৌর ক্যালেন্ডার। এর মাস গণা হয় রবিসংক্রান্তি অনুসারে; সূর্য একেকটা রাশিতে প্রবেশ করলে শুরু হয় নতুন সৌরমাস। বৈশাখ মাসে সূর্য মেষ রাশিতে থাকে, জ্যৈষ্ঠে থাকে বৃষ রাশিতে, আশ্বিন মাসে কন্যায়। ঠিক কখন থেকে বাংলা অঞ্চলে প্রতিপদ তিথির বদলে রবিসংক্রান্তি অনুসারে মাস গণনা শুরু হয় সেই প্রশ্নটির মীমাংসা করতে পারলেই বোঝা যাবে বাংলা সনের প্রচলন কবে।

বাংলা বর্ষপদ্ধতি কি বাঙালি জাতির একক সম্পত্তি? উত্তর হচ্ছে না। ২০২৩ সালের ১৪/১৫ এপ্রিল শুরু হচ্ছে ১৪৩০ বঙ্গাব্দ। আসামে শুরু হচ্ছে ১৪৩০ ভাস্করাব্দ, উড়িষ্যায় শুরু হচ্ছে ১৪৩০ বিলায়তী সন/উৎকলাব্দ। এ ছাড়াও তামিল, শিখ, নেপালী, বার্মিজ ও থাইল্যান্ডের নববর্ষও শুরু হচ্ছে একই সঙ্গে, তবে তাদের অব্দসংখ্যা আলাদা। বাংলা-অসম-উড়িষ্যার বাইরে তামিলনাড়ু, কেরলা, পাঞ্জাব ও আশিকভাবে নেপালে সৌর ক্যালেন্ডার ফলো করা হয়।

বঙ্গাব্দের গণনা হচ্ছে খ্রিষ্টাব্দ মাইনাস ৫৯৩। তার মানে বঙ্গাব্দকে পিছনে বাড়িয়ে দেখলে ১ বঙ্গাব্দ ৫৯৪ খ্রিষ্টাব্দে শুরু হয়েছে মনে হয়। কিন্তু সত্যিই এটা ওই বছর থেকে গোনা হচ্ছে কিনা তা নিশ্চিত বলা যায় না। বাংলায় তখন শশাঙ্কের রাজত্বকাল (৫৯০-৬২৫ খ্রি)। আর ৬০০ খ্রিষ্টাব্দে কামরূপে (পশ্চিম আসাম) রাজা ভাস্করবর্মন ক্ষমতাসীন হন। এদের মধ্যে রাজা ভাস্করবর্মণ সত্যিই একটা সম্বত (চান্দ্র বছর) চালু করেছিলেন। ওই সময়ে (৬৩৮ খ্রি) চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং এই অঞ্চল সফর করেন; তার লেখায় ভাস্করাব্দ প্রচলনের উল্লেখ থাকলেও বঙ্গাব্দের কোনো উল্লেখ নাই। দ্বিতীয়ত বঙ্গ জনপদ ওই সময়ে এমন কিছু গৌরবজনক ছিল না; মূল বঙ্গ জনপদ (বৃহত্তর ঢাকা বিভাগ) সম্ভবত শশাঙ্কের রাজ্যভুক্তও ছিল না। শশাঙ্ক ‘গৌড়াধিপতি’ পরিচয় গ্রহণ করেন; তিনি কোন অব্দ প্রচলন করে থাকলে তার নাম শশাঙ্কাব্দ কিংবা গৌড়াব্দ হওয়া স্বাভাবিক, বঙ্গাব্দ নয়।

কিছু কিছু লেখায় দেখা যায়, ৫৯৪ খ্রিষ্টাব্দের ১২ এপ্রিল বঙ্গাব্দ চালু হয়। এটা সর্বৈব ভুল তথ্য। ওই সময়ে ভারতবর্ষের কোথাও সৌর মানে পয়লা বৈশাখ গণা হত না, ১ তারিখ মানেই ছিল চান্দ্র প্রতিপদ তিথি। যদি ধরে নেওয়াও হয় যে ঐ বছর থেকে সৌর মানে পয়লা বৈশাখ গণনা শুরু হয়, তাহলেও দেখা যায় ৫৯৪ সালের পয়লা বৈশাখ পড়বে [জুলিয়ান] ২১ মার্চ; ১২ এপ্রিল নয়। এটা গাণিতিক হিসাব দিয়ে দেখানো যাবে।

১৫৮৪ সালে সম্রাট আকবর ইলাহী সন (তারিখ ই ইলাহী) নামে একটি বর্ষগণনা প্রবর্তন করেন। এর পটভূমিকায় আইন-ই আকবরি গ্রন্থে ওই সময়ে ভারতবর্ষে প্রচলিত অব্দ ও সম্বতগুলোর কথা বর্ণনা করা হয়েছে। এতে শকাব্দ ও বিক্রম সম্বতের হিসাব পাওয়া যায়, এমনকি বঙ্গ প্রদেশে লক্ষণাব্দ প্রচলিত থাকার কথাও আছে অথচ বঙ্গাব্দের কোনো উল্লেখ নেই। বাংলা বর্ষপঞ্জির মতো সফিসটিকেটেড ক্যালেন্ডার ওই সময়ে প্রচলিত থাকলে তার নাম বাদ দিয়ে বাংলা অঞ্চলের রেপ্রেজেন্টেটিভ হিসাবে লক্ষণাব্দ উল্লেখ করার কারণ নেই। এমনকি বাঙালি কবি মালাধর বসুও তার শ্রীকৃষ্ণবিজয় কাব্যের রচনাকাল বর্ণনা করেছেন শকাব্দে। তবে পশ্চিমবঙ্গের দুয়েকটি পুরনো মন্দিরে বঙ্গাব্দের উল্লেখ রয়েছে বলে লেখা হচ্ছে। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে পারলে সত্যিটা বোঝা সহজ হবে।

আরেকটি সম্ভাবনা হচ্ছে, বাংলা সনের অঙ্কটি সম্রাট আকবর প্রবর্তিত তারিখই ইলাহী থেকে গৃহীত হয়ে থাকতে পারে যদিও বাংলা বর্ষপঞ্জি আর ইলাহী সন এক নয়। আকবর ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দে সরকারি কার্যে হিজরি সনের পরিবর্তে তারিখ-ই ইলাহী চালু করেন, কিন্তু এটি আরও আটাশ বছর আগে তার সিংহাসনে আরোহণের বছর (১৫৫৬ খ্রি.) থেকে কার্যকর বলে ঘোষণা দেয়া হয়। আকবর সিংহাসনে আরোহণ করেন ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি, তখন হিজরী ৯৬৩ সন (২৮ রবিউস সানি) ছিল। কাগজে-কলমে ওই বছরের ১১ মার্চ [জুলিয়ান] বাসন্ত বিষুব স্ট্যান্ডার্ডে শুরু হয় ৯৬৩ ইলাহী সন (১ ফার্ভার্দিন)।

খ্রিষ্টাব্দের সঙ্গে ইলাহী সনের পার্থক্য ৫৯৩ বছর। এই গণনাটি বঙ্গাব্দের অঙ্কসংখ্যার সঙ্গে (খ্রিষ্টাব্দ মাইনাস ৫৯৩) মিলে যায়। এখান থেকে বলা যায় যে তারিখ-ই ইলাহী থেকেই বঙ্গাব্দ এসেছে। আবার এমনও হতে পারে যে বঙ্গাব্দ (১) শুরু হয়েছে ৫৯৪ খ্রিষ্টাব্দেই (শশাঙ্কের রাজত্বকালে), সেটা কাকতালীয়ভাবে তারিখ-ই ইলাহীর সঙ্গে মিলে গেছে। তবে সত্যিকার ইলাহী সন অবশ্য গণা হয় ৯৯১ সাল/১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দ থেকে, ততদিনে অবশ্য গ্রেগরিয়ান সংস্কারের (১৫৮২ খ্রি) ফলে ১ ফার্ভার্দিন সরে এসেছে ২১ মার্চে। অন্যদিকে ১৫৮৪ সালে বঙ্গাব্দ গণা হলে পহেলা বৈশাখ পড়ত ৭/৮ এপ্রিল। সুতরাং ইলাহী সন আর বঙ্গাব্দ অভিন্ন হতে পারে না যদিও বর্ষসংখ্যাটি কমন হতে পারে।

৯৬৩ হিজরির মুহাররম মাস ছিল বাংলা বৈশাখ মাস- এ কথাটি কোনো ঐতিহাসিক লিখেছেন এবং বাংলাপিডিয়ায় এটি গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু তথ্যটি ভুল, জেনুইন ভুল। ৯৬৩ হিজরি তথা ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দে ১ মুহাররম ছিল ৫ নভেম্বর যেদিন আকবর পানিপথের ২য় যুদ্ধে জয়ী হন। ওটা ছিল অগ্রহায়ণ মাস, কিছুতেই বৈশাখ নয়।

১৬০০ সালের দিকে ইলাহী নওরোজের কয়েক দিন পরই বৈশাখ শুরু হত। হতে পারে যে কোনো একজন মোগল গভর্নর পয়লা বৈশাখে চলতি ইলাহী সনের খাজনা আদায় শুরু করেন। এর ফলে জনগণও বাংলা মাস ব্যবহার করলেও অব্দ হিসেবে ইলাহী সনের অঙ্কটি আপন করে নেন।

বাংলাদেশ সময়: ২১৫১ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৪, ২০২৩
জেডএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।